বিচারক নুরুল হুদা মডেল সংসদে আলোচিত হোক by মিজানুর রহমান খান
মামলার
জট অনেক ক্ষেত্রেই গরিব মানুষের গলার ফাঁস। যুগ যুগ ধরে এটা চলছে। প্রধান
বিচারপতি এস কে সিনহা প্রায় ২৭ লাখ মামলার ভারে জর্জরিত ‘মরচে ধরা’ দেশের
বিচারব্যবস্থার গৌরব ফিরিয়ে আনতে যে আহ্বান (প্রথম আলো, ১৪ জুন)
জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই জট থেকে বেরোনোর
উপায় কী? এক বছর আগে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সঙ্গে
আলোচনার পর আইন কমিশন এই বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ
করেছিল। এখন প্রধান বিচারপতির হতাশার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে তেমন
অগ্রগতি ঘটেনি। আগের মতোই অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
আমাদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আকস্মিকভাবে কোথাও কোনো জগদ্দল পাথর সহজে নড়ে না। আইন কমিশনের হিসাব বলছে, নিম্ন আদালেত প্রায় ২৮ লাখ ও হাইকোর্টে প্রায় সোয়া তিন লাখ মামলার জট চলছে (প্রধান বিচারপতি অবশ্য মামলার সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ বলে উল্লেখ করেছেন)। ২৮ লাখ মামলা মাথায় নিয়ে মাত্র ১ হাজার ৭০০ বিচারককে সারা দেশে প্রতিদিন বিচারকার্য পরিচালনা করতে হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে সাপোর্টিং স্টাফসহ তিন হাজার নতুন বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও এটা পূরণ করা যায়নি। প্রতি জেলা সদরে নতুন এজলাসকক্ষ নির্মাণসহ ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ ছিল। শনিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতি জেলায় নতুন এজলাস তৈরি হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি নিজেই বললেন, এটা যে গতিতে এগোচ্ছে, শেষ হতে ২০ বছর লাগবে।
সরকারের ভেতরে সমন্বয়হীনতা কোথায় নেমেছে, তা প্রধান বিচারপতি ও অর্থমন্ত্রীর কথোপকথনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের জুনে আইন কমিশন তার রিপোর্টে বলেছে, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সমগ্র বিচারব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিচারকদের নিজ হাতে সাক্ষীর জবানবন্দিও রেকর্ড করার পরিবর্তে কম্পিউটার টাইপ চালু করা দরকার। প্রত্যেক আদালতে প্রিন্টারসহ একটি কম্পিউটার এবং আরও তিনটি মনিটর সরবরাহ করতে হবে। বিচারকাজে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে সাক্ষীর জবানবন্দি স্টেনোগ্রাফার কম্পিউটারে টাইপ করবেন এবং তা সঠিকভাবে রেকর্ড হচ্ছে কি না, তা অবলোকন করার জন্য বিচারকসহ উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সম্মুখে একটি করে মোট তিনটি মনিটর থাকবে।
এটা পরিতাপের বিষয় যে লুট হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তথাকথিত মূলধন হিসেবে যেখানে পাঁচ হাজার কোটি টাকা গোপনে জোগান দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে গোটা বিচার বিভাগকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আদালতকে ডিজিটাল করতে বাজেটে কোনো কথা নেই। আসুন, আমরা ঘটনাটা প্রধান বিচারপতির জবানিতেই শুনি, ‘এক অনুষ্ঠানে আমি অর্থমন্ত্রীকে বললাম, বিচার বিভাগ বাংলাদেশের বাইরে অন্য দ্বীপে আছে কি না। আপনি বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটালাইজেশন নিয়ে সারা দেশের রূপরেখা দিলেন, কিন্তু বিচার বিভাগ নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেখতে পেলাম না। তখন অর্থমন্ত্রী আমাকে বললেন, “এটা তো ভুল হয়ে গেছে। আপনার আইন মন্ত্রণালয় থেকেও তো আমাকে কিছু বলেনি।”’ শনিবার প্রধান বিচারপতি এই মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রীর সামনে। এখন আমরা আশা করব বর্তমান আইনমন্ত্রী সরষের ভূতটা না তাড়াতে পারেন, সেটা চিহ্নিত করে জনগণকে অবহিত করবেন। ২০১৪ সালের ২৬ জুন আইন কমিশন ডিজিটাল করার সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল।
