ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তা: ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিন
সম্পাদকীয়ঃ দেশের সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার বা ইউডিসি) যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বেশ উপকারে আসছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চালু হওয়ার পর থেকে গত পাঁচ বছরে এগুলোর নারী উদ্যোক্তাদের অর্ধেকই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তা হতাশাব্যঞ্জক।
নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শুরু থেকে প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন পুরুষ উদ্যোক্তার সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও যুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচির পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইউডিসি শুমারি ও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের অনুসন্ধান—এ তিন মাধ্যমেই নারী উদ্যোক্তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও নিরুৎসাহের চিত্র মিলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে নারীদের যুক্ত করার সিদ্ধান্তটিকে ফলপ্রসূ করার প্রস্তুতি কতটা ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কার্যত দেখা যাচ্ছে প্রস্তুতির অভাব ছিল প্রকট।
নারী উদ্যোক্তাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার প্রধান যে কারণটি চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলো এই কাজে তাঁদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব। যেসব নারী উদ্যোক্তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই তথ্যকেন্দ্রগুলোয় সেবাদানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। সে কারণে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় তাঁদের আয় অত্যন্ত কম: একজন পুরুষ উদ্যোক্তা যেখানে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন, সেখানে একজন নারী উদ্যোক্তা পারেন ৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেক নারী উদ্যোক্তা কম্পিউটার চালু করা ও বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি; ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না জানলে তথ্যকেন্দ্রে সেবা দেওয়া অসম্ভব। নারী উদ্যোক্তাদের যে সামান্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা যে ফলপ্রসূ হয়নি, তা বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোর সেবা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সে জন্য তাঁদের মানসম্পন্ন ও টেকসই প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়াই প্রথম জরুরি কাজ।
নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শুরু থেকে প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন পুরুষ উদ্যোক্তার সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও যুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচির পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইউডিসি শুমারি ও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের অনুসন্ধান—এ তিন মাধ্যমেই নারী উদ্যোক্তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও নিরুৎসাহের চিত্র মিলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে নারীদের যুক্ত করার সিদ্ধান্তটিকে ফলপ্রসূ করার প্রস্তুতি কতটা ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কার্যত দেখা যাচ্ছে প্রস্তুতির অভাব ছিল প্রকট।
নারী উদ্যোক্তাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার প্রধান যে কারণটি চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলো এই কাজে তাঁদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব। যেসব নারী উদ্যোক্তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই তথ্যকেন্দ্রগুলোয় সেবাদানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। সে কারণে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় তাঁদের আয় অত্যন্ত কম: একজন পুরুষ উদ্যোক্তা যেখানে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন, সেখানে একজন নারী উদ্যোক্তা পারেন ৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেক নারী উদ্যোক্তা কম্পিউটার চালু করা ও বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি; ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না জানলে তথ্যকেন্দ্রে সেবা দেওয়া অসম্ভব। নারী উদ্যোক্তাদের যে সামান্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা যে ফলপ্রসূ হয়নি, তা বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোর সেবা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সে জন্য তাঁদের মানসম্পন্ন ও টেকসই প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়াই প্রথম জরুরি কাজ।
