উচ্চশিক্ষার নিম্ন যাত্রা! by সোহরাব হাসান
উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনটি নামকরা সংস্থার
তিনটি প্রতিবেদন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইমস হায়ার এডুকেশন
(টিএইচই) শিক্ষার মান, গবেষণাসহ বিভিন্ন মানদণ্ডে ২০১৫ সালে এশিয়ার যে
১০০টি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, তার কোথাও
বাংলাদেশের নাম নেই। এ তালিকায় জাপান ও চীনের প্রাধান্য রয়েছে। সেই সঙ্গে
ভারতের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ও জায়গা করে নিতে পেরেছে। সাংহাইভিত্তিক একাডেমিক
র্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি (এআরডব্লিউইউ) ২০১৩ সালে বিশ্বের
৫০০টি মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দিয়েছে, তাতেও বাংলাদেশের কোনো
বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পায়নি। এটি এশিয়ার টিএইচই নামে পরিচিত। একই সময়ে কিউএস
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি নামে আরেকটি সংস্থা ৩০০ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে
মানক্রম করেছে, তাতে বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পেয়েছে।
অথচ এই তালিকায় ভারতের ১১টি ও পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর
শীর্ষ ১০০-এর মধ্যে চীনেরই আছে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা পাকিস্তানেরও নিচে
নেমে গেলাম!
একটি দেশ কখন বড় হয়? যখন দেশটি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যায়। একটি দেশ কখন শিক্ষায় এগিয়ে যায়? যখন সেই শিক্ষা যুগের চাহিদা মেটায়, অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে এবং মানবিকবোধের বিকাশ ঘটায়। সেই শিক্ষা নতুন নতুন আবিষ্কার করে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটায় এবং তৈরি করে একটি সুদক্ষ ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠী। এর কোনো বিচারেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উত্তীর্ণ হয় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেরানি বানানো কিংবা পাকিস্তান আমলে বশংবদ আমলা তৈরির যে শিক্ষা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে তারই অন্ধ ও অক্ষম অনুকরণ চলছে। আমরা একের পর এক শিক্ষানীতি করেছি, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের জন্য যে নিষ্ঠা ও অনুশীলন দরকার, সেটি করতে আমরা প্রস্তুত নই। অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষা-সমস্যারও শর্টকাট সমাধান খুঁজছি।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাকে বলা হয় ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, যার প্রতি আমরা অমার্জনীয় অবহেলা ও উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রম, বিষয় যে দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, তিনটি সংস্থার জরিপই তার প্রমাণ।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাকিস্তান আমলে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করলেও এখন করতে পারছে না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের একাংশ পাঠ শেষ হওয়ার আগেই বিদেশে পাড়ি জমায়, আরেক অংশ পাঠ শেষ করে। আবার কেউ বিদেশ থেকে ফিরে এলেও দলীয় ও গোষ্ঠী রাজনীতির কারণে থাকতে পারেন না। কেন এমনটি হলো? একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু এই দুটো প্রতিষ্ঠানের বর্তমান হাল কী? সেখানে গবেষণায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে? একই কথা প্রযোজ্য চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ প্রথম প্রজন্মের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, শিক্ষক-প্রশাসনসহ ক্যাম্পাসের গাছপালাকে দিয়েও তাদের বন্দনা গাওয়ানো হয়। তাহলে মেধাবীরা কেন থাকবেন?
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চার জায়গা। এখানে যুক্তি, তর্ক ও গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে, পথের দিশা দেবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় রাজনীতির চর্চায় যতটা সক্রিয়, জ্ঞানচর্চায় ততটা উদাসীন। এখানে ছাত্ররাজনীতির নামে হল দখল, ক্যাম্পাস দখলের মহড়া চলে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতির কারণে কলুষিত ছিল। এখন শিক্ষকদের মধ্যেও সেই রাজনীতি ঢুকে গেছে। আগের আমলে ১০০ অমেধাবীকে জায়গা দিলে পরের আমলে ২০০ অমেধাবীকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢোকানো হয়। এখানে গবেষণার জন্য কোনো তহবিল থাকে না; অথচ বিপুল অর্থ ব্যয় করে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। কেন এসব বিভাগ, উত্তর নেই।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলছি, অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। স্বাধীনতার পর শিক্ষা নিয়ে আমরা একের পর এক পরীক্ষা করে চলেছি। কিন্তু আসল যে পরীক্ষা, অভিন্ন ধারার একটি শিক্ষাব্যবস্থা, তা গড়ে তুলতে পারিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার হয়তো ঘটছে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হয়তো গড়ে উঠেছে, কিন্তু আমরা মান ধরে রাখতে পারিনি। আমরা পরীক্ষায় পাসের হার বাড়িয়েছি; কিন্তু একটি সম্পন্ন শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি।
২...
