মেগা প্রকল্পে জাপানের সহায়তা অনিশ্চিত by মিজানুর রহমান
বন্ধুত্বের
স্মারক হিসেবে জাপানকে এক জোড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার উপহার দিতে চেয়েছিলেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর টোকিও সফরে গিয়ে সেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৫ই
জানুয়ারির নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটি ছিল তার প্রথম বিদেশ
সফর। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে শেখ হাসিনার ওই
প্রস্তাব বেশ আলোচিত হয়েছিল। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছিলেন ব্যাঘ্র কূটনীতি।
দ্বিপক্ষীয় ওই শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি মেগা
প্রকল্পে জাপানের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছিল। টোকিওর বিবেচনায় উপস্থাপন করা
প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল- গঙ্গা ব্যারেজ, যমুনা নদীর তলদেশে বহুমুখী টানেল
নির্মাণ, একই নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর সমান্তরাল আরেকটি স্বতন্ত্র
রেল সেতু নির্মাণ, বহুমুখী ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস সড়ক এবং ঢাকার চারপাশের
চারটি নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় (ইকোলজি) ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া। গত বছরের
২৬শে মে’র সেই আলোচনায় জাপানের তরফে বাংলাদেশকে ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন ঋণ দেয়ার
ঘোষণা এসেছিল। বাংলাদেশের জন্ম থেকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে পাশে থাকা
জাপানের সঙ্গে সমন্বিত অংশীদারিমূলক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল সেদিন। দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের মুখে থাকা শেখ
হাসিনা সরকারের লুক ইস্ট পলিসি বিশেষত টোকিওর সঙ্গে সম্পর্ককে ‘উচ্চ
মাত্রা’য় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে কূটনৈতিক অঙ্গনে সফরটি ব্যাপক আলোচিত
হয়েছিল। বিশেষ করে জাপানকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার শাবক উপহার দেয়ার অভিপ্রায়
প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক হলেও সত্য, ঢাকার সেই ‘ব্যাঘ্র
কূটনীতি’ এক বছরের মাথায় হোঁচট খেয়েছে! টোকিও সেই উপহার নিতে অনীহা
দেখিয়েছে। কূটনৈতিক চ্যানেলেই সেই বার্তা পেয়েছেন ঢাকার কর্মকর্তারা। তবুও
তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, নীতিনির্ধারকরা গাইড লাইন দিয়ে চলেছেন। টোকিওর
তরফে এখনও সরাসরি ‘না’ বলা হয়নি, তবে সেই উপহার যে তারা নিচ্ছে না সেটি
স্পষ্ট করেছেন এখানে দায়িত্বরত দেশটির কূটনীতিকরা। টোকিওর সাড়া না পেয়ে
বাংলাদেশও বনের বাঘ বনে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে ঢাকা ও
টোকিওর কূটনৈতিক সূত্রে যে খবরাখবর বের হচ্ছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট-
দেশটির সঙ্গে গত এক বছরের বাংলাদেশের যে যোগাযোগ হয়েছে, তাতে সম্পর্কে
নতুনত্ব কিছু তো আসেনি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে গতি কমেছে। প্রধানমন্ত্রী যে
৫টি মেগা প্রকল্প দেশটির বিবেচনায় উপস্থাপন করেছিলেন তাতে টোকিওর তেমন সাড়া
নেই। সেই প্রকল্পগুলো এখন অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন
সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী পদ্মার ওপর (গঙ্গা)
ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে আগে দিল্লির ক্লিয়ারেন্স চায় টোকিও। ভারত-বাংলাদেশ
সম্পর্কের স্পর্শকাতরতার বিষয়টিও জাপান বিবেচনায় নিচ্ছে। তাছাড়া, দিল্লির
সম্মতি নিয়েই প্রকল্প নিয়ে এগোতে চায় ঢাকা। জাপান সেই বার্তা পাওয়ার পর ওই
প্রকল্প থেকে ফোকাস সরিয়ে নিয়েছে বলে দাবি একটি সূত্রের। দ্বিতীয়ত: যমুনা
নদীর তলদেশে বহুমুখী টানেল নির্মাণ। সেখানে এক বছরের বেশি সময় অপেক্ষার পরও
জাপানের তরফে কোন সাড়া নেই। গ্লোবালি জাপানের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের একটি
কোম্পানি সমপ্রতি সেই টানেল নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা দেশটির
বিনিয়োগও নিশ্চিত করতে পারবে বলে জানিয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর
তলদেশে বহুমুখী একটি টানেল নির্মাণে চীনের সঙ্গে এরই মধ্যে বাংলাদেশ
চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। টোকিও সফরের এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেইজিং সফরে গিয়ে
