প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ- অভিযোগ গুরুতর, তদন্ত হবে কী?
কাবিখা ও কাবিটা তথা কাজের বিনিময়ে খাদ্য অথবা টাকা কর্মসূচি এখন তছরুপ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। প্রায় সব সরকারের আমলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃণমূল পর্যায়ে নেওয়া উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে থাকে। সোমবারের প্রথম আলোয় দোহার-নবাবগঞ্জে কাজ না করে রাস্তার টাকা আত্মসাতের খবরে উঠে এসেছে সংরক্ষিত আসনের সাংসদ পিনু খানের নাম। কাগজে-কলমে রাস্তা নির্মিত হয়েছে দেখানো হলেও বাস্তবে সেখানে বিরাজ করছে ধানখেত। এটি বিরল ঘটনা নয়, বরং উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ আত্মসাতের ডুবোপাহাড়ের ভাসমান চূড়া এটি।
২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাবিখা ও কাবিটা কর্মসূচির অর্থে চারটি সড়কের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ না হলেও সব টাকা তুলে নিয়ে গেছেন সাংসদ পিনু খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকেরা। বরাদ্দের ১৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন গম নির্ধারিত কাজে ব্যয় না করে তিনি কী করেছেন, তা জানা দরকার। পিনু খান একাধারে আওয়ামী লীগের সাংসদ ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং তিনি কোনো অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে এর দায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল—উভয়ের ওপরই বর্তায়। পিনু খানের পুত্র নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দুই শ্রমজীবীকে হত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি। সপরিবারে এত দুর্নীতি ও অনাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, কী করে তিনি সাংসদ ও দলের পদে বহাল থাকছেন? পিনু খানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন।
কাবিখা ও কাবিটার প্রচলন হয়েছিল তৃণমূলে একই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে। কিন্তু দেখা যায় এটাই হয়ে উঠেছে সাংসদ থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং তৃণমূল প্রশাসনের দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে যে প্রান্তিক মানুষের জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি, তা থেকে তাঁরা যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি ব্যাহত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নও।
২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাবিখা ও কাবিটা কর্মসূচির অর্থে চারটি সড়কের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ না হলেও সব টাকা তুলে নিয়ে গেছেন সাংসদ পিনু খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকেরা। বরাদ্দের ১৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন গম নির্ধারিত কাজে ব্যয় না করে তিনি কী করেছেন, তা জানা দরকার। পিনু খান একাধারে আওয়ামী লীগের সাংসদ ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং তিনি কোনো অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে এর দায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল—উভয়ের ওপরই বর্তায়। পিনু খানের পুত্র নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দুই শ্রমজীবীকে হত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি। সপরিবারে এত দুর্নীতি ও অনাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, কী করে তিনি সাংসদ ও দলের পদে বহাল থাকছেন? পিনু খানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন।
কাবিখা ও কাবিটার প্রচলন হয়েছিল তৃণমূলে একই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে। কিন্তু দেখা যায় এটাই হয়ে উঠেছে সাংসদ থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং তৃণমূল প্রশাসনের দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে যে প্রান্তিক মানুষের জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি, তা থেকে তাঁরা যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি ব্যাহত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নও।
কাজ না করে রাস্তার টাকা আত্মসাৎ by নজরুল ইসলাম ও ইকবাল হোসেন
সরকারি কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে ইটের রাস্তা। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেল পুরোটাই খেত। ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জে এ রকম আরও একটি সড়ক রয়েছে, যা শুধুই কাগজে-কলমে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির টাকায় দুটি নতুন সড়কসহ মোট চারটি সড়কের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কাজ করা হয়নি। সব টাকাই তুলে নিয়ে গেছেন স্থানীয় সাংসদ পিনু খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা।
মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি আলোচিত হয়েছেন জোড়া খুনের ঘটনায়। তাঁর ছেলে বখতিয়ার আলম রনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে গুলি করে দুই শ্রমজীবী মানুষকে খুন করেছেন। মামলা তদন্তে তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। সাংসদ নিজেও সন্তানকে ছাড়িয়ে নিতে বিভিন্ন মহলে চেষ্টা-তদবিরও করছেন।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সাংসদ পিনু খান গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের সব কাজই তো হয়েছে। আর এ কাজ দেখার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আছেন। অতিবৃষ্টিতে রাস্তা কাদা হয়ে যাওয়ায় এমন অভিযোগ উঠতে পারে। পিনু খান তাঁর সন্তানকে বাঁচাতে প্রভাব খাটানোর কথাও অস্বীকার করে বলেন, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন তার গতিতে চলছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, সংরক্ষিত মহিলা আসন-২৩-এর সাংসদ (দোহার-নবাবগঞ্জের দায়িত্ব) পিনু খান গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারকাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা ও কাবিটা) আওতায় ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জে চারটি রাস্তা নির্মাণ, সংস্কার ও দুটি সোলার প্যানেল স্থাপনে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ পান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তা নির্মাণ-সংস্কার এবং সোলার প্যানেল বসানোর পুরো টাকা তুললেও কোনো কাজ করা হয়নি। এর মধ্যে দোহারে সড়কের কাজ গত বছরের ৩০ জুন এবং নবাবগঞ্জের সড়কের কাজ চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
২০১৪ সালের জুনে দোহারের উত্তর জয়পাড়ায় হাকিমের বাড়ির মাথা থেকে হরমুজ আলী এবং মতি মোল্লার জমি থেকে চকের রাস্তা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সাংসদ পিনু খান ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ পান। গত ২১ জুন দোহারের উত্তর জয়পাড়া এলাকায় গিয়ে কোনো রাস্তা দেখা যায়ানি। নিচু জায়গায় ধঞ্চেগাছ, বড় বড় ঘাস ও আগাছা জন্মেছে। অথচ প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী সেখানে গাড়ি চলার উপযোগী এক নম্বর ইটের সলিং করা ২০ ফুট চওড়া রাস্তা করার কথা। এই রাস্তার ভাঙন রোধে নিরাপত্তা দেয়াল তৈরিরও কথা ছিল।
উত্তর জয়পাড়ার মোশারফ হোসেন বলেন, কাজ না করেই পিনু খান ও তাঁর লোকজন বিল তুলেছেন। তাঁর জমির ওপর দিয়ে কথিত রাস্তা দেখিয়ে টাকা তুলে মেরে দিয়েছেন তাঁরা।
এর পাশেই দোহারের উত্তর জয়পাড়ায় খুদি মুনশি ও বাদশার বাড়ি থেকে মহিউদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে ২০১৪ সালের জুনে পিনু খানের অনুকূলে কাবিখার আওতায় রাস্তা নির্মাণে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাগজপত্রে সেখানে ইটের সলিং করে ২০ ফুট রাস্তা থাকার কথা। এ ছাড়া গজারি কাঠ ও ড্রামশিট গেঁথে রাস্তা রক্ষাকারী দেয়াল নির্মাণের শর্ত ছিল। কিন্তু সরেজমিনে রাস্তায় ইট ফেলার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাস্তাটির প্রস্থ ছয় ফুটের মতো। সেখানে দু-একটি বাঁশ ও কড়ইগাছের ডাল দিয়ে নামমাত্র নিরাপত্তা প্রাচীর করা হলেও বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা ভেঙে গেছে। ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল দূরের কথা, একসঙ্গে কয়েকজন হেঁটে চলাও কষ্টকর।
স্থানীয় বাসিন্দা হৃদয় হোসেন বলেন, ইটের সলিং করা তো দূরের কথা, এখানে অল্প কিছু বালু ফেলা হয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা দিয়ে চলাচলের অবস্থা থাকে না। বর্ষায় রাস্তা হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ পিনু খান ও দোহার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান ঢাকা জেলার ভাইস চেয়ারম্যান) আনারকলি ওরফে পুতুল কাজ না করে এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে দুটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন দোহার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আলমাছ উদ্দিন। তিনি দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এই নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দোহার উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনারকলি ওরফে পুতুলের অনুরোধে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে তাঁকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি করা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আসলে আমার কিছুই করার ছিল না। কাজ করার শর্তেই তাঁকে টাকা তোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।’
অভিযোগের বিষয়ে আনারকলি দাবি করেন, বছর দেড়েক আগে উত্তর জয়পাড়ায় দুটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে তা ধুয়ে গেছে। ইটের সলিং করে রাস্তা করার কথা ছিল না। কিন্তু পিআইও কাজে ইটের সলিংয়ের রাস্তা করার শর্ত জুড়ে দেন।
দোহার উপজেলার পিআইও মো. হাবীব উল্লাহ মিঞা বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন আগে সংসদ পিনু খানের প্রভাব খাঁটিয়ে তাঁর লোকজন বিল তুলে নেন। প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পিনু খানের লোকজন।
