প্রজন্ম চত্বরের মহা সমাবেশের ঘোষণা ॥ রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ
জনতার ঢলে মহাসমুদ্রে পরিণত হয় শাহবাগের
স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি
কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত লাখ-লাখ মানুষ হাত তুলে শপথ নিল রাজপথে থেকে লড়াই
সংগ্রাম চালিয়ে যাবার।
প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনীত হলো ‘রাজপথ ছাড়বো না’। সমস্বরে উচ্চারিত হয়েছে- স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ও
ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াত-শিবিরের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে সরকারীভাবে পরিচালনার দাবি ওঠে সমাবেশ থেকে। জামায়াত-শিবিরসহ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরি করে তাদের আগামী নির্বাচনে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন লাখ-লাখ মানুষ। সংগ্রাম-আমারদেশ-নয়াদিগন্ত-দিগন্ত টেলিভিশন বর্জনসহ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে বর্জনে একমত পোষণ করেছেন সকলেই। বলা হয়, ’৭৫-পরবর্তী যেসব স্বাধীনতাবিরোধীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে আইন পরিবর্তন করে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবি ওঠে শাহবাগ থেকে।
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে লাখ-লাখ মানুষ শাহবাগ স্কয়ারের দিকে আসতে থাকে। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সমাজ, সংস্কৃতি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে এখানে। ঢাকার বাইরে থেকে আসতে থাকে হাজারো মানুষ। প্রতিবাদী সেøøাগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। সমাবেশ চলাকালে প্রতিবাদী এক যুবক গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া সমাবেশ চলে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত। এরপরও জনতার ঢল থামেনি। রাতে মশাল জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানান সকলেই।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভের সূচনা করে ব্লগার ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। এরপর রাতেই তা পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো মহাসমাবেশ।
এ অবিশ্বাস্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করানো কঠিন। কোন রাজনৈতিক দলের আহ্বান ছাড়া এত বড় আন্দোলন, এত মানুষের জমায়েত হতে পারে তা ভাবাই যায় না।
ফাঁসি চাই- ফাঁসি চাই ॥ ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ সেøাগানে রাত-দিন উত্তাল শাহবাগ। মুহুর্মুহু সেøøাগানে পুরো প্রকম্পিত রাজপথ। সেøাগানের গর্জন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। মহাসমাবেশে লাখ-লাখ জনতা সমস্বরে উচ্চারণ করেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। সমাবেশে যোগ দিতে কেউ ঝাড়ু, কেউ ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই, রাজপথ ছাড়ব না’ প্ল্যাকার্ড, কেউবা ‘সব রাজাকারের ফাঁসি চাই’ ধরনের হাজারো সেøøাগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হন।
রাজাকারদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার আহ্বান ॥ মহাসমাবেশ থেকে নতুন নতুন দাবি ওঠেছে অনেক। এর মধ্যে আগত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা জামায়াত-শিবিরসহ সকল রাজাকারের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান। পাশাপাশি দেশবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত থাকা, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তসহ গৃহযুদ্ধের হুমকির অপরাধে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানানো হয়। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষ এ দাবি জানান। তাদের সকলের বক্তব্য-যারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না তাদের এদেশে থাকার কোন অধিকার নেই। তেমনি ভোট দেয়ারও অধিকার নেই। প্রয়োজনে সকলে মিলে তাদের সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিতে হবে। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথ ভাঙা শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। আগামী নির্বাচনের আগেই রাজাকারসহ জামায়াত-শিবির কর্মীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ না দিতে বিকল্প আন্দোলনের হুমকি দেন তারা।
