চামড়াবিহীন জুতায় বড় স্বপ্ন
১০ হাজার বর্গফুটের বিশাল মেঝে। একসঙ্গে কাজ করছেন কয়েক শ শ্রমিক। সবাই ব্যস্ত পাদুকা তৈরিতে। নানা নকশায় তৈরি হচ্ছে হাজারো জুতা, যা চামড়ার নয়। এতে মূল উপাদান হিসেবে কৃত্রিম চামড়া (সিনথেটিক), রাবার, প্লাস্টিক কিংবা কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলো রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের নামী ব্র্যান্ডগুলোর কাছে। এ চিত্র চট্টগ্রামের চান্দগাঁও শিল্প এলাকার ম্যাফ সুজ কারখানার একটি তলার। এ কারখানার চারটি ভবনে প্রায় চার লাখ বর্গফুট আয়তনের মেঝেতে একসঙ্গে কাজ করেন সাড়ে চার হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন কারখানাটিতে তৈরি হয় প্রায় ২০ হাজার জোড়া চামড়াবিহীন কেডস ও ১৫ হাজার জোড়া স্যান্ডেল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই কারখানা থেকে ৫৩ লাখ জোড়া জুতা ও স্যান্ডেল রপ্তানি হয়, যা থেকে আয় হয় ২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। আগের বছরের চেয়ে এ কারখানার রপ্তানি বেড়েছে ১৬৮ শতাংশ। ম্যাফ সুজের মতো ভালো করছে দেশের আরও ১০-১২টি কারখানা, যারা এ ধরনের জুতা রপ্তানি করে। অবশ্য এসব কারখানার ছয়টিই রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে কোরীয় ইপিজেডে ইয়াংওয়ান গ্রুপের কর্ণফুলী সুজ ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় চামড়াবিহীন জুতা বেশি তৈরি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। জুতা রপ্তানির মোট আয়ের ৩০ শতাংশ এসেছে চামড়াবিহীন জুতা থেকে। বিশ্বের ৭৮টি দেশে এসব জুতা রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যায় স্পেনে, যা মোট রপ্তানিমূল্যের ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, ভারত, জার্মানি, ইতালি, জাপানে বেশি রপ্তানি হয় বাংলাদেশে তৈরি চামড়াবিহীন জুতা। উদ্যোক্তারা জানান, কোনো জুতার ৬০ শতাংশের বেশি উপাদান চামড়ার হলে সেটিকে চামড়ার জুতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এর কম হলে তা নন-লেদার বা চামড়াবিহীন জুতা হিসেবে স্বীকৃত। ‘বাংলাদেশ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট ২০১৬’ অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে চামড়াবিহীন জুতার বাজারের আকার ছিল ৪ হাজার কোটি বা ৪০ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে চামড়া জুতার বাজারের আকার ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি বা ৬৫ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখনো নগণ্য। অবশ্য চামড়াবিহীন জুতার বড় উৎপাদক দেশ চীনের শ্রমের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। বাংলাদেশ চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি করে যে আয় করে, তাতে ম্যাফ সুজের অবদান সাড়ে ১১ শতাংশ। কারখানাটির যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। শুরুতে অবস্থা ভালো ছিল না।
তবে বিশ্বজুড়ে চামড়াবিহীন জুতার বাজার বড় হওয়ায় উদ্যোক্তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিবছরই কারখানার পরিসর বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে রপ্তানিও। কারখানাটির উদ্যোক্তাদের মতে, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষই চামড়াবিহীন জুতা ব্যবহার করে। দাম কম ও বৈচিত্র্য বেশি থাকায় চামড়াবিহীন জুতার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। কিন্তু এখন দেশীয় রপ্তানিকারকদের দখলে আছে এ বাজারের ১ শতাংশেরও কম। ম্যাফ সুজের নির্বাহী পরিচালক মো. জসীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চামড়ার জুতা রপ্তানি করে ২০ বছরে যে রপ্তানি আয় হয়েছে, চামড়াবিহীন জুতায় তা ১০ বছরে করা সম্ভব। তবে এ জন্য চামড়াবিহীন জুতাকেও নীতি সহায়তা দিতে হবে। তিনি এ খাতে চামড়ার জুতার মতো নগদ সহায়তা দাবি করে বলেন, শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ব্যবহার করা হলে মূল্য সংযোজনও ৬৫ শতাংশের বেশি হবে। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে দেশীয় রপ্তানিকারকেরা কেরিফোর, এইচঅ্যান্ডএম, কাপ্পা, পুমা, ফিলা, টিম্বারল্যান্ড, ডাইচম্যান, প্রাইমার্কের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কাছে জুতা রপ্তানি করছে। সম্প্রতি ওয়ালমার্ট, টার্গেট, টেসকোসহ অনেক ব্র্যান্ড কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও ফরচুন লেদার ক্রাফটসের চেয়ারম্যান আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজুরি বাড়ায় চীনের ব্যবসার বড় অংশই এখন ভিয়েতনামে যাচ্ছে। আমরা এ সুযোগ পুরোপুরি নিতে পারছি না। চামড়াবিহীন জুতা তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, চামড়া খাতের মতো প্রণোদনা না থাকা এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়নের সুবিধা কম থাকায় এই খাত এখনো পিছিয়ে আছে।’
No comments