নারী উদ্যোক্তার অর্ধেক ঝরে গেছেন -ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র by শেখ সাবিহা আলম
আপডেট: জুলাই ০৫, ২০১৫
দেশের ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলো পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন যে নারীরা, পাঁচ বছরে তাঁদের অর্ধেকই ঝরে পড়েছেন। প্রতিদিন কেন্দ্রে যাচ্ছেন ৫ শতাংশের কম নারী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচির পর্যবেক্ষণ হলো, নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
২০১০ সালে একযোগে দেশের ৪ হাজার ৫৯৮টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র চালু হয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়েরই একটি কক্ষ থেকে। পরীক্ষার ফলাফল, সরকারি ফরম ডাউনলোড, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্ড, অনলাইনে ভর্তি, ডেটা এন্ট্রি, ভিজিডি/ভিজিএফ ডেটাবেইস, চাকরির খবর, ভিসা ফরমসহ বিভিন্ন সেবা মানুষ যেন নিজেদের দোরগোড়ায় পেতে পারে, সে উদ্দেশ্যে সারা দেশে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার-ইউডিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কেন্দ্রগুলোতে একজন পুরুষের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে একজন নারীকেও যুক্ত করা হয়।
তবে চালুর পর থেকেই ঝরে পড়তে থাকেন নারীরা। ঝরে পড়ার হার যে প্রকট, তা সুস্পষ্ট হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইউডিসি শুমারি থেকে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ নারী নিয়মিত তথ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন। সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন হাজির থাকছেন ২৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ নারী।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, শেরপুর, জামালপুর, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, বরগুনা, বরিশালের গৌরনদী, কুমিল্লার দাউদকান্দির মোট ১২টি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। এসব কেন্দ্রে পুরুষ উদ্যোক্তার কাছে যত লোক সেবা নিতে আসছেন, ততটা আসছেন না নারীদের কাছে। ফলে আয়বৈষম্য ব্যাপক। অনেক নারীই বলেছেন, সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া তাঁদের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর।
ইউডিসি শুমারির এই ঝরে পড়ার তথ্যের সত্যতা মেলে মাঠপর্যায়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও। এক বরগুনারই ৪৭টি ইউনিয়ন ও পৌর ডিজিটাল সেন্টারে যেসব নারী উদ্যোক্তা শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ এখন নেই। জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র নাচনাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে খাদিজা আকতার নামে একজন নারী উদ্যোক্তা আছেন।
তবে দেশের সব ইউনিয়নের চিত্র এক নয়। কোথাও কোথাও নারীরাই ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র চালাচ্ছেন।
এটুআই প্রকল্পের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুল হক বলেছেন, নারীদের ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নারীদের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
সমস্যা কোথায়: সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কম্পিউটার চালানো, কম্পোজ করতে পারা, ফরম পূরণ, ই-মেইল ও স্কাইপে কথোপকথনের যোগ্যতা যাঁদের আছে, তাঁরাই তথ্যকেন্দ্রের নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তার কাজ পান। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সুপারিশে নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের নিয়োগ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন নারী অনেক সময় পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। প্রশিক্ষণের অভাবই মূলত নারীদের টেনে ধরছে।
এটুআই সূত্র বলেছে, যোগ্যতাসম্পন্ন নারী-পুরুষ কেন্দ্র চালানোর দায়িত্ব পাবেন—এমনটিই ধরে নেওয়া হয়েছিল। নারীরা কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারেন, কাজ করতে করতে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবেন এমনটিও ভাবা হয়েছিল। প্রশিক্ষণের বিষয়টি এই কর্মসূচিতে ছিল না। তারপরও ইউনিয়ন কেন্দ্রগুলো চালুর সময় যে নারীরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা ঝরে যাওয়ার পর যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের আর সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাঁরা একটি ‘অনলাইন টিউটোরিয়াল’ করেছিলেন। কিন্তু সব জায়গায় ইন্টারনেটের গতি সন্তোষজনক না হওয়ায় অনলাইন টিউটোরিয়ালের সুবিধা তাঁরা নিতে পারছেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের একটি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে সাত মাস কাজ করেছেন—এমন এক পুরুষ উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তাঁর সহকর্মী (নারী) শুধু কম্পিউটার চালাতে ও বন্ধ করতে পারতেন। ইন্টারনেট সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। পাশের ইউনিয়নগুলোতেও একই অবস্থা। নারীদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া না যায়, তাহলে তাঁরা থাকবেন না।