সরেজমিন নবাবগঞ্জের চার প্রকল্প: নবাবগঞ্জের ঝনঝনিয়া কবরস্থান থেকে শোল্লা ভবেশের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে সাংসদ পিনু খানের অনুকূলে কাবিখা কর্মসূচির আওতায় ২০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর বাজারমূল্য চার লাখ টাকা। তবে সেখানে কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ খেত। এই জমিতে ধান চাষ করা হয়।
নবাবগঞ্জের শোল্লার নকুমুদ্দিনের বাড়ি থেকে বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে কাবিখার আওতায় গত ২৫ মে পিনু খানের অনুকূলে ২০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানেও দেখা গেল এক কিলোমিটার দীর্ঘ কাঁচা রাস্তায় বেশির ভাগ অংশ খানাখন্দে ভরা।
পশ্চিম শোল্লার জামে মসজিদ, বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঝনঝনিয়া কালীমন্দিরে সোলার প্যানেল নির্মাণে গত ২৫ মে পিনু খানের অনুকূলে কাবিখার আওতায় ১০ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ঝনঝনিয়ায় গিয়ে কালীমন্দির খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাসিন্দা রতন সরকারের বাড়িতে একটি লক্ষ্মীমন্দিরের খোঁজ মেলে। তবে বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কিছুদিন আগে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে।
দক্ষিণ শোল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সোলার প্যানেল স্থাপনে পিনু খানের নামে কাবিটার আওতায় দুই লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহির উদ্দিন জানান, রোজার আগে স্কুলে সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা শুনেছেন, কিন্তু এখনো স্থাপন করা হয়নি।
কাজ না করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হাবীবউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ হয়েছে কি না, তা তদারক করতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। তা ছাড়া এমপি যেভাবে চান, সেভাবেই আমাদের চলতে হয়।’
নবাবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিবুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ পিনু খান তাঁর প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন কি না, সে বিষয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করা হবে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির টাকায় দুটি নতুন সড়কসহ মোট চারটি সড়কের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কাজ করা হয়নি। সব টাকাই তুলে নিয়ে গেছেন স্থানীয় সাংসদ পিনু খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা।
মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি আলোচিত হয়েছেন জোড়া খুনের ঘটনায়। তাঁর ছেলে বখতিয়ার আলম রনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে গুলি করে দুই শ্রমজীবী মানুষকে খুন করেছেন। মামলা তদন্তে তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। সাংসদ নিজেও সন্তানকে ছাড়িয়ে নিতে বিভিন্ন মহলে চেষ্টা-তদবিরও করছেন।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সাংসদ পিনু খান গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের সব কাজই তো হয়েছে। আর এ কাজ দেখার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আছেন। অতিবৃষ্টিতে রাস্তা কাদা হয়ে যাওয়ায় এমন অভিযোগ উঠতে পারে। পিনু খান তাঁর সন্তানকে বাঁচাতে প্রভাব খাটানোর কথাও অস্বীকার করে বলেন, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন তার গতিতে চলছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, সংরক্ষিত মহিলা আসন-২৩-এর সাংসদ (দোহার-নবাবগঞ্জের দায়িত্ব) পিনু খান গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারকাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা ও কাবিটা) আওতায় ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জে চারটি রাস্তা নির্মাণ, সংস্কার ও দুটি সোলার প্যানেল স্থাপনে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ পান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তা নির্মাণ-সংস্কার এবং সোলার প্যানেল বসানোর পুরো টাকা তুললেও কোনো কাজ করা হয়নি। এর মধ্যে দোহারে সড়কের কাজ গত বছরের ৩০ জুন এবং নবাবগঞ্জের সড়কের কাজ চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
২০১৪ সালের জুনে দোহারের উত্তর জয়পাড়ায় হাকিমের বাড়ির মাথা থেকে হরমুজ আলী এবং মতি মোল্লার জমি থেকে চকের রাস্তা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সাংসদ পিনু খান ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ পান। গত ২১ জুন দোহারের উত্তর জয়পাড়া এলাকায় গিয়ে কোনো রাস্তা দেখা যায়ানি। নিচু জায়গায় ধঞ্চেগাছ, বড় বড় ঘাস ও আগাছা জন্মেছে। অথচ প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী সেখানে গাড়ি চলার উপযোগী এক নম্বর ইটের সলিং করা ২০ ফুট চওড়া রাস্তা করার কথা। এই রাস্তার ভাঙন রোধে নিরাপত্তা দেয়াল তৈরিরও কথা ছিল।
উত্তর জয়পাড়ার মোশারফ হোসেন বলেন, কাজ না করেই পিনু খান ও তাঁর লোকজন বিল তুলেছেন। তাঁর জমির ওপর দিয়ে কথিত রাস্তা দেখিয়ে টাকা তুলে মেরে দিয়েছেন তাঁরা।