বর্জনের আহ্বান ॥ জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত সকল প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে জাতীয়করণ করার দাবি উঠেছে মহাসমাবেশ থেকে। মহাসমাবেশে নেতৃবৃন্দসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের পক্ষ থেকে দাবি জানিয়ে বলা হয়- ইসলামী ব্যাংককে জাতীয়করণের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে আলাদা করতে হবে। একই সঙ্গে জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত দিগন্ত টিভিকে সমাবেশস্থল থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে দিগন্ত টিভি না দেখার অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন এ্যাকাউন্ট না খোলা এবং পুরান এ্যাকাউন্ট থেকে আমানত তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও জামায়াত এবং শিবির পরিচালিত নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম পত্রিকা, রোটিনা কোচিং সেন্টার, ইবনেসিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মাসিটিক্যালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। আমারদেশ পত্রিকা বর্জনেরও আহ্বান জানানো হয় সমাবেশ থেকে। এছাড়াও আল জাজিরা, বিবিসি, এএফপিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সমাবেশ থেকে সতর্ক করে বলা হয়, আপনারা সাবধান হয়ে যান। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করুন। আমাদের আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অনেক সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে-ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু হয়েছে।
প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের আহ্বান ॥ ’৭১-এর ঘাতক জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মোঃ কামারুজ্জামানের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছে সমাবেশ থেকে। একই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংবাদমাধ্যমের সকল ক্ষেত্র থেকে জামায়াত-শিবিরের সদস্যদের বর্জন করার মধ্য দিয়ে নতুন আন্দোলনের আহ্বান জানান তাঁরা। পাশাপাশি সামাজিকভাবে জামায়াত-শিবিরসহ সকল যুদ্ধাপরাধীকে বয়কটের আহ্বান সকলের। সমাবেশে বক্তারা সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের আপনারা প্রশ্রয় দেবেন না। অবিলম্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিল করুন। ’৭১-এর ঘাতকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানের সদস্য থাকতে পারে না।
ফ্রি চিকিৎসা সেবা ॥ শাহবাগ মোড়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সংহতি জানাতে জড়ো হওয়া জমায়াতে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের পরিচালনা করছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। তাৎক্ষণিকভাবে সমাবেশে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যবস্থা করা হয়েছে বিনামূল্যে ওষুধেরও। সমাবেশে ফ্রি চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত আছেন সংগঠনের সদস্য ডা. জাকির হোসেন, ডা. মামুন হোসেন, ডা. অজিত রায় ও ডা. নিতাই রায় চৌধুরী।
ঘোষণা ও শপথ বাক্য পাঠ ॥ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত গণমঞ্চ তৈরি করে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে মহা-সমাবেশের ঘোষণাপত্রে। প্রজন্ম চত্বর থেকে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলা হয়, ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে আমাদের দৃপ্ত শপথ ধরে রাখতে। সেই সঙ্গে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় শাহবাগের মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে হলুদ হেডব্যান্ড পরা ব্লগার ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টের ব্যানারে মূল আয়োজকরা এ ঘোষণা দেন। শপথবাক্য পাঠ করায় ব্লগার ও মহাসমাবেশের সভাপতি ইমরান চৌধুরী।
কাদের মোল্লার বিচারের রায় প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়, কাদের মোল্লার অপরাধে মৃত্যুদ- হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও আদালত তাকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে দেশবাসীকে হতাশাগ্রস্ত করেছে। এ রায় ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দেশরক্ষায় সবাইকে অবিচল থাকারও আহ্বান জানানো হয়। জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়-যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ঘোষণা থেকে জামায়াত-শিবির ও রাজাকারদের দেয়া হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়; যারা এ হুমকি দিয়েছে তাদের গ্রেফতার করতে হবে। এজন্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত আলোকচিত্র এবং ভিডিও ফুটেজম দেখে তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি করেন আন্দোলনকারীরা।
জামায়াতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, আশ্রয়দাতা ও বিচার বানচালকারীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আমাদের এই জাগরণ গণজাগরণে পরিণত করতে হবে। চলমান আন্দোলন বেগবান ও সুসংগঠিত করারও আহ্বান জানানো হয় সকলের প্রতি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘আপনারা নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে দিন। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে সকলেই সোচ্চার হোন।’