আমরা যদি ধরেও নিই আইন কমিশনের অবকাঠামোগত সুপারিশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হবে, তাহলেই যে জট নিরসন হবে, তা ভাবা যায় না। যথা উদ্যোগ নিতে হবে। উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনার আওতায় প্রকল্প নিতে হবে। বিদেশিদের শর্তে প্রকল্প করলে তাতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান বর্ণিত আইসোমরফিক মিমিক্রি বা অর্থহীন নকলকরণের ঝুঁকি থাকবে, কাজের কাজ তেমন কিছু হবে না। একটি একান্ত দেশীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্ধকারে আলোকরেখা হয়ে একজন বিচারক একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, আমাদের প্রধান বিচারপতিরা তাঁকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বীকৃতিও দিয়েছেন। তাহলে এটা কেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা যাচ্ছে না, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। ওই বিচারক মামলার জট নিরসনে জাপানি ব্যবস্থাপনার মডেল অনুসরণ করে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি নুরুল হুদা, বর্তমানে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ।
মানিকগঞ্জে থাকাকালে তিনি তাঁর স্থানীয় উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। এর মূল সূত্র হচ্ছে, প্রাচীন আমল থেকে ঝুলতে থাকা মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরসন করা। ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জে ১৯৬৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যবর্তী সব মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। এরপর ময়মনসিংহে গিয়ে তিনি একটি নীরব বিপ্লব করেছেন। সেখানে তিনি পৌনে তিন বছরে ৫৭ হাজার ৮২৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এর মধ্যে এমনও ৪২৫টি মামলা ছিল, যেগুলোর বয়স ওপরে ৪৭ এবং নিচে ৯। গত জানুয়ারিতে তিনি চট্টগ্রামে জেলা জজ হিসেবে বদলি হন এবং সেখানেও তিনি ইতিমধ্যে কতিপয় যুগান্তকারী সংস্কার এনেছেন। রেকর্ড রুম হলো আদালতের হৃদয়। সেখানে তিনি এক সফল ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন। একটি ম্যাপ প্রস্তুত করেছেন, যে কারণে এখন চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো মামলার নকল পাওয়া যাচ্ছে।
প্রচলিত ব্যবস্থার ভেতরে থেকেও যে বদলে দেওয়া যায়, নুরুল হুদা সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনুকরণীয় উদ্যোগের কথা কয়েক বছর ধরে পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। প্রথমে এটা অবিশ্বাস্য মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যে প্রশাসনব্যবস্থায় আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই ভবিতব্য হয়ে পড়েছে, সেখানে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির আন্তরিক উদ্যোগ দিয়ে কার্যকর পরিবর্তন আনা কতটা সম্ভব? কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে এটা অবাস্তব নয়। সত্যি একজন নুরুল হুদা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি এর স্বীকৃতি পাননি, তা বলা ভুল হবে। আবার স্বীকৃতি পেয়েছেন, সেটাও বলা যাবে না। তবে তাঁকে আমরা জাতি হিসেবে সবচেয়ে বড় সম্মান দিতে পারি, যদি আমরা তাঁর ব্যবস্থাপনা মডেলকে সরকারিভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারি। এঁরাই আমাদের সমাজসংস্কারক। এঁরাই আমাদের জাতীয় বীর, যাঁরা বহু ক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন এবং নীরবে-নিভৃতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কেবল বিচার বিভাগে নয়, জনপ্রশাসনের আরও বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভূমি জরিপ ও তাদের ঘুণে ধরা মহাফেজখানার প্রাণসঞ্চারে নুরুল হুদা মডেল চালু করা যায়।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ধন্যবাদ যে তাঁরা এই বিচারকের কাজের মূল্যায়ন করেছেন। আইন কমিশন সরেজমিন ময়মনসিংহে গিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। সংসদীয় কমিটিও পরিদর্শন করেছে, আবার কমিটিতে ডেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে।