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে দেশটির সহায়তা চেয়েছিলেন
প্রধানমন্ত্রী। এক বছরের মাথায় বেইজিং সফরে গিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
এ সংক্রান্ত চুক্তি সইয়ের কাজ সম্পাদন করেন। বেইজিং সফর শেষে হংকং যান
সেতুমন্ত্রী। সেখানে জিজিয়াং কনস্ট্রাকশন ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ কোম্পানি
লিমিটেডের প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। চীনের সরকারি মালিকানাধীন
ওই প্রতিষ্ঠানটি জি-টু-জি ভিত্তিতে যমুনায় টানেল নির্মাণ করতে আগ্রহ
দেখিয়েছে। মন্ত্রী তাৎক্ষণিক আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশের বিদ্যমান
নীতিমালা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চেয়েছেন। ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সিদ্দিক এবং হংকং-এ নিযুক্ত বাংলাদেশের
কনসাল জেনারেল এম সারওয়ার মাহমুদসহ সরকারের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সেদিন মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে
জাপানের বিবেচনায় থাকা ৫ প্রকল্পের মধ্যে যমুনার টানেলটি ছিল না বলে দাবি
করেন। জাপানের সহায়তা নিয়ে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার পাশের চার নদীর স্বাভাবিক
অবস্থা ফেরানোর প্রকল্প নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্প
তৈরিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির ঘাটতি থাকার বিষয়টি এত দিন
আলোচনায় থাকলেও গত সপ্তাহে সেখানে তৃতীয় একটি দেশের যুক্ত হওয়ার খবর
বেরিয়েছে। ৪টি নদীকে একত্র করে নেয়া প্রকল্প জাপানের বিবেচনায় উপস্থাপন করা
হয়েছিল। সেখানে ঢাকা বহুমুখী ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণের বিষয়টিও ছিল।
কিন্তু এবার কেবল বুড়িগঙ্গা এবং এর সঙ্গে ঢাকা বহুমুখী ইস্টার্ন বাইপাসকে
যুক্ত করে একটি পৃথক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে ফিজিবিলিটি স্টাডি
এবং চীন সরকারের অর্থায়নের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব পেয়েছে
চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল অ্যারো-টেকনোলজি
ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (এভিক-ইঞ্জ) ও দি ফার্স্ট
ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অব হেনান ওয়াটার কনসারভেন্সি’র (সিএইচডব্লিউই)।
প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে পৃথক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে পানিসম্পদ
মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সর্বশেষ
বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর সমান্তরাল আরেকটি স্বতন্ত্র রেল সেতু নির্মাণ। এ
নিয়ে সরকারের ভেতরেই ভিন্ন চিন্তা রয়েছে বলে জানা গেছে। পদ্মা বহুমুখী
সেতুতে রেল সেতু যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সরকারের ভেতরে যমুনার সেই
প্রকল্প নিয়ে ভিন্ন চিন্তা এসেছে। জাপানের তরফে এটি নির্মাণে আগ্রহ আছে
এখনও। তবে এ প্রকল্পের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে
পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি দেশের
অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির ঘাটতিকে দায়ী করেন। খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
আমরা যেমন, আমাদের দাতাদেরও সাড়া তেমন।
অন্যান্য অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কতদূর? প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরের পর প্রকাশিত ২১ দফা ঘোষণায় দুই সরকার প্রধানের পারস্পরিক অঙ্গীকারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন, শান্তি- এই মূল্যবোধের ওপর দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং আগামীদিনে তা আরও এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরও বাড়ানো, সংস্কৃতি বিনিময় এবং আঞ্চলিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সমুদ্রসম্পদ বিশেষ করে ব্লু ইকোনমিতে সহায়তা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষিত গ্রুপের মিটিং প্রস্তাব করেছিলেন। এ নিয়ে ঢাকায় পরবর্তীকালে একটি মিটিং হয়েছে। সেখানে জাপানের অংশগ্রহণ ছিল। ঢাকায় পিস বিল্ডিং সেন্টার নির্মাণে সহায়তার প্রস্তাব রয়েছে জাপানের। দেশটির হিরোশিমা পার্কে ভাস্কর্য নির্মাণে বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল। পূর্ত মন্ত্রণালয় এর একটি নমুনা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যদূরীকরণে উন্নয়ন খাতে জাপান সরকার ১.