এটুআইয়ের কর্মসূচি সমন্বয়ক মোহাম্মদ মাজেদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রশিক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তারাও পাবেন।
বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তাই বলেছেন, তথ্যকেন্দ্রের এ কাজটি তাঁদের জন্য যথেষ্ট লাভজনক নয়। কেন্দ্রের আয় নারী-পুরুষ দুজনের ভাগ করে নেওয়ার কথা থাকলেও আদতে তা হচ্ছে না। গত ৬ এপ্রিল রাজশাহীর হরিপুর ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে নারী উদ্যোক্তা লুৎফুন্নেসার সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে আমার আয় হাজার ছয়েক টাকা। আমার সঙ্গে শরীফুল ইসলাম কাজ করেন। আমি যা আয় করি, তা আমার আর ও যা আয় করে সেটা ওর।’ জানা গেছে, পুরুষ উদ্যোক্তারা ২০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। সেখানে নারীদের সর্বোচ্চ আয় ১০ হাজার টাকার মতো।
শেরপুর সদর উপজেলার রামেরচর গ্রামের আবদুস সোবহানের মেয়ে মুকলিমা খাতুন ছিলেন বলাইয়েরচর ইউনিয়নের তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এইচএসসি পাস করার পর আমি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ওই কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আয়রোজগার ভালো হবে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোনো সম্মানী বা ভাতা না থাকায় শুধু আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ পেশা থেকে আয় করা খুব কঠিন। বিয়ের পর তাই আর কেন্দ্রে যাইনি।’
শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, নকলা ও শ্রীবরদী উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩০টি কেন্দ্রে নারী উদ্যোক্তা আছেন। ২২টিতে নেই। যেগুলোতে আছেন, সেখানেও ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কম।
বগুড়ায় নন্দীগ্রাম ও আড়িয়ার দুই নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন মাস্টার্স শেষ করেছেন, অন্যজন পড়ছেন। দুজনই অন্য চাকরি খুঁজছেন। তাঁদের একজন বিবাহিত। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার সরকারি হবে কবে থিকে শুনতেছি। সে জন্যই অপেক্ষা করতেছি। অন্য চাকরিরও চেষ্টা করছি।’
২০১০ সালে একযোগে দেশের ৪ হাজার ৫৯৮টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র চালু হয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়েরই একটি কক্ষ থেকে। পরীক্ষার ফলাফল, সরকারি ফরম ডাউনলোড, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্ড, অনলাইনে ভর্তি, ডেটা এন্ট্রি, ভিজিডি/ভিজিএফ ডেটাবেইস, চাকরির খবর, ভিসা ফরমসহ বিভিন্ন সেবা মানুষ যেন নিজেদের দোরগোড়ায় পেতে পারে, সে উদ্দেশ্যে সারা দেশে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার-ইউডিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কেন্দ্রগুলোতে একজন পুরুষের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে একজন নারীকেও যুক্ত করা হয়।
তবে চালুর পর থেকেই ঝরে পড়তে থাকেন নারীরা। ঝরে পড়ার হার যে প্রকট, তা সুস্পষ্ট হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইউডিসি শুমারি থেকে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ নারী নিয়মিত তথ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন। সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন হাজির থাকছেন ২৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ নারী।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, শেরপুর, জামালপুর, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, বরগুনা, বরিশালের গৌরনদী, কুমিল্লার দাউদকান্দির মোট ১২টি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। এসব কেন্দ্রে পুরুষ উদ্যোক্তার কাছে যত লোক সেবা নিতে আসছেন, ততটা আসছেন না নারীদের কাছে। ফলে আয়বৈষম্য ব্যাপক। অনেক নারীই বলেছেন, সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া তাঁদের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর।
ইউডিসি শুমারির এই ঝরে পড়ার তথ্যের সত্যতা মেলে মাঠপর্যায়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও। এক বরগুনারই ৪৭টি ইউনিয়ন ও পৌর ডিজিটাল সেন্টারে যেসব নারী উদ্যোক্তা শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ এখন নেই। জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র নাচনাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে খাদিজা আকতার নামে একজন নারী উদ্যোক্তা আছেন।