ঢাকা শহরের নিউমার্কেট-ধানমন্ডি এলাকায় দুটি পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ঢাকা কলেজ ও বেসরকারি ঢাকা সিটি কলেজ। দুটোই রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকের পর দুটোতেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এই মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকবে।
এই যে সরকারি ও বেসরকারি ভাগাভাগি, সেটি কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? সরকার কি ধরে নিচ্ছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো লেখাপড়া হচ্ছে, সুতরাং সেগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়াই উচিত। আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান যেহেতু খারাপ, সেহেতু সেগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়াই শ্রেয়। সরকারের এই চিন্তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পুরোনো ও জটিল সমস্যার অতি সরলীকরণ সমাধান বলেই ধারণা করি। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো মনে করছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলছে। অতএব, তাদের ওপর আরও দায়িত্ব চাপানো হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনোটাই ঠিকমতো চলছে না।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সময়ের প্রয়োজনে। যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজ পর্যায়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে পারছিল না, তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়ে। এখানে দলীয় লোকদের বসানো হয়, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন বা মান ধরে রাখার চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত ছিলেন। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে একজন উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় নানা কেলেঙ্কারি ঘটান। তিনি নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করে অপ্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করতে থাকেন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তারা ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। একদা বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামীপন্থী হয়ে যান। কিন্তু যাঁদের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সুবিধা-অসুবিধার কথা কেউ ভাবেননি। একসময় তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তরপত্র গায়েব ও অমেধাবী লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তিন বছরের স্নাতক কোর্স কিংবা চার বছরের স্নাতক সম্মান কোর্স শেষ হতে যথাক্রমে পাঁচ ও ছয় বছর লেগে যেত। পরীক্ষা চলত বছরজুড়ে। বর্তমান উপাচার্য সেশনজট কমাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। এখনো দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজট চলছে। অতটা প্রকট না হলেও এই সমস্যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি আছে। সময়মতো ভর্তি, সময়মতো কোর্স শেষ করতে পারছে না কেউই।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে উচ্চশিক্ষার সমস্যাটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকা না-থাকার নয়। সমস্যাটি হলো মানের, গুণের, মেধার, চিন্তার, যা শিক্ষার কোনো স্তরেই নিশ্চিত করা যায়নি। আমরা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি। কিন্তু তাঁরা কী শিক্ষা পেলেন, এই শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কি না, সেসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা আগেও ছিল না, এখনো নেই। একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর কোর্স খোলা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। এ সমস্যা বেসরকারি-সরকারি দুটোতেই সমভাবে আছে। শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির কারণ মেধাবী শিক্ষকের অভাব। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ নেই। ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষাও হয় না। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি ভাগ করে তাৎক্ষণিক সমাধান খোঁজা তুঘলকি সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো শিক্ষানীতি, ইতিহাসের অদলবদল, পাসের হার, সৃজনশীল প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও শিক্ষার মানের প্রতি কখনোই মনোযোগ দেয়নি।
বর্তমানে উচ্চশিক্ষা (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের মতো; যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই প্রায় ২১ লাখ। এই ২১ লাখের মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে সাত লাখ। সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সাত লাখ শিক্ষার্থী একদিকে থাকবেন, ১৪ লাখ অন্যদিকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সরকারি কলেজের তুলনায় তো বটেই, খোদ ঢাকা কলেজও ফলাফলে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে পিছিয়ে আছে। একইভাবে ঢাকা নটর ডেম কলেজের কথা চিন্তা করুন। সরকারের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে সেটিও যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজটি সরকারি হওয়ার কারণে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো, লোকবল, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু কারও মাথাব্যথার অর্থ এই নয় যে মাথা কেটে ফেলতে হবে।