সমাবেশ থেকে শপথ নিয়ে বলা হয়, ‘আমরা শপথ করছি ‘৭১-এ যে সকল ঘৃণ্য রাজাকার, আলবদর, গণহত্যা ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের মৃত্যুদ- না হওয়া পর্যন্ত গণমানুষের নেতৃত্বে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলববদর-আলশামসসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে সোচ্চার থাকব। ’৭৫-এর পর যেসব যুদ্ধাপরাধী, আলবদর, রাজাকারদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের দাবিতে কাজ করব। ইসলামী ব্যাংক, ইবনেসিনা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফোকাস ও রেটিনা কোচিং সেন্টার বয়কট করব। ওদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের সন্তানদের পড়াশোনা করতে পাঠাব না। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে আমাদের দেশে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী বিষবৃক্ষ রোপণ করছে। তাই তাদের বয়কট করতে হবে। রাজাকার আলবদরদের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করব। জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার আহ্বান মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এরকম রাষ্ট্রদ্রোহিতার সঙ্গে যারা যুক্ত ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির দাবি জানাব। যুদ্ধাপরাধী-জামায়াতের পরিচালিত নয়া দিগন্ত, আমার দেশ, সংগ্রাম, সোনার বাংলা ব্লগ বয়কট করব। অফিস কিংবা বাসায় যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকা রাখব না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণমাধ্যমগুলোতে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী, তাঁবেদারদের বয়কট করতে হবে। জামায়াত-শিবিরকে বাসা ভাড়া না দেয়ার জন্যও সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।’
এত মানুষ আর কখনও দেখিনি॥ বিকেল তিনটায় আনুষ্ঠানিক মহাসমাবেশের শুরু। কিন্তু সকাল থেকেই রাজধানীর মানুষের যেন ঠিকানা হয় শাহবাগ। নামে মানুষের ঢল। দুপুরের আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় স্বাধীনতা প্রজন্ম স্কয়ার। এক বুক ক্ষোভ নিয়ে লাখ-লাখ মানুষ যোগ দিতে আসেন এখানে। কেউ কষ্টে চিৎকার করে বলছিলেন- বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন সারাবাংলায় ছড়িয়ে দাও। সমাবেশে যোগ দিতে আসা মুক্তিযোদ্ধা শাহিনুর রহমান জানালেন- ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর দেশ রক্ষার আন্দোলনে এত জনতার ঢল আর দেখিনি। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সবার মুখেই ছিল এক কথা দেশপ্রেমিক মানুষের ঢল নতুন করে ইতিহাস সৃষ্টি করল।
অনুপ্রেরণার স্থান শাহবাগ ॥ ’৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রগতিশীল সকল আন্দোলনের পাঠস্থান হিসেবে পরিচিত শাহবাগ। শাহবাগ চত্বরে যেখানে আন্দোলন চলছে তার কাছেই রমনা পার্ক। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও এসব স্থান জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিও আরেকটি জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে থাকবে দেশ রক্ষার আন্দোলনে। তাছাড়া বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একুশের বাইমেলা তারুণ্যের শক্তিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। প্রতিবাদী সেøøাগানে উজ্জীবিত হয়ে শাহবাগমুখী তরুণের বাঁধ ভাঙা ঢল। শাহবাগের এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে শহর থেকে থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দেশের প্রতিটি স্থানে রাজপথে নেমেছেন প্রতিবাদী মানুষ। তাছাড়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে যেন শাহবাগের বিদ্রোহের আওয়াজ পৌঁছে গেছে।
চরমপত্রপাঠে মহাসমাবেশ শুরু ॥ সকাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসতে থাকে শাহবাগের দিকে। জাতীয় প্রেসক্লাবে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচীর পর তারা শাহবাগে এতে সংহতি প্রকাশ করে। সকলের চোখে মুখে ছিল বিদ্রোহের ছাপ। যেন দেশ রক্ষার শপথ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সবাই। সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখানে এসে সংহতি প্রকাশ করেন। দিনভর চলে প্রতিবাদী সেøাগান। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। রাজাকারদের ছবিতে থুতু ও জুতা পেটা করেন বিপ্লবী জনতা। তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। রাজাকারদের ফাঁসি ও ঘৃণা ভরে হাজার হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেন সাদা কাপড়ে। খাঁচা তৈরি করে বাংলাদেশের মানচিত্র আগলে রাখেন বিভিন্ন সংগঠন। বিলাশ মানচিত্রের চারপাশ ঘিরে দিনভর চলে সেøাগান। ঢাল ঢোল আর বাদ্য বাজনার তালে তালে দাবি জানানো হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির।
বিকেল তিনটায় শাহবাগ মোড়ে একটি ছোট্ট ট্রাকের মূলমঞ্চ থেকে চরমপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহাসমাবেশ। ততক্ষণে মহাসমাবেশ পরিণত হয় মহাসমুদ্রে। প্রতিবাদী মানুষের গর্জন ছড়িয়ে যায় গোটা দেশে। সাইন্স ল্যাবরেটরি থেকে শাহবাগ-শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর-ফার্মগেট-মৎস্য ভবন কোথাও ঠাঁই নেই। লাখো জনতার বাঁধ ভাঙা স্রোত। কানায় কানায় পূর্ণ পুরো এলাকা। জায়গা না পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতাল-বারডেমসহ আশপাশের ভবনে ঠাঁই নেন অনেকে। চরমপত্র ঘোষণা করেন ব্লগার শহীদুল ইসলাম রাজু। এরপর সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। তখন লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। দিনভর খ--খ- মিছিল নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ সমাবেশে যোগ দেন। এতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষবিদ, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ।
ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াত-শিবিরের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে সরকারীভাবে পরিচালনার দাবি ওঠে সমাবেশ থেকে। জামায়াত-শিবিরসহ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরি করে তাদের আগামী নির্বাচনে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন লাখ-লাখ মানুষ। সংগ্রাম-আমারদেশ-নয়াদিগন্ত-দিগন্ত টেলিভিশন বর্জনসহ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে বর্জনে একমত পোষণ করেছেন সকলেই। বলা হয়, ’৭৫-পরবর্তী যেসব স্বাধীনতাবিরোধীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে আইন পরিবর্তন করে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবি ওঠে শাহবাগ থেকে।
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে লাখ-লাখ মানুষ শাহবাগ স্কয়ারের দিকে আসতে থাকে। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সমাজ, সংস্কৃতি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে এখানে। ঢাকার বাইরে থেকে আসতে থাকে হাজারো মানুষ। প্রতিবাদী সেøøাগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। সমাবেশ চলাকালে প্রতিবাদী এক যুবক গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া সমাবেশ চলে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত। এরপরও জনতার ঢল থামেনি। রাতে মশাল জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানান সকলেই।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভের সূচনা করে ব্লগার ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। এরপর রাতেই তা পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো মহাসমাবেশ।
এ অবিশ্বাস্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করানো কঠিন। কোন রাজনৈতিক দলের আহ্বান ছাড়া এত বড় আন্দোলন, এত মানুষের জমায়েত হতে পারে তা ভাবাই যায় না।
ফাঁসি চাই- ফাঁসি চাই ॥ ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ সেøাগানে রাত-দিন উত্তাল শাহবাগ। মুহুর্মুহু সেøøাগানে পুরো প্রকম্পিত রাজপথ। সেøাগানের গর্জন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। মহাসমাবেশে লাখ-লাখ জনতা সমস্বরে উচ্চারণ করেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। সমাবেশে যোগ দিতে কেউ ঝাড়ু, কেউ ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই, রাজপথ ছাড়ব না’ প্ল্যাকার্ড, কেউবা ‘সব রাজাকারের ফাঁসি চাই’ ধরনের হাজারো সেøøাগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হন।
রাজাকারদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার আহ্বান ॥ মহাসমাবেশ থেকে নতুন নতুন দাবি ওঠেছে অনেক। এর মধ্যে আগত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা জামায়াত-শিবিরসহ সকল রাজাকারের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান। পাশাপাশি দেশবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত থাকা, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তসহ গৃহযুদ্ধের হুমকির অপরাধে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানানো হয়। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষ এ দাবি জানান। তাদের সকলের বক্তব্য-যারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না তাদের এদেশে থাকার কোন অধিকার নেই। তেমনি ভোট দেয়ারও অধিকার নেই। প্রয়োজনে সকলে মিলে তাদের সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিতে হবে। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথ ভাঙা শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। আগামী নির্বাচনের আগেই রাজাকারসহ জামায়াত-শিবির কর্মীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ না দিতে বিকল্প আন্দোলনের হুমকি দেন তারা।
বর্জনের আহ্বান ॥ জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত সকল প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে জাতীয়করণ করার দাবি উঠেছে মহাসমাবেশ থেকে। মহাসমাবেশে নেতৃবৃন্দসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের পক্ষ থেকে দাবি জানিয়ে বলা হয়- ইসলামী ব্যাংককে জাতীয়করণের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে আলাদা করতে হবে। একই সঙ্গে জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত দিগন্ত টিভিকে সমাবেশস্থল থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে দিগন্ত টিভি না দেখার অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন এ্যাকাউন্ট না খোলা এবং পুরান এ্যাকাউন্ট থেকে আমানত তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও জামায়াত এবং শিবির পরিচালিত নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম পত্রিকা, রোটিনা কোচিং সেন্টার, ইবনেসিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মাসিটিক্যালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। আমারদেশ পত্রিকা বর্জনেরও আহ্বান জানানো হয় সমাবেশ থেকে। এছাড়াও আল জাজিরা, বিবিসি, এএফপিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সমাবেশ থেকে সতর্ক করে বলা হয়, আপনারা সাবধান হয়ে যান। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করুন। আমাদের আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অনেক সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে-ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু হয়েছে।