আইন কমিশন তাঁর সাফল্যের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। জেলা ও দায়রা জজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, জেলা জজশিপের অন্যান্য বিচারক, বারের সদস্য ও আদালতের কর্মচারীদের সহযোগিতা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধিগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে অনিয়মগ্রস্ত নিম্ন আদালতের চিত্র বারংবার আসছে। সেসব অভিযোগ অমূলক নয়, আবার সেই পরিবেশ থেকেই মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন একজন নুরুল হুদা।
আমরা মনে করি, তাঁর দেখিয়ে দেওয়া উদ্যোগকে আরও সামনে নিতে হবে। এটা সুখবর যে অর্থমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির অম্লমধুর অনুযোগ কবুল করেছেন এবং আদালতে ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি সম্পূরক বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন। আমাদের মনে হয়, সংসদের ফ্লোরে একে কেন্দ্র করেই মামলাজট নিরসনে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হতে পারে। আর সেখানে নুরুল হুদা মডেলের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানানো যায়। এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উৎসাহিত করার বিষয় হিসেবে নয়, তাঁর প্রবর্তিত নিয়মরীতির প্রতি একটি রাজনৈতিক স্বীকৃতি দরকার। আমরা আমাদের সংসদের ফ্লোরকে এ ধরনের গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করার ধারা চালু করতে পারি।
নুরুল হুদা মডেলের সাফল্য কেন এসেছে, তা আইন কমিশন চিহ্নিত করেছে, এখন সেটা সংসদে আলোচনা করা হলে সারা দেশের বিচারকেরা নুরুল হুদাকে অনুসরণে স্বভাবজাত ও পারিপার্শ্বিক জড়তা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এটাই সব থেকে জরুরি।
সংস্কার করতে গিয়ে নুরুল হুদা বিড়ম্বনা ও মহলবিশেষের ঈর্ষার শিকার হয়েছেন। সে খবর তাঁর সহকর্মীরা জানেন, আর তাই আইন কমিশন ও সংসদীয় কমিটি সাড়ম্বরে তাঁর প্রশংসা করেছে বলেই তারা তাঁকে অনুসরণ করবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। তদুপরি কয়েকটি স্থানে জেলা জজরা তাঁকে অনুসরণ করে সুফল পাচ্ছেন বলে জানি। ২০১১ সালের ২৬ জুন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দপ্তর থেকে একটি চিঠি গিয়েছিল। তাতে নুরুল হুদা মডেল অনুসরণে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা হয়। ৩৫ দিন পরে সে–মতে প্রতি জজশিপে চিঠিও যায়। কিন্তু পরে অনেকের মনে পড়ে যে এটা বিধিমাফিক হয়নি। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই চিঠি গিয়েছে। কথাটা পাঁচ কান হতে দেরি হয় না। তাই ওই চিঠি প্রত্যাহার করা না হলেও পরে আর কেউ অনুসরণ করছেন বলে জানা যায় না।
গত ফেব্রুয়ারিতে জেলা জজদের সম্মেলন ডাকেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি। সেখানে নুরুল হুদা তাঁর সংস্কারের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সুতরাং বিষয়টি প্রধান বিচারপতি অবগত আছেন। আশা করতে পারি, সুপ্রিম কোর্ট এটা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন।