সরকার যখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপাতে চাইছে, তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী? কোনোটিতে উপাচার্য অপসারণের জন্য আন্দোলন চলছে, কোনোটিতে উপাচার্য-সহ-উপাচার্য দ্বন্দ্ব চরমে, কোনোটিতে ছাত্রলীগ নিজেদের মারামারিতে লিপ্ত কিংবা কোনোটিতে প্রশাসন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। অতএব, তাদের ওপর বাড়তি দায় চাপানো কতটা সমীচীন হবে, তা আরও একবার ভেবে দেখুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
hsohrab55@gmail.com
একটি দেশ কখন বড় হয়? যখন দেশটি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যায়। একটি দেশ কখন শিক্ষায় এগিয়ে যায়? যখন সেই শিক্ষা যুগের চাহিদা মেটায়, অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে এবং মানবিকবোধের বিকাশ ঘটায়। সেই শিক্ষা নতুন নতুন আবিষ্কার করে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটায় এবং তৈরি করে একটি সুদক্ষ ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠী। এর কোনো বিচারেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উত্তীর্ণ হয় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেরানি বানানো কিংবা পাকিস্তান আমলে বশংবদ আমলা তৈরির যে শিক্ষা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে তারই অন্ধ ও অক্ষম অনুকরণ চলছে। আমরা একের পর এক শিক্ষানীতি করেছি, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের জন্য যে নিষ্ঠা ও অনুশীলন দরকার, সেটি করতে আমরা প্রস্তুত নই। অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষা-সমস্যারও শর্টকাট সমাধান খুঁজছি।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাকে বলা হয় ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, যার প্রতি আমরা অমার্জনীয় অবহেলা ও উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রম, বিষয় যে দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, তিনটি সংস্থার জরিপই তার প্রমাণ।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাকিস্তান আমলে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করলেও এখন করতে পারছে না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের একাংশ পাঠ শেষ হওয়ার আগেই বিদেশে পাড়ি জমায়, আরেক অংশ পাঠ শেষ করে। আবার কেউ বিদেশ থেকে ফিরে এলেও দলীয় ও গোষ্ঠী রাজনীতির কারণে থাকতে পারেন না। কেন এমনটি হলো? একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু এই দুটো প্রতিষ্ঠানের বর্তমান হাল কী? সেখানে গবেষণায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে? একই কথা প্রযোজ্য চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ প্রথম প্রজন্মের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, শিক্ষক-প্রশাসনসহ ক্যাম্পাসের গাছপালাকে দিয়েও তাদের বন্দনা গাওয়ানো হয়। তাহলে মেধাবীরা কেন থাকবেন?
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চার জায়গা। এখানে যুক্তি, তর্ক ও গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে, পথের দিশা দেবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় রাজনীতির চর্চায় যতটা সক্রিয়, জ্ঞানচর্চায় ততটা উদাসীন। এখানে ছাত্ররাজনীতির নামে হল দখল, ক্যাম্পাস দখলের মহড়া চলে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতির কারণে কলুষিত ছিল। এখন শিক্ষকদের মধ্যেও সেই রাজনীতি ঢুকে গেছে। আগের আমলে ১০০ অমেধাবীকে জায়গা দিলে পরের আমলে ২০০ অমেধাবীকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢোকানো হয়। এখানে গবেষণার জন্য কোনো তহবিল থাকে না; অথচ বিপুল অর্থ ব্যয় করে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। কেন এসব বিভাগ, উত্তর নেই।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলছি, অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। স্বাধীনতার পর শিক্ষা নিয়ে আমরা একের পর এক পরীক্ষা করে চলেছি। কিন্তু আসল যে পরীক্ষা, অভিন্ন ধারার একটি শিক্ষাব্যবস্থা, তা গড়ে তুলতে পারিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার হয়তো ঘটছে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হয়তো গড়ে উঠেছে, কিন্তু আমরা মান ধরে রাখতে পারিনি। আমরা পরীক্ষায় পাসের হার বাড়িয়েছি; কিন্তু একটি সম্পন্ন শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি।
২...
