দেশ-জাতির স্বার্থেই রেলকে চাঙ্গা করা জরুরি by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
১৮২৫
সালের ২৭ সেপ্টেম্বর স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারক জর্জ স্টিফেনসন ইংল্যান্ডে
সাধারণ যাত্রীর জন্য ট্রেন চালু করেন। শুরুতেই সবাই বুঝতে পারে যে, এটি
ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহন হিসেবে গণ্য হবে। যার ফলে ১৮৩৩ সালে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেন চালু করা হয়। ইউরোপের জার্মানিতে ১৮৩৫ সালে,
ইতালিতে ১৮৩৭, ফ্রান্সে ১৮৪৪ এবং স্পেনে ১৮৪৮ সালে ট্রেন চালু হয়। এমনকি
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মুম্বাই এ ১৮৬০ সালে রেললাইন স্থাপিত হয়। বাংলায়
ট্রেন চালু করা হয় ১৮৬২ সালে। এভাবেই গোটা বিশ্বে রেল নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি
লাভ করতে থাকে। পাকিস্তানের শোষণ নীতির পরেও রেলওয়ে বিভাগ তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানে রেলওয়ের একটি মানরক্ষা করে চলত। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীন
বাংলাদেশের কিছু জননেতা রেলের মতো এহেন একটি আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী এবং অধিক
পরিমাণ যাত্রী একসঙ্গে পরিবহনের ক্ষমতাসম্পন্ন বাহনের ক্ষতিসাধন করলেন।
রেলওয়ে আজো ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি। যদিও তথাকথিত উন্নতি
দেখানোর জন্য কিছু আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে এতে সময় রক্ষার কোনো
বালাই নাই, পরিষেবার মানও নি¤œ পর্যায়ে। রেলপথকে উন্নত করার জন্য বর্তমান
প্রধানমন্ত্রী রেল মন্ত্রণালয় খুলেছেন এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের
নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এ প্রসঙ্গে চীনের নেতাদের একটি উক্তির কথা মনে পড়ে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত মি. রাজীব গান্ধী চীন সফরে গেলে আলোচনা
প্রসঙ্গে চীনের নেতা মি. দেং রাজীব গান্ধীকে বলেছিলেন, চীনের নাগরিককে তিনি
বলেছেন, তাদের প্রথমে বিশ শতকের নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তারপর
একুশ শতকের কথা। সে সময় একুশ শতকের আগমন নিয়ে খুব মাতামাতি চলছিল। চীনের
নেতাদের প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা আজ চীনকে বিশ্বের দরবারে সর্বোচ্চ স্থানে
নিয়ে গেছে। কথাটা মনে পড়ল যে প্রসঙ্গে সেটা হয়তো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ রেল বিভাগের প্রসঙ্গে এ কথা মনে পড়ল।
বঙ্গবন্ধুর পর যে সরকারগুলো ক্ষমতায় এসেছিল তারা রেলপথের উন্নতির তেমন কিছুই করেনি বরং এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। শুধু তাই নয়, একে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। পূর্বে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় ছিল। এর জন্য সংসদে পৃথক বাজেট উপস্থাপন করা হতো। পরে রেলবিভাগকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হলো। পৃথক বাজেট তো পরের কথা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী দক্ষ কর্মচারীদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বিদায় দেয়া হলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে রেলওয়ের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় চালু করলেন। রেলপথের উন্নতির জন্য তার আগ্রহের ২০ শালা পরিকল্পনা নেয়া হলো। এর অধীনে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। এই পরিকল্পনায় বড় একটা দিক হলো পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ স্থাপন করা। উল্লেখ্য, ঢাকার দক্ষিণে কোনো রেলপথ নেই। এছাড়া ট্রান্স এশিয়ার রেলপথের সঙ্গে বাংলাদেশের রেলওয়ের সংযোগ স্থাপনের কথা রয়েছে। এমন পরিকল্পনার কথা শুনে আনন্দিতই হওয়ার কথা। কিন্তু রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা চিন্তা করলে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব এ ব্যাপারে সবার মনে সন্দেহ দেখা দেয়ারই কথা। রেল দুর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি ট্রেনও চলে না অথচ এর মধ্যেই একই লাইনে দুটি গাড়ি ঢুকে পড়ছে। কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গের বগুড়া রেলস্টেশনে এ রকম ঘটনা ঘটে। একটি ট্রেনের চালকের উপস্থিত বুদ্ধির ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বা জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কয়েক সপ্তাহ আগে রাজবাড়ী স্টেশন থেকে একটি ইঞ্জিন চালক ছাড়া ২৭ কিমি. পথ অতিক্রম করে। এ একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। কত বড় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারত তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়। জানি না এটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে কিনা। বহু রেলগেট একদম খোলা এবং এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। জনবলের অভাবে এসব গেট অরক্ষিত রয়েছে। দু’বৎসরের বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে কয়েকশ’ কর্মী নিয়োগ করার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে নিয়োগ দেয়া বন্ধ করা দেয়া হয়। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে। একজন সরকারি কর্মকর্তা যার পদবি মহাপরিচালক তিনি রেল বিভাগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পদমর্যাদায় বোধহয় সরকারের সচিব। উপমহাদেশের আমলাদের অনেকেই ঐতিহ্যগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ, অদক্ষ, মন্থর এবং জনবিমুখ। ইংরেজরা শিখিয়ে দিয়েছে যে আমলারা জনগণের প্রভু, সেবক নয়। ব্রিটিশরা প্রায় সাত যুগ আগে চলে গেলেও এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতএব সরকারি অফিসের কাজকর্মের যে স্টাইল তাতে উন্নয়ন বা গণমুখী বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কাজ-কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিভিন্ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বা কর্পোরেশন গঠন করে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। আমাদের বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। নদী পথের নাব্য সংরক্ষণ এবং নৌযান চলাচলের জন্য দুটো কর্তৃপক্ষ রয়েছে যাদের নাম বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসি। বিমান চলাচলের জন্য রয়েছে বিমান কর্পোরেশন। বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। সড়ক পরিবহনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য অনেক। তারপরও ১৯৬১ সাল থেকে সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন চালু রয়েছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রেল বিভাগের জন্য রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী রেলওয়ে বোর্ড। পৃথক মন্ত্রণালয় এবং পৃথক বাজেট দুই-ই রয়েছে। আমাদের এখানেও রেলওয়ে বোর্ড ছিল। এছাড়া পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি পরামর্শ কমিটি ছিল যেখানে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সদস্য নেয়া হতো। আমাদের এখানে রেলওয়েকে একটা কর্পোরেশনে পরিণত করা হবে এমন কথা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল। ২০১৩-২০১৪ সালের বাজেট বক্তৃতায়ও এর উল্লেখ ছিল। এবারে বাজেট বক্তৃতায় কোনো উল্লেখ নাই। এখানেই সবার প্রশ্ন। আবার কি রেলপথ কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে? রেলওয়ের মতো একটি গণপরিবহনকে পঙ্গু করার সব প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। রেলপথে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে ব্যয় কম। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। যাত্রীদের মধ্যে যারা অধিক উচ্চ শ্রেণীতে ভ্রমণ করেন তাদের সুযোগ-সুবিধা ও আরাম অনেক বেশি। স্বাধীনতার পর কোথায় রেলপথ এবং রেলকে আধুনিকীকরণ করা হবে তা না করে সুপরিকল্পিতভাবে একে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে অথচ বিশ্বের সর্বত্র সড়কপথ ও আকাশপথের ব্যাপক উন্নতি হলেও রেলপথকে কিন্তু একই ধরনের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং হয়েছেও। উন্নত দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং চীনের ভেতর প্রতিযোগিতা চলে কে, কত দ্রুতগামী ট্রেন চালু করতে পারে। বেইজিং থেকে লন্ডন পর্যন্ত ট্রেন চালু করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পৃথিবীর বড় তিনটি শহর যথা লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং টোকিও শহর দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওখানে পাতাল রেলে যে পরিমাণ যাত্রী বহন করা হয়, তা যদি না করা হতো, তাহলে তিনটি শহর অচল হয়ে যেত। অবশ্য দিল্লি শহরের আকাশ এবং রেলপথেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে। ঢাকা এখনই প্রায় অচল হয়ে গেছে। কিছুদিনের ভেতর একেবারে অচল হয়ে যাবে যদি অত্যন্ত দ্রুতভাবে মেট্রোরেল চালু করা না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধ্বংসপ্রায় রেলপথকে উদ্ধার করার জন্য রেল মন্ত্রণালয় চালু করেছেন। তারই উৎসাহে রেলকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না যদি রেলওয়ের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো না বদলানো হয়। আমরা প্রত্যাশা করব যে, সরকার এই অচলায়তন ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে। লেখাটি শেষ করার আগে আবারো চীনের নেতা দেং কে স্মরণ করতে চাই। রেল বিভাগের ভিতকে মজবুত করতে হবে যেন উন্নয়ন প্রকল্পের ভার বহন করতে সক্ষম হয়। রেল বিভাগের দায়িত্বশীলদের সেই শক্তি ও মানসিকতা অর্জন করতে হবে।
লেখক: সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট। ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও বীমাখাত বিশ্লেষক
বঙ্গবন্ধুর পর যে সরকারগুলো ক্ষমতায় এসেছিল তারা রেলপথের উন্নতির তেমন কিছুই করেনি বরং এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। শুধু তাই নয়, একে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। পূর্বে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় ছিল। এর জন্য সংসদে পৃথক বাজেট উপস্থাপন করা হতো। পরে রেলবিভাগকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হলো। পৃথক বাজেট তো পরের কথা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী দক্ষ কর্মচারীদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বিদায় দেয়া হলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে রেলওয়ের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় চালু করলেন। রেলপথের উন্নতির জন্য তার আগ্রহের ২০ শালা পরিকল্পনা নেয়া হলো। এর অধীনে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। এই পরিকল্পনায় বড় একটা দিক হলো পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ স্থাপন করা। উল্লেখ্য, ঢাকার দক্ষিণে কোনো রেলপথ নেই। এছাড়া ট্রান্স এশিয়ার রেলপথের সঙ্গে বাংলাদেশের রেলওয়ের সংযোগ স্থাপনের কথা রয়েছে। এমন পরিকল্পনার কথা শুনে আনন্দিতই হওয়ার কথা। কিন্তু রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা চিন্তা করলে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব এ ব্যাপারে সবার মনে সন্দেহ দেখা দেয়ারই কথা। রেল দুর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি ট্রেনও চলে না অথচ এর মধ্যেই একই লাইনে দুটি গাড়ি ঢুকে পড়ছে। কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গের বগুড়া রেলস্টেশনে এ রকম ঘটনা ঘটে। একটি ট্রেনের চালকের উপস্থিত বুদ্ধির ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বা জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কয়েক সপ্তাহ আগে রাজবাড়ী স্টেশন থেকে একটি ইঞ্জিন চালক ছাড়া ২৭ কিমি. পথ অতিক্রম করে। এ একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। কত বড় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারত তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়। জানি না এটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে কিনা। বহু রেলগেট একদম খোলা এবং এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। জনবলের অভাবে এসব গেট অরক্ষিত রয়েছে। দু’বৎসরের বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে কয়েকশ’ কর্মী নিয়োগ করার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে নিয়োগ দেয়া বন্ধ করা দেয়া হয়। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে। একজন সরকারি কর্মকর্তা যার পদবি মহাপরিচালক তিনি রেল বিভাগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পদমর্যাদায় বোধহয় সরকারের সচিব। উপমহাদেশের আমলাদের অনেকেই ঐতিহ্যগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ, অদক্ষ, মন্থর এবং জনবিমুখ। ইংরেজরা শিখিয়ে দিয়েছে যে আমলারা জনগণের প্রভু, সেবক নয়। ব্রিটিশরা প্রায় সাত যুগ আগে চলে গেলেও এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতএব সরকারি অফিসের কাজকর্মের যে স্টাইল তাতে উন্নয়ন বা গণমুখী বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কাজ-কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিভিন্ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বা কর্পোরেশন গঠন করে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। আমাদের বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। নদী পথের নাব্য সংরক্ষণ এবং নৌযান চলাচলের জন্য দুটো কর্তৃপক্ষ রয়েছে যাদের নাম বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসি। বিমান চলাচলের জন্য রয়েছে বিমান কর্পোরেশন। বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। সড়ক পরিবহনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য অনেক। তারপরও ১৯৬১ সাল থেকে সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন চালু রয়েছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রেল বিভাগের জন্য রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী রেলওয়ে বোর্ড। পৃথক মন্ত্রণালয় এবং পৃথক বাজেট দুই-ই রয়েছে। আমাদের এখানেও রেলওয়ে বোর্ড ছিল। এছাড়া পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি পরামর্শ কমিটি ছিল যেখানে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সদস্য নেয়া হতো। আমাদের এখানে রেলওয়েকে একটা কর্পোরেশনে পরিণত করা হবে এমন কথা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল। ২০১৩-২০১৪ সালের বাজেট বক্তৃতায়ও এর উল্লেখ ছিল। এবারে বাজেট বক্তৃতায় কোনো উল্লেখ নাই। এখানেই সবার প্রশ্ন। আবার কি রেলপথ কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে? রেলওয়ের মতো একটি গণপরিবহনকে পঙ্গু করার সব প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। রেলপথে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে ব্যয় কম। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। যাত্রীদের মধ্যে যারা অধিক উচ্চ শ্রেণীতে ভ্রমণ করেন তাদের সুযোগ-সুবিধা ও আরাম অনেক বেশি। স্বাধীনতার পর কোথায় রেলপথ এবং রেলকে আধুনিকীকরণ করা হবে তা না করে সুপরিকল্পিতভাবে একে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে অথচ বিশ্বের সর্বত্র সড়কপথ ও আকাশপথের ব্যাপক উন্নতি হলেও রেলপথকে কিন্তু একই ধরনের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং হয়েছেও। উন্নত দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং চীনের ভেতর প্রতিযোগিতা চলে কে, কত দ্রুতগামী ট্রেন চালু করতে পারে। বেইজিং থেকে লন্ডন পর্যন্ত ট্রেন চালু করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পৃথিবীর বড় তিনটি শহর যথা লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং টোকিও শহর দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওখানে পাতাল রেলে যে পরিমাণ যাত্রী বহন করা হয়, তা যদি না করা হতো, তাহলে তিনটি শহর অচল হয়ে যেত। অবশ্য দিল্লি শহরের আকাশ এবং রেলপথেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে। ঢাকা এখনই প্রায় অচল হয়ে গেছে। কিছুদিনের ভেতর একেবারে অচল হয়ে যাবে যদি অত্যন্ত দ্রুতভাবে মেট্রোরেল চালু করা না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধ্বংসপ্রায় রেলপথকে উদ্ধার করার জন্য রেল মন্ত্রণালয় চালু করেছেন। তারই উৎসাহে রেলকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না যদি রেলওয়ের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো না বদলানো হয়। আমরা প্রত্যাশা করব যে, সরকার এই অচলায়তন ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে। লেখাটি শেষ করার আগে আবারো চীনের নেতা দেং কে স্মরণ করতে চাই। রেল বিভাগের ভিতকে মজবুত করতে হবে যেন উন্নয়ন প্রকল্পের ভার বহন করতে সক্ষম হয়। রেল বিভাগের দায়িত্বশীলদের সেই শক্তি ও মানসিকতা অর্জন করতে হবে।
লেখক: সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট। ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও বীমাখাত বিশ্লেষক
No comments