রোডম্যাপ শুরম্ন- ডিজিটাল দেশ গড়ার by জাফর আহমেদ
দেশের সবচেয়ে আলোচিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রোডম্যাপ বা মহাপরিকল্পনা শুরম্ন করে দিয়েছে মহাজোট সরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরম্ন করে দেশের সব ধরনের শিাপ্রতিষ্ঠানকে এই রোডম্যাপ বাসত্মবায়নের প্রধান ত্রে হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং 'রূপকল্প ২০২১'- এর সঙ্গে একীভূত করে এ রোডম্যাপের দলিল প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাসত্মবায়িত হলে ২০২১ সালে দেশে প্রতিহাজারে ৭৩ জন ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার করবে। প্রতিজেলায় একটি করে দেশীয় জনবল দিয়ে সফটওয়্যার তৈরির কারখানা স্থাপন করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হবে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিক কম্পিউটারের মাধ্যমে ভোট প্রদান করতে সম হবে। রূপকল্পের অন্যান্য বিভাগের বাসত্মবায়ন নিশ্চিত করে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়নত্মির বছর বাংলাদেশের জিডিপি বেড়ে দাঁড়াবে ১০ শতাংশের বেশি।এ রোডম্যাপ বাসত্মবায়নে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২১ সাল পর্যনত্ম সকল বাজেটে মধ্য আয়ের দেশের আদলে শিা খাতে মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ থাকতে পারে। এ ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে নিরবচ্ছিন্নভাবে শতভাগ মানুষকে বিদু্যত সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে এই বিপুল পরিমাণ বিদু্যত উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি এবং পারমাণবিক চুলিস্নর মাধ্যমে অনত