টাকা ফেরত না দিতে অনড় ফিলিপাইন
ফিলিপাইনে
ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ায় চুরি যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের সাড়ে ৬
কোটি ডলার ফেরত পাওয়া আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশটির নতুন নেতৃত্ব টাকা
ফেরত দেয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না। এছাড়া দেশটির সরকারি
কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করে, রিজার্ভ চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের
ভেতরের লোকজন দায়ী। এ কারণে টাকা ফেরত দেয়া ঠিক হবে না। বৃহস্পতিবার
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির ইনকোয়ারার পত্রিকার সাংবাদিক
ড্যাক্সিম লুকাস এসব কথা বলেন। রিজার্ভ চুরির তথ্য প্রকাশ করে ওই সাংবাদিক
বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, ফিলিপাইনকে
অবশ্যই অর্থ ফেরত দিতে হবে। এ ব্যাপারে আইনগত সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান শুক্রবার
যুগান্তরকে বলেন, ‘রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি।
আইনগত সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ফিলিপাইনকে এ অর্থ ফেরত
দিতে হবে। এটা তারা (ফিলিপাইন) অস্বীকার করতে পারবে না। তবে দেশের
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে রিজার্ভ চুরির তথ্য অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির
দেয়া রিপোর্ট দ্রুত প্রকাশ করা উচিত। না হলে বিষয়টি নিয়ে আরও জটিলতা তৈরি
হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্র্জ্জা
আজিজুল ইসলাম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা
রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন সন্দেহ অনেক দিন ধরেই চলছে। সরকার
রিপোর্ট প্রকাশ না করায় সেটি আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, অবিলম্বে
প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের জড়িতদের শাস্তি
দেয়া উচিত। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয়
ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি
১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হয়। এর মধ্যে ৬ কোটি ৫৬ লাখ
ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর ১ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ
ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই কমিটির রিপোর্ট
প্রকাশ করা হয়নি। বৃহস্পতিবার দেয়া সাক্ষাৎকারে ফিলিপাইনি সাংবাদিক
ড্যাক্সিম লুকাস বলেন, দুই কারণে বাংলাদেশের অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়টি
গুরুত্ব দিচ্ছে না ফিলিপাইন। প্রথমত, ফিলিপাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে
গেছে। দ্বিতীয়ত, সে দেশের অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ব্যাংক তহবিল লোপাটের
সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কেউ জড়িত। বিষয়টি নিয়ে ফিলিপাইনের সংসদের
উচ্চকক্ষ সিনেটে বেশ কয়েকবার শুনানিও হয়। তিনি আরও বলেন, ফিলিপাইনের আইন
প্রণেতারা গত কয়েক মাস ধরে বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। জানতে
চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন,
বাংলাদেশ যে তদন্ত করেছে তার ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য এটি দরকার। এছাড়া যে প্রক্রিয়ায়
অর্থ চুরি গেছে তাও জানলে ভালো হয়। তা হলে ভবিষ্যতে সাবধানতা অবলম্বন করা
যাবে। বাংলাদেশকে টাকা ফেরত আনতে আরও সচেষ্ট ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে
করেন তিনি। তার মতে, ফিলিপাইন সরকার অজুহাত দেখাচ্ছে। রিজার্ভ চুরিতে
তাদেরও দোষ আছে। এদিকে রিজার্ভ চুরি নিয়ে আরেক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সাইবার গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনএসএ’ উপ-পরিচালক
রিক লিজেট বলেছেন, বাংলাদেশের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের নেপথ্যে ছিল উত্তর
কোরিয়ার হ্যাকাররা। মার্কিন সংবাদ ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি এ তথ্য প্রকাশ
করেছে।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আরসিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ
চুরির অর্থ তারা ফেরত দেবে না। কারণ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবহেলার
কারণেই রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়েছে। সংস্থাটির এ ধরনের ঘোষণা টাকা ফেরত
পাওয়ার বিষয়টিকে অনিশ্চিত করে তোলে। এরপর অর্থ উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে
ফিলিপাইন সফর করেছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।