প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের আহ্বান ॥ ’৭১-এর ঘাতক জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মোঃ কামারুজ্জামানের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছে সমাবেশ থেকে। একই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংবাদমাধ্যমের সকল ক্ষেত্র থেকে জামায়াত-শিবিরের সদস্যদের বর্জন করার মধ্য দিয়ে নতুন আন্দোলনের আহ্বান জানান তাঁরা। পাশাপাশি সামাজিকভাবে জামায়াত-শিবিরসহ সকল যুদ্ধাপরাধীকে বয়কটের আহ্বান সকলের। সমাবেশে বক্তারা সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের আপনারা প্রশ্রয় দেবেন না। অবিলম্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিল করুন। ’৭১-এর ঘাতকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানের সদস্য থাকতে পারে না।
ফ্রি চিকিৎসা সেবা ॥ শাহবাগ মোড়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সংহতি জানাতে জড়ো হওয়া জমায়াতে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের পরিচালনা করছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। তাৎক্ষণিকভাবে সমাবেশে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যবস্থা করা হয়েছে বিনামূল্যে ওষুধেরও। সমাবেশে ফ্রি চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত আছেন সংগঠনের সদস্য ডা. জাকির হোসেন, ডা. মামুন হোসেন, ডা. অজিত রায় ও ডা. নিতাই রায় চৌধুরী।
ঘোষণা ও শপথ বাক্য পাঠ ॥ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত গণমঞ্চ তৈরি করে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে মহা-সমাবেশের ঘোষণাপত্রে। প্রজন্ম চত্বর থেকে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলা হয়, ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে আমাদের দৃপ্ত শপথ ধরে রাখতে। সেই সঙ্গে সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় শাহবাগের মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে হলুদ হেডব্যান্ড পরা ব্লগার ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টের ব্যানারে মূল আয়োজকরা এ ঘোষণা দেন। শপথবাক্য পাঠ করায় ব্লগার ও মহাসমাবেশের সভাপতি ইমরান চৌধুরী।
কাদের মোল্লার বিচারের রায় প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়, কাদের মোল্লার অপরাধে মৃত্যুদ- হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও আদালত তাকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে দেশবাসীকে হতাশাগ্রস্ত করেছে। এ রায় ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দেশরক্ষায় সবাইকে অবিচল থাকারও আহ্বান জানানো হয়। জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়-যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ঘোষণা থেকে জামায়াত-শিবির ও রাজাকারদের দেয়া হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়; যারা এ হুমকি দিয়েছে তাদের গ্রেফতার করতে হবে। এজন্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত আলোকচিত্র এবং ভিডিও ফুটেজম দেখে তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি করেন আন্দোলনকারীরা।
জামায়াতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, আশ্রয়দাতা ও বিচার বানচালকারীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আমাদের এই জাগরণ গণজাগরণে পরিণত করতে হবে। চলমান আন্দোলন বেগবান ও সুসংগঠিত করারও আহ্বান জানানো হয় সকলের প্রতি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘আপনারা নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে দিন। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে সকলেই সোচ্চার হোন।’