ঢাকা শহরের নিউমার্কেট-ধানমন্ডি এলাকায় দুটি পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ঢাকা কলেজ ও বেসরকারি ঢাকা সিটি কলেজ। দুটোই রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকের পর দুটোতেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এই মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকবে।
এই যে সরকারি ও বেসরকারি ভাগাভাগি, সেটি কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? সরকার কি ধরে নিচ্ছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো লেখাপড়া হচ্ছে, সুতরাং সেগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়াই উচিত। আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান যেহেতু খারাপ, সেহেতু সেগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়াই শ্রেয়। সরকারের এই চিন্তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পুরোনো ও জটিল সমস্যার অতি সরলীকরণ সমাধান বলেই ধারণা করি। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো মনে করছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলছে। অতএব, তাদের ওপর আরও দায়িত্ব চাপানো হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনোটাই ঠিকমতো চলছে না।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সময়ের প্রয়োজনে। যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজ পর্যায়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে পারছিল না, তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়ে। এখানে দলীয় লোকদের বসানো হয়, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন বা মান ধরে রাখার চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত ছিলেন। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে একজন উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় নানা কেলেঙ্কারি ঘটান। তিনি নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করে অপ্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করতে থাকেন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তারা ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। একদা বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামীপন্থী হয়ে যান। কিন্তু যাঁদের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সুবিধা-অসুবিধার কথা কেউ ভাবেননি। একসময় তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তরপত্র গায়েব ও অমেধাবী লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তিন বছরের স্নাতক কোর্স কিংবা চার বছরের স্নাতক সম্মান কোর্স শেষ হতে যথাক্রমে পাঁচ ও ছয় বছর লেগে যেত। পরীক্ষা চলত বছরজুড়ে। বর্তমান উপাচার্য সেশনজট কমাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। এখনো দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজট চলছে। অতটা প্রকট না হলেও এই সমস্যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি আছে। সময়মতো ভর্তি, সময়মতো কোর্স শেষ করতে পারছে না কেউই।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে উচ্চশিক্ষার সমস্যাটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকা না-থাকার নয়। সমস্যাটি হলো মানের, গুণের, মেধার, চিন্তার, যা শিক্ষার কোনো স্তরেই নিশ্চিত করা যায়নি। আমরা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি। কিন্তু তাঁরা কী শিক্ষা পেলেন, এই শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কি না, সেসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা আগেও ছিল না, এখনো নেই। একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর কোর্স খোলা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। এ সমস্যা বেসরকারি-সরকারি দুটোতেই সমভাবে আছে। শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির কারণ মেধাবী শিক্ষকের অভাব। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ নেই। ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষাও হয় না। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি ভাগ করে তাৎক্ষণিক সমাধান খোঁজা তুঘলকি সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো শিক্ষানীতি, ইতিহাসের অদলবদল, পাসের হার, সৃজনশীল প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও শিক্ষার মানের প্রতি কখনোই মনোযোগ দেয়নি।
বর্তমানে উচ্চশিক্ষা (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের মতো; যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই প্রায় ২১ লাখ। এই ২১ লাখের মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে সাত লাখ। সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সাত লাখ শিক্ষার্থী একদিকে থাকবেন, ১৪ লাখ অন্যদিকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সরকারি কলেজের তুলনায় তো বটেই, খোদ ঢাকা কলেজও ফলাফলে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে পিছিয়ে আছে। একইভাবে ঢাকা নটর ডেম কলেজের কথা চিন্তা করুন। সরকারের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে সেটিও যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজটি সরকারি হওয়ার কারণে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো, লোকবল, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু কারও মাথাব্যথার অর্থ এই নয় যে মাথা কেটে ফেলতে হবে।
সরকার যখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপাতে চাইছে, তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী? কোনোটিতে উপাচার্য অপসারণের জন্য আন্দোলন চলছে, কোনোটিতে উপাচার্য-সহ-উপাচার্য দ্বন্দ্ব চরমে, কোনোটিতে ছাত্রলীগ নিজেদের মারামারিতে লিপ্ত কিংবা কোনোটিতে প্রশাসন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। অতএব, তাদের ওপর বাড়তি দায় চাপানো কতটা সমীচীন হবে, তা আরও একবার ভেবে দেখুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
hsohrab55@gmail.com
No comments