ফিলিপাইন সরকার রিজার্ভ চুরির অর্থ আদায়ে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বলে
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দিয়েছে। জানা গেছে, রিজার্ভের অর্থ
উদ্ধারে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ (এগমন গ্রুপ) ৪টি
সংস্থার কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। অন্য সংস্থাগুলো হচ্ছে- বিশ্বব্যাংক,
অর্থ পাচারে মান নির্ধারণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় প্যাসিফিক গ্রুপ
(এপিজি) ও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংক
এসব সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এদিকে সন্ধান পাওয়া রিজার্ভের
অর্থের মধ্যে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার আছে সোনেয়ার রিসোর্ট ও ক্যাসিনো ম্যানিলার
ব্যাংক হিসাবে। ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার আছে ফিলিপাইনের রেমিটেন্স কোম্পানি
ফিলরেমের হিসাবে। ৬০ লাখ ডলার এখনও রয়েছে কিম অংয়ের কাছে। আর দেশে ফেরত
এসেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। জানা গেছে, অর্থ ফেরত আনতে সরকার গঠিত
টাস্কফোর্সের বৈঠক সম্প্রতি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অনুষ্ঠিত
হয়। সেখানে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) এবং
বিচার বিভাগের কাছে রিজার্ভ উদ্ধারের আইনগত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানার জন্য
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়। টাস্কফোর্স বৈঠকের কার্যবিবরণীতে
উল্লেখ করা হয়, গত বছর ১৬ আগস্ট নিউইয়র্কে রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের
বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং সুইফটের মধ্যে
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়।
সেখানে সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষ চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে
একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত একটি যৌথ
ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। সূত্রমতে, চুরি হওয়া রিজার্ভের ২ কোটি ৮০ লাখ
মার্কিন ডলার সোনেয়ার ক্যাসিনোর কাছে রয়েছে। এ ব্যাপারে ফিলিপাইনের উচ্চ
আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাসিনোর ব্যাংক হিসাবটি ফ্রিজ (জব্দ) করা
হয়। পাশাপাশি ফিলিপাইনের সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমে ক্যাসিনোর ব্যাংক হিসাব
ফ্রিজ আদেশের পক্ষে অস্থায়ীভাবে আরও একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কারণ
উচ্চ আদালতের আদেশ যে কোনো সময় তুলে নেয়া হলেও সুপ্রিমকোর্টের এ আদেশে
ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবে না। এদিকে এ চুরির
সঙ্গে দেশী এবং বিদেশী চক্র জড়িত থাকার বিষয়টি সরকার নিশ্চিত হয়েছে। ফলে
দেশের বাইরের জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার
কথা ভাবছে সরকার। তবে নিয়ম অনুযায়ী বিদেশী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের
বিরুদ্ধে মামলা করতে একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম থাকে। এর মধ্যে পদক্ষেপ
নিতে হয়। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বিদেশীদের বিরুদ্ধে মামলা বা আইনি পদক্ষেপ
নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের টাইম ফ্রেমের প্রয়োজন আছে কিনা,
তা জানার
নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে
(বিএফআইইউ)। এক্ষেত্রে দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতামত সংগ্রহের কথা বলা হয়।
সূত্রমতে, ফিলিপিনো-চাইনিজ ব্যবসায়ী কিম অং কর্তৃক ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার এবং
প্রায় ৪৯ কোটি পেসো বাংলাদেশকে ফেরত দিতে আদালতে একটি যৌথ প্রস্তাব দাখিল
করেছে। এ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে কিম অং এবং এএমএলসি। এ দাখিলের
পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ১ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার ফেরত পেয়েছে। এদিকে
রিজার্ভ সুরক্ষায় সুইফট পুনর্গঠনসহ ৯টি পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক লেনদেনে পৃথক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা,
ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক নিষিদ্ধ করা, ডিভাইসের ইউএসবি ড্রাইভ অকার্যকর করা,
সাইবার নিরাপত্তায় কেন্দ্র স্থাপন, অনুমোদিত ডিভাইস সংযুক্ত ও চিফ ইনফরমেশন
সিকিউরিটি অফিসার নিয়োগ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে আইটি যন্ত্রাংশ ক্রয়ে
নিরুৎসাহিত করা। আইটি স্থাপনায় এসব উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে আধা-সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
No comments