২ বিলিয়ন ইয়েন লোন ছাড় করাসহ আগামী ৪-৫ বছরে মোট ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন লোন দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এখানে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি পাওয়ার প্ল্যান এবং সেটি নির্মাণ ও পরিচালনায় গভীর সমুদ্রে একটি জেটি নির্মাণের সুযোগ দেয়ার অঙ্গীকার করে বাংলাদেশ। এটিও চলমান রয়েছে। জলবায়ু ফান্ড বিশেষ করে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে একটি প্যাকেজ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাপান। এ খাতের অগ্রগতি খুব বেশি হয়নি। এ বছর দেশটির সঙ্গে ‘পলিসি ডায়ালগ’ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিলেন দুই সরকার প্রধান। এটি এখনও হয়নি। বাংলাদেশের নিটওয়্যার খাতে জিএসপি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে জাপানের। জ্বালানি সহায়তায় এখানে শান্তিপূর্ণ পরমাণু বিদ্যুৎ খাতে সহায়তার অঙ্গীকার রয়েছে টোকিওর। বিশেষত ফুকুসীমা দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা শেয়ারের কথা বলেছিলেন শিনজো আবে। তাও বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশীদের বৃত্তি বাড়ানোর ঘোষণা ছিল, এটি কার্যকর হয়েছে। ১৫ থেকে ২৫-এ উন্নীত হয়েছে। কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা উভয় দেশে সহজীকরণে টোকিও সম্মত হলেও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের বিষয়ে এখনও তাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল টিমকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘোষণা ছিল গত বছরের মে মাসে। এ নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে কোন সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। শেখ হাসিনার সফরের ফিরতি সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ঢাকা সফর করেছেন ৪ মাসের মাথায় গত সেপ্টেম্বরে। শেখ হাসিনা যখন আবে-কে আমন্ত্রণ জানান তখন বলা হয়েছিল- বাংলাদেশে গেলে আবে সুখবর পাবেন। বাংলাদেশ তার কথা রেখেছে। জাতিসংঘের অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটি কার্যকর হয়ে গেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বললেন: প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত দেশের ৫ মেঘা প্রকল্পে জাপানের সহায়তার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি বলেন, জাপানের সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে। ফিরতি সফরে ঢাকায় এসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ‘অগ্রাধিকার’ কোনটি জানতে চেয়েছিলেন। সেই তালিকায় বাংলাদেশ ২টি প্রকল্প উপস্থাপন করেছিল। প্রথমত: গঙ্গা ব্যারেজ, দ্বিতীয়ত: ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর পানি বিশুদ্ধকরণসহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রকল্প। জাপান সেই প্রকল্প দু’টিতে সহায়তায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে বলে দাবি প্রতিমন্ত্রীর। শিনজে আবের ঢাকা সফরের আলোচনার বিষয়ে গত ৬ই সেপ্টেম্বর প্রায় ১০ পৃষ্ঠার একটি যৌথ ঘোষণা সই হয়েছে। সেখানে ওই নীতিগত অনুমোদনের কোন উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেটি আবের মৌখিক ঘোষণা ছিল। জাপানের বিবেচনায় উপস্থাপিত প্রকল্পে চীনের আগ্রহ দেখানো সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে নিজ দপ্তরে গতকাল (রোববার) মানবজমিনকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দিনে দিনে যে অবস্থানে উন্নীত হচ্ছে সেখানে যে কোন প্রকল্পে সহায়তায় একাধিক দেশের আগ্রহ এবং প্রতিযোগিতা দেখানো খুবই স্বাভাবিক। কাকে দিয়ে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সেটি চূড়ান্ত করবে বাংলাদেশ। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ উপহার গ্রহণে জাপানের অনাগ্রহের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অন্যান্য অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কতদূর? প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরের পর প্রকাশিত ২১ দফা ঘোষণায় দুই সরকার প্রধানের পারস্পরিক অঙ্গীকারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন, শান্তি- এই মূল্যবোধের ওপর দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং আগামীদিনে তা আরও এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরও বাড়ানো, সংস্কৃতি বিনিময় এবং আঞ্চলিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সমুদ্রসম্পদ বিশেষ করে ব্লু ইকোনমিতে সহায়তা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষিত গ্রুপের মিটিং প্রস্তাব করেছিলেন। এ নিয়ে ঢাকায় পরবর্তীকালে একটি মিটিং হয়েছে। সেখানে জাপানের অংশগ্রহণ ছিল। ঢাকায় পিস বিল্ডিং সেন্টার নির্মাণে সহায়তার প্রস্তাব রয়েছে জাপানের। দেশটির হিরোশিমা পার্কে ভাস্কর্য নির্মাণে বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল। পূর্ত মন্ত্রণালয় এর একটি নমুনা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যদূরীকরণে উন্নয়ন খাতে জাপান সরকার ১.২ বিলিয়ন ইয়েন লোন ছাড় করাসহ আগামী ৪-৫ বছরে মোট ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন লোন দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এখানে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি পাওয়ার প্ল্যান এবং সেটি নির্মাণ ও পরিচালনায় গভীর সমুদ্রে একটি জেটি নির্মাণের সুযোগ দেয়ার অঙ্গীকার করে বাংলাদেশ। এটিও চলমান রয়েছে। জলবায়ু ফান্ড বিশেষ করে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে একটি প্যাকেজ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাপান। এ খাতের অগ্রগতি খুব বেশি হয়নি। এ বছর দেশটির সঙ্গে ‘পলিসি ডায়ালগ’ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিলেন দুই সরকার প্রধান। এটি এখনও হয়নি। বাংলাদেশের নিটওয়্যার খাতে জিএসপি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে জাপানের। জ্বালানি সহায়তায় এখানে শান্তিপূর্ণ পরমাণু বিদ্যুৎ খাতে সহায়তার অঙ্গীকার রয়েছে টোকিওর। বিশেষত ফুকুসীমা দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা শেয়ারের কথা বলেছিলেন শিনজো আবে। তাও বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশীদের বৃত্তি বাড়ানোর ঘোষণা ছিল, এটি কার্যকর হয়েছে। ১৫ থেকে ২৫-এ উন্নীত হয়েছে। কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা উভয় দেশে সহজীকরণে টোকিও সম্মত হলেও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের বিষয়ে এখনও তাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল টিমকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘোষণা ছিল গত বছরের মে মাসে। এ নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে কোন সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। শেখ হাসিনার সফরের ফিরতি সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ঢাকা সফর করেছেন ৪ মাসের মাথায় গত সেপ্টেম্বরে। শেখ হাসিনা যখন আবে-কে আমন্ত্রণ জানান তখন বলা হয়েছিল- বাংলাদেশে গেলে আবে সুখবর পাবেন। বাংলাদেশ তার কথা রেখেছে। জাতিসংঘের অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটি কার্যকর হয়ে গেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বললেন: প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত দেশের ৫ মেঘা প্রকল্পে জাপানের সহায়তার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি বলেন, জাপানের সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে। ফিরতি সফরে ঢাকায় এসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ‘অগ্রাধিকার’ কোনটি জানতে চেয়েছিলেন। সেই তালিকায় বাংলাদেশ ২টি প্রকল্প উপস্থাপন করেছিল। প্রথমত: গঙ্গা ব্যারেজ, দ্বিতীয়ত: ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর পানি বিশুদ্ধকরণসহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রকল্প। জাপান সেই প্রকল্প দু’টিতে সহায়তায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে বলে দাবি প্রতিমন্ত্রীর। শিনজে আবের ঢাকা সফরের আলোচনার বিষয়ে গত ৬ই সেপ্টেম্বর প্রায় ১০ পৃষ্ঠার একটি যৌথ ঘোষণা সই হয়েছে। সেখানে ওই নীতিগত অনুমোদনের কোন উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেটি আবের মৌখিক ঘোষণা ছিল। জাপানের বিবেচনায় উপস্থাপিত প্রকল্পে চীনের আগ্রহ দেখানো সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে নিজ দপ্তরে গতকাল (রোববার) মানবজমিনকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দিনে দিনে যে অবস্থানে উন্নীত হচ্ছে সেখানে যে কোন প্রকল্পে সহায়তায় একাধিক দেশের আগ্রহ এবং প্রতিযোগিতা দেখানো খুবই স্বাভাবিক। কাকে দিয়ে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সেটি চূড়ান্ত করবে বাংলাদেশ। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ উপহার গ্রহণে জাপানের অনাগ্রহের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
No comments