সমাবেশ থেকে শপথ নিয়ে বলা হয়, ‘আমরা শপথ করছি ‘৭১-এ যে সকল ঘৃণ্য রাজাকার, আলবদর, গণহত্যা ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের মৃত্যুদ- না হওয়া পর্যন্ত গণমানুষের নেতৃত্বে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলববদর-আলশামসসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে সোচ্চার থাকব। ’৭৫-এর পর যেসব যুদ্ধাপরাধী, আলবদর, রাজাকারদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের দাবিতে কাজ করব। ইসলামী ব্যাংক, ইবনেসিনা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফোকাস ও রেটিনা কোচিং সেন্টার বয়কট করব। ওদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের সন্তানদের পড়াশোনা করতে পাঠাব না। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে আমাদের দেশে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী বিষবৃক্ষ রোপণ করছে। তাই তাদের বয়কট করতে হবে। রাজাকার আলবদরদের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করব। জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার আহ্বান মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এরকম রাষ্ট্রদ্রোহিতার সঙ্গে যারা যুক্ত ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির দাবি জানাব। যুদ্ধাপরাধী-জামায়াতের পরিচালিত নয়া দিগন্ত, আমার দেশ, সংগ্রাম, সোনার বাংলা ব্লগ বয়কট করব। অফিস কিংবা বাসায় যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকা রাখব না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণমাধ্যমগুলোতে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী, তাঁবেদারদের বয়কট করতে হবে। জামায়াত-শিবিরকে বাসা ভাড়া না দেয়ার জন্যও সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।’
এত মানুষ আর কখনও দেখিনি॥ বিকেল তিনটায় আনুষ্ঠানিক মহাসমাবেশের শুরু। কিন্তু সকাল থেকেই রাজধানীর মানুষের যেন ঠিকানা হয় শাহবাগ। নামে মানুষের ঢল। দুপুরের আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় স্বাধীনতা প্রজন্ম স্কয়ার। এক বুক ক্ষোভ নিয়ে লাখ-লাখ মানুষ যোগ দিতে আসেন এখানে। কেউ কষ্টে চিৎকার করে বলছিলেন- বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন সারাবাংলায় ছড়িয়ে দাও। সমাবেশে যোগ দিতে আসা মুক্তিযোদ্ধা শাহিনুর রহমান জানালেন- ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর দেশ রক্ষার আন্দোলনে এত জনতার ঢল আর দেখিনি। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সবার মুখেই ছিল এক কথা দেশপ্রেমিক মানুষের ঢল নতুন করে ইতিহাস সৃষ্টি করল।
অনুপ্রেরণার স্থান শাহবাগ ॥ ’৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রগতিশীল সকল আন্দোলনের পাঠস্থান হিসেবে পরিচিত শাহবাগ। শাহবাগ চত্বরে যেখানে আন্দোলন চলছে তার কাছেই রমনা পার্ক। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও এসব স্থান জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিও আরেকটি জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে থাকবে দেশ রক্ষার আন্দোলনে। তাছাড়া বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একুশের বাইমেলা তারুণ্যের শক্তিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। প্রতিবাদী সেøøাগানে উজ্জীবিত হয়ে শাহবাগমুখী তরুণের বাঁধ ভাঙা ঢল। শাহবাগের এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে শহর থেকে থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দেশের প্রতিটি স্থানে রাজপথে নেমেছেন প্রতিবাদী মানুষ। তাছাড়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে যেন শাহবাগের বিদ্রোহের আওয়াজ পৌঁছে গেছে।
চরমপত্রপাঠে মহাসমাবেশ শুরু ॥ সকাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসতে থাকে শাহবাগের দিকে। জাতীয় প্রেসক্লাবে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচীর পর তারা শাহবাগে এতে সংহতি প্রকাশ করে। সকলের চোখে মুখে ছিল বিদ্রোহের ছাপ। যেন দেশ রক্ষার শপথ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সবাই। সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখানে এসে সংহতি প্রকাশ করেন। দিনভর চলে প্রতিবাদী সেøাগান। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। রাজাকারদের ছবিতে থুতু ও জুতা পেটা করেন বিপ্লবী জনতা। তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। রাজাকারদের ফাঁসি ও ঘৃণা ভরে হাজার হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেন সাদা কাপড়ে। খাঁচা তৈরি করে বাংলাদেশের মানচিত্র আগলে রাখেন বিভিন্ন সংগঠন। বিলাশ মানচিত্রের চারপাশ ঘিরে দিনভর চলে সেøাগান। ঢাল ঢোল আর বাদ্য বাজনার তালে তালে দাবি জানানো হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির।
বিকেল তিনটায় শাহবাগ মোড়ে একটি ছোট্ট ট্রাকের মূলমঞ্চ থেকে চরমপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহাসমাবেশ। ততক্ষণে মহাসমাবেশ পরিণত হয় মহাসমুদ্রে। প্রতিবাদী মানুষের গর্জন ছড়িয়ে যায় গোটা দেশে। সাইন্স ল্যাবরেটরি থেকে শাহবাগ-শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর-ফার্মগেট-মৎস্য ভবন কোথাও ঠাঁই নেই। লাখো জনতার বাঁধ ভাঙা স্রোত। কানায় কানায় পূর্ণ পুরো এলাকা। জায়গা না পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতাল-বারডেমসহ আশপাশের ভবনে ঠাঁই নেন অনেকে। চরমপত্র ঘোষণা করেন ব্লগার শহীদুল ইসলাম রাজু। এরপর সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। তখন লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। দিনভর খ--খ- মিছিল নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ সমাবেশে যোগ দেন। এতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষবিদ, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ।
No comments