তবে দেশের সব ইউনিয়নের চিত্র এক নয়। কোথাও কোথাও নারীরাই ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র চালাচ্ছেন।
এটুআই প্রকল্পের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুল হক বলেছেন, নারীদের ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নারীদের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
সমস্যা কোথায়: সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কম্পিউটার চালানো, কম্পোজ করতে পারা, ফরম পূরণ, ই-মেইল ও স্কাইপে কথোপকথনের যোগ্যতা যাঁদের আছে, তাঁরাই তথ্যকেন্দ্রের নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তার কাজ পান। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সুপারিশে নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের নিয়োগ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন নারী অনেক সময় পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। প্রশিক্ষণের অভাবই মূলত নারীদের টেনে ধরছে।
এটুআই সূত্র বলেছে, যোগ্যতাসম্পন্ন নারী-পুরুষ কেন্দ্র চালানোর দায়িত্ব পাবেন—এমনটিই ধরে নেওয়া হয়েছিল। নারীরা কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারেন, কাজ করতে করতে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবেন এমনটিও ভাবা হয়েছিল। প্রশিক্ষণের বিষয়টি এই কর্মসূচিতে ছিল না। তারপরও ইউনিয়ন কেন্দ্রগুলো চালুর সময় যে নারীরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা ঝরে যাওয়ার পর যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের আর সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাঁরা একটি ‘অনলাইন টিউটোরিয়াল’ করেছিলেন। কিন্তু সব জায়গায় ইন্টারনেটের গতি সন্তোষজনক না হওয়ায় অনলাইন টিউটোরিয়ালের সুবিধা তাঁরা নিতে পারছেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের একটি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে সাত মাস কাজ করেছেন—এমন এক পুরুষ উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তাঁর সহকর্মী (নারী) শুধু কম্পিউটার চালাতে ও বন্ধ করতে পারতেন। ইন্টারনেট সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। পাশের ইউনিয়নগুলোতেও একই অবস্থা। নারীদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া না যায়, তাহলে তাঁরা থাকবেন না।
এটুআইয়ের কর্মসূচি সমন্বয়ক মোহাম্মদ মাজেদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রশিক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তারাও পাবেন।
বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তাই বলেছেন, তথ্যকেন্দ্রের এ কাজটি তাঁদের জন্য যথেষ্ট লাভজনক নয়। কেন্দ্রের আয় নারী-পুরুষ দুজনের ভাগ করে নেওয়ার কথা থাকলেও আদতে তা হচ্ছে না। গত ৬ এপ্রিল রাজশাহীর হরিপুর ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে নারী উদ্যোক্তা লুৎফুন্নেসার সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে আমার আয় হাজার ছয়েক টাকা। আমার সঙ্গে শরীফুল ইসলাম কাজ করেন। আমি যা আয় করি, তা আমার আর ও যা আয় করে সেটা ওর।’ জানা গেছে, পুরুষ উদ্যোক্তারা ২০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। সেখানে নারীদের সর্বোচ্চ আয় ১০ হাজার টাকার মতো।
শেরপুর সদর উপজেলার রামেরচর গ্রামের আবদুস সোবহানের মেয়ে মুকলিমা খাতুন ছিলেন বলাইয়েরচর ইউনিয়নের তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এইচএসসি পাস করার পর আমি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ওই কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আয়রোজগার ভালো হবে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোনো সম্মানী বা ভাতা না থাকায় শুধু আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ পেশা থেকে আয় করা খুব কঠিন। বিয়ের পর তাই আর কেন্দ্রে যাইনি।’
শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, নকলা ও শ্রীবরদী উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩০টি কেন্দ্রে নারী উদ্যোক্তা আছেন। ২২টিতে নেই। যেগুলোতে আছেন, সেখানেও ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কম।
বগুড়ায় নন্দীগ্রাম ও আড়িয়ার দুই নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন মাস্টার্স শেষ করেছেন, অন্যজন পড়ছেন। দুজনই অন্য চাকরি খুঁজছেন। তাঁদের একজন বিবাহিত। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার সরকারি হবে কবে থিকে শুনতেছি। সে জন্যই অপেক্ষা করতেছি। অন্য চাকরিরও চেষ্টা করছি।’
No comments