তবে আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তাঁর উপস্থিতিতে মামলাজট নিরসনে একটি আলোচনা হওয়া উচিত। এই আলোচনার জন্য আইন কমিশনের তৈরি করা জট নিরসনে ছয় পৃষ্ঠা ও নুরুল হুদার বিষয়ে দুই পৃষ্ঠার রিপোর্ট কার্যপত্র হতে পারে। সংসদের আলাপ-আলোচনায় বিচার বিভাগের ব্যবস্থাপনা সমস্যা যেন নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ক্রমেই সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংলাপও প্রত্যক্ষ করছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
আমাদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আকস্মিকভাবে কোথাও কোনো জগদ্দল পাথর সহজে নড়ে না। আইন কমিশনের হিসাব বলছে, নিম্ন আদালেত প্রায় ২৮ লাখ ও হাইকোর্টে প্রায় সোয়া তিন লাখ মামলার জট চলছে (প্রধান বিচারপতি অবশ্য মামলার সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ বলে উল্লেখ করেছেন)। ২৮ লাখ মামলা মাথায় নিয়ে মাত্র ১ হাজার ৭০০ বিচারককে সারা দেশে প্রতিদিন বিচারকার্য পরিচালনা করতে হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে সাপোর্টিং স্টাফসহ তিন হাজার নতুন বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও এটা পূরণ করা যায়নি। প্রতি জেলা সদরে নতুন এজলাসকক্ষ নির্মাণসহ ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ ছিল। শনিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতি জেলায় নতুন এজলাস তৈরি হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি নিজেই বললেন, এটা যে গতিতে এগোচ্ছে, শেষ হতে ২০ বছর লাগবে।
সরকারের ভেতরে সমন্বয়হীনতা কোথায় নেমেছে, তা প্রধান বিচারপতি ও অর্থমন্ত্রীর কথোপকথনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের জুনে আইন কমিশন তার রিপোর্টে বলেছে, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সমগ্র বিচারব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিচারকদের নিজ হাতে সাক্ষীর জবানবন্দিও রেকর্ড করার পরিবর্তে কম্পিউটার টাইপ চালু করা দরকার। প্রত্যেক আদালতে প্রিন্টারসহ একটি কম্পিউটার এবং আরও তিনটি মনিটর সরবরাহ করতে হবে। বিচারকাজে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে সাক্ষীর জবানবন্দি স্টেনোগ্রাফার কম্পিউটারে টাইপ করবেন এবং তা সঠিকভাবে রেকর্ড হচ্ছে কি না, তা অবলোকন করার জন্য বিচারকসহ উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সম্মুখে একটি করে মোট তিনটি মনিটর থাকবে।
এটা পরিতাপের বিষয় যে লুট হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তথাকথিত মূলধন হিসেবে যেখানে পাঁচ হাজার কোটি টাকা গোপনে জোগান দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে গোটা বিচার বিভাগকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আদালতকে ডিজিটাল করতে বাজেটে কোনো কথা নেই। আসুন, আমরা ঘটনাটা প্রধান বিচারপতির জবানিতেই শুনি, ‘এক অনুষ্ঠানে আমি অর্থমন্ত্রীকে বললাম, বিচার বিভাগ বাংলাদেশের বাইরে অন্য দ্বীপে আছে কি না। আপনি বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটালাইজেশন নিয়ে সারা দেশের রূপরেখা দিলেন, কিন্তু বিচার বিভাগ নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেখতে পেলাম না। তখন অর্থমন্ত্রী আমাকে বললেন, “এটা তো ভুল হয়ে গেছে। আপনার আইন মন্ত্রণালয় থেকেও তো আমাকে কিছু বলেনি।”’ শনিবার প্রধান বিচারপতি এই মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রীর সামনে। এখন আমরা আশা করব বর্তমান আইনমন্ত্রী সরষের ভূতটা না তাড়াতে পারেন, সেটা চিহ্নিত করে জনগণকে অবহিত করবেন। ২০১৪ সালের ২৬ জুন আইন কমিশন ডিজিটাল করার সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল।