এর পাশেই দোহারের উত্তর জয়পাড়ায় খুদি মুনশি ও বাদশার বাড়ি থেকে মহিউদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে ২০১৪ সালের জুনে পিনু খানের অনুকূলে কাবিখার আওতায় রাস্তা নির্মাণে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাগজপত্রে সেখানে ইটের সলিং করে ২০ ফুট রাস্তা থাকার কথা। এ ছাড়া গজারি কাঠ ও ড্রামশিট গেঁথে রাস্তা রক্ষাকারী দেয়াল নির্মাণের শর্ত ছিল। কিন্তু সরেজমিনে রাস্তায় ইট ফেলার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাস্তাটির প্রস্থ ছয় ফুটের মতো। সেখানে দু-একটি বাঁশ ও কড়ইগাছের ডাল দিয়ে নামমাত্র নিরাপত্তা প্রাচীর করা হলেও বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা ভেঙে গেছে। ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল দূরের কথা, একসঙ্গে কয়েকজন হেঁটে চলাও কষ্টকর।
স্থানীয় বাসিন্দা হৃদয় হোসেন বলেন, ইটের সলিং করা তো দূরের কথা, এখানে অল্প কিছু বালু ফেলা হয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা দিয়ে চলাচলের অবস্থা থাকে না। বর্ষায় রাস্তা হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ পিনু খান ও দোহার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান ঢাকা জেলার ভাইস চেয়ারম্যান) আনারকলি ওরফে পুতুল কাজ না করে এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে দুটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন দোহার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আলমাছ উদ্দিন। তিনি দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এই নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দোহার উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনারকলি ওরফে পুতুলের অনুরোধে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে তাঁকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি করা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আসলে আমার কিছুই করার ছিল না। কাজ করার শর্তেই তাঁকে টাকা তোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।’
অভিযোগের বিষয়ে আনারকলি দাবি করেন, বছর দেড়েক আগে উত্তর জয়পাড়ায় দুটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে তা ধুয়ে গেছে। ইটের সলিং করে রাস্তা করার কথা ছিল না। কিন্তু পিআইও কাজে ইটের সলিংয়ের রাস্তা করার শর্ত জুড়ে দেন।
দোহার উপজেলার পিআইও মো. হাবীব উল্লাহ মিঞা বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন আগে সংসদ পিনু খানের প্রভাব খাঁটিয়ে তাঁর লোকজন বিল তুলে নেন। প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পিনু খানের লোকজন।
সরেজমিন নবাবগঞ্জের চার প্রকল্প: নবাবগঞ্জের ঝনঝনিয়া কবরস্থান থেকে শোল্লা ভবেশের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে সাংসদ পিনু খানের অনুকূলে কাবিখা কর্মসূচির আওতায় ২০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর বাজারমূল্য চার লাখ টাকা। তবে সেখানে কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ খেত। এই জমিতে ধান চাষ করা হয়।
নবাবগঞ্জের শোল্লার নকুমুদ্দিনের বাড়ি থেকে বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে কাবিখার আওতায় গত ২৫ মে পিনু খানের অনুকূলে ২০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানেও দেখা গেল এক কিলোমিটার দীর্ঘ কাঁচা রাস্তায় বেশির ভাগ অংশ খানাখন্দে ভরা।
পশ্চিম শোল্লার জামে মসজিদ, বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঝনঝনিয়া কালীমন্দিরে সোলার প্যানেল নির্মাণে গত ২৫ মে পিনু খানের অনুকূলে কাবিখার আওতায় ১০ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ঝনঝনিয়ায় গিয়ে কালীমন্দির খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাসিন্দা রতন সরকারের বাড়িতে একটি লক্ষ্মীমন্দিরের খোঁজ মেলে। তবে বোয়ালি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কিছুদিন আগে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে।
দক্ষিণ শোল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সোলার প্যানেল স্থাপনে পিনু খানের নামে কাবিটার আওতায় দুই লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহির উদ্দিন জানান, রোজার আগে স্কুলে সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা শুনেছেন, কিন্তু এখনো স্থাপন করা হয়নি।
কাজ না করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হাবীবউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ হয়েছে কি না, তা তদারক করতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। তা ছাড়া এমপি যেভাবে চান, সেভাবেই আমাদের চলতে হয়।’
নবাবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিবুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ পিনু খান তাঁর প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন কি না, সে বিষয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করা হবে।
No comments