ফাঁড়া কাটলেও ফাঁস নামেনি
গ্রিসের ঋণ সংকটে দাতাদের আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইল আউট) প্রস্তাবের শর্ত মানা হবে না- তা সাফ জানিয়ে দিয়েছে দেশটির জনগণ। রোববারের গণভোটে চূড়ান্ত ফলে গ্রিসকে দাতাশক্তিদের আষ্টেপৃষ্টে বাঁধার ফন্দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গ্রিক ভোটার। এর ফলে প্রাথমিকভাবে ইউরোপের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী তিন মোড়লের সঙ্গে দর কষাকষিতে অতিরিক্ত শক্তি অর্জন করলেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাস। ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপিয়ে দেয়া নীতিকে প্রত্যাখ্যানের অধিকতর সুযোগ পেলেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে গ্রিসকে চুষে খাওয়ার যে পাঁয়তারা ত্রয়ীদাতাশক্তি নিয়েছিল, তা এখন সহজেই বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ ফাঁড়া (বিপদ) থেকে বের হতে পারল এথেন্স। কিন্তু ইউরোপের সঙ্গে আপসটা কীভাবে হবে- তা নির্ধারণের আগেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে গ্রিক অর্থনীতি। গ্রিসের ব্যাংকগুলো মারাত্মক তারল্য সংকটে ভুগছে। আমদানি-রফতানি বন্ধ। এ অবস্থায় ইসিবির জরুরি অর্থ সাহায্য ছাড়া ব্যাংকগুলোকে সচল রাখা গ্রিসের পক্ষে বলতে গেলে অসম্ভব। ইউরোজোন থেকে ছিটকে পড়ার যে ফাঁস গলায় ঝুলে রয়েছে, তা এখনও খুলে ফেলা যায়নি। আজ (মঙ্গলবার) ইইউ অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে তার একটা গতিপথ পরিষ্কার হতে পারে। বিবিসি এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহ ধরে গ্রিসের ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) ব্যাংক খুলে দেয়ার কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অব গ্রিসের সঙ্গে অন্যান্য ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয়ার অপেক্ষায় ব্যাংকের সেবা কতটা উন্মুক্ত হবে। ব্যাংকগুলোর ঘাড়ে উৎকণ্ঠার তরবারি ঝুলছে। খোলার পরপরই সব শাখা ক্যাশশূন্য হয়ে পড়বে। এখন সেখানে জরুরি অর্থ সহায়তা দেবে কিনা- তা ইসিবির সিদ্ধান্তের বিষয়। এখন গ্রিস যেটা পারে সেটা হচ্ছে, ইউরো ছেড়ে নিজস্ব মুদ্রায় ফিরে যাওয়া। সেটা হোক আগের ড্রাকমা কিংবা নতুন কোনো মুদ্রা। কিন্তু তাতেও বিরাট ক্ষতি। নতুন মুদ্রা প্রচলনের আগেই ব্যাংকের ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাবে।
তাতে পুরো অর্থনীতি ধসে পড়বে। ব্যাংকাররা বিবিসি সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, নতুন মুদ্রা চালু পর্যন্ত ক্রান্তিকাল পার হতে গেলেও ইউরোজোনের কাছ থেকে গ্রিস ব্যাংকগুলোর অন্তত ২৫ বিলিয়ন ইউরো ক্যাশ মুদ্রা প্রয়োজন। এছাড়া ড্রাকমা চালু হলে গ্রিকদের সঞ্চিত অর্থের মূল্যমানও কমে যাবে। আবার গ্রিসের কাছে বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভ নেই বললেই চলে। বড়জোর ২-৩ বিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। সেক্ষেত্রে জরুরি পণ্য, কাঁচামাল, খাদ্য, ওষুধ শেষ হয়ে গেলে নতুন করে আমদানি করতে পারবে না। কারণ বিদেশী ব্যবসায়ীরা গ্রিসের নিজস্ব মুদ্রায় বেচাকেনা করবে না। গ্রিস জিনিস কিনে তার দাম ড্রাকমায় পরিশোধ করতে গেলে তা খুব হাস্যকর হবে। রফতানি আয় দিয়েও পাওনা পরিশোধ করা যাবে না। কেননা, দেশটির রফতানি আয় জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে ইউরো ছাড়লে বিপদেই পড়বে গ্রিস। এদিকে, গ্রিসকে ইউরোজোনে রাখবে কি রাখবে না তা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতদিন ধরে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্যাসেলস হুশিয়ারি করে এসেছে, ‘না’ ভোট দিলে গ্রিসকে ইউরো মুদ্রা ছেড়ে ড্রাকমায় ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ইউরোজোন ক্লাব থেকে গ্রিসকে বের করে দিয়ে লাভটা কী হবে? এতে একদিকে যেমন ইউরোপের ঐক্য বিনষ্ট হবে, আরকেদিকে দাতারা যে অর্থ দিয়েছে, সে অর্থ তবে ফেরত পাওয়া যাবে না। এতে জার্মানির বেশি ক্ষতি। আর ইসিবি এথেন্সের কাছ থেকে যে বন্ধকী সম্পত্তি নিয়ে রেখেছে (যা ৮৯ বিলিয়ন জরুরি অর্থ সহায়তার ৩৫ শতাংশ মূল্যমানের), গ্রিস ইউরো ছাড়লে ওই বন্ধকী সম্পত্তির মূল্যমান প্রায় অর্ধেক কমে যাবে। আর সেকারণেই না ভোটের বিরুদ্ধে ‘প্রকৃত প্রতিশোধ’ ইইউ নিতে পারবে না বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। ব্রাসেলসের ব্রুজেল থিংক ট্যাংকের গবেষক নিকোলাস ভারন বলেন, ‘ইইউ সদস্যরা গ্রিসকে আরেকটি সুযোগ দেবে। কিন্তু হাতে সময় খুব কম। আর সেটাই হতে পারে সর্বশেষ সুযোগ।’
No comments