আমরা যদি ধরেও নিই আইন কমিশনের অবকাঠামোগত সুপারিশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হবে, তাহলেই যে জট নিরসন হবে, তা ভাবা যায় না। যথা উদ্যোগ নিতে হবে। উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনার আওতায় প্রকল্প নিতে হবে। বিদেশিদের শর্তে প্রকল্প করলে তাতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান বর্ণিত আইসোমরফিক মিমিক্রি বা অর্থহীন নকলকরণের ঝুঁকি থাকবে, কাজের কাজ তেমন কিছু হবে না। একটি একান্ত দেশীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্ধকারে আলোকরেখা হয়ে একজন বিচারক একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, আমাদের প্রধান বিচারপতিরা তাঁকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বীকৃতিও দিয়েছেন। তাহলে এটা কেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা যাচ্ছে না, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। ওই বিচারক মামলার জট নিরসনে জাপানি ব্যবস্থাপনার মডেল অনুসরণ করে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি নুরুল হুদা, বর্তমানে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ।
মানিকগঞ্জে থাকাকালে তিনি তাঁর স্থানীয় উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। এর মূল সূত্র হচ্ছে, প্রাচীন আমল থেকে ঝুলতে থাকা মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরসন করা। ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জে ১৯৬৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যবর্তী সব মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। এরপর ময়মনসিংহে গিয়ে তিনি একটি নীরব বিপ্লব করেছেন। সেখানে তিনি পৌনে তিন বছরে ৫৭ হাজার ৮২৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এর মধ্যে এমনও ৪২৫টি মামলা ছিল, যেগুলোর বয়স ওপরে ৪৭ এবং নিচে ৯। গত জানুয়ারিতে তিনি চট্টগ্রামে জেলা জজ হিসেবে বদলি হন এবং সেখানেও তিনি ইতিমধ্যে কতিপয় যুগান্তকারী সংস্কার এনেছেন। রেকর্ড রুম হলো আদালতের হৃদয়। সেখানে তিনি এক সফল ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন। একটি ম্যাপ প্রস্তুত করেছেন, যে কারণে এখন চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো মামলার নকল পাওয়া যাচ্ছে।
প্রচলিত ব্যবস্থার ভেতরে থেকেও যে বদলে দেওয়া যায়, নুরুল হুদা সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনুকরণীয় উদ্যোগের কথা কয়েক বছর ধরে পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। প্রথমে এটা অবিশ্বাস্য মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যে প্রশাসনব্যবস্থায় আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই ভবিতব্য হয়ে পড়েছে, সেখানে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির আন্তরিক উদ্যোগ দিয়ে কার্যকর পরিবর্তন আনা কতটা সম্ভব? কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে এটা অবাস্তব নয়। সত্যি একজন নুরুল হুদা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি এর স্বীকৃতি পাননি, তা বলা ভুল হবে। আবার স্বীকৃতি পেয়েছেন, সেটাও বলা যাবে না। তবে তাঁকে আমরা জাতি হিসেবে সবচেয়ে বড় সম্মান দিতে পারি, যদি আমরা তাঁর ব্যবস্থাপনা মডেলকে সরকারিভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারি। এঁরাই আমাদের সমাজসংস্কারক। এঁরাই আমাদের জাতীয় বীর, যাঁরা বহু ক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন এবং নীরবে-নিভৃতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কেবল বিচার বিভাগে নয়, জনপ্রশাসনের আরও বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভূমি জরিপ ও তাদের ঘুণে ধরা মহাফেজখানার প্রাণসঞ্চারে নুরুল হুদা মডেল চালু করা যায়।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ধন্যবাদ যে তাঁরা এই বিচারকের কাজের মূল্যায়ন করেছেন। আইন কমিশন সরেজমিন ময়মনসিংহে গিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। সংসদীয় কমিটিও পরিদর্শন করেছে, আবার কমিটিতে ডেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে।
আইন কমিশন তাঁর সাফল্যের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। জেলা ও দায়রা জজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, জেলা জজশিপের অন্যান্য বিচারক, বারের সদস্য ও আদালতের কর্মচারীদের সহযোগিতা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধিগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে অনিয়মগ্রস্ত নিম্ন আদালতের চিত্র বারংবার আসছে। সেসব অভিযোগ অমূলক নয়, আবার সেই পরিবেশ থেকেই মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন একজন নুরুল হুদা।
আমরা মনে করি, তাঁর দেখিয়ে দেওয়া উদ্যোগকে আরও সামনে নিতে হবে। এটা সুখবর যে অর্থমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির অম্লমধুর অনুযোগ কবুল করেছেন এবং আদালতে ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি সম্পূরক বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন। আমাদের মনে হয়, সংসদের ফ্লোরে একে কেন্দ্র করেই মামলাজট নিরসনে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হতে পারে। আর সেখানে নুরুল হুদা মডেলের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানানো যায়। এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উৎসাহিত করার বিষয় হিসেবে নয়, তাঁর প্রবর্তিত নিয়মরীতির প্রতি একটি রাজনৈতিক স্বীকৃতি দরকার। আমরা আমাদের সংসদের ফ্লোরকে এ ধরনের গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করার ধারা চালু করতে পারি।
নুরুল হুদা মডেলের সাফল্য কেন এসেছে, তা আইন কমিশন চিহ্নিত করেছে, এখন সেটা সংসদে আলোচনা করা হলে সারা দেশের বিচারকেরা নুরুল হুদাকে অনুসরণে স্বভাবজাত ও পারিপার্শ্বিক জড়তা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এটাই সব থেকে জরুরি।
সংস্কার করতে গিয়ে নুরুল হুদা বিড়ম্বনা ও মহলবিশেষের ঈর্ষার শিকার হয়েছেন। সে খবর তাঁর সহকর্মীরা জানেন, আর তাই আইন কমিশন ও সংসদীয় কমিটি সাড়ম্বরে তাঁর প্রশংসা করেছে বলেই তারা তাঁকে অনুসরণ করবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। তদুপরি কয়েকটি স্থানে জেলা জজরা তাঁকে অনুসরণ করে সুফল পাচ্ছেন বলে জানি। ২০১১ সালের ২৬ জুন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দপ্তর থেকে একটি চিঠি গিয়েছিল। তাতে নুরুল হুদা মডেল অনুসরণে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা হয়। ৩৫ দিন পরে সে–মতে প্রতি জজশিপে চিঠিও যায়। কিন্তু পরে অনেকের মনে পড়ে যে এটা বিধিমাফিক হয়নি। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই চিঠি গিয়েছে। কথাটা পাঁচ কান হতে দেরি হয় না। তাই ওই চিঠি প্রত্যাহার করা না হলেও পরে আর কেউ অনুসরণ করছেন বলে জানা যায় না।
গত ফেব্রুয়ারিতে জেলা জজদের সম্মেলন ডাকেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি। সেখানে নুরুল হুদা তাঁর সংস্কারের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সুতরাং বিষয়টি প্রধান বিচারপতি অবগত আছেন। আশা করতে পারি, সুপ্রিম কোর্ট এটা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন।
তবে আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তাঁর উপস্থিতিতে মামলাজট নিরসনে একটি আলোচনা হওয়া উচিত। এই আলোচনার জন্য আইন কমিশনের তৈরি করা জট নিরসনে ছয় পৃষ্ঠা ও নুরুল হুদার বিষয়ে দুই পৃষ্ঠার রিপোর্ট কার্যপত্র হতে পারে। সংসদের আলাপ-আলোচনায় বিচার বিভাগের ব্যবস্থাপনা সমস্যা যেন নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ক্রমেই সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংলাপও প্রত্যক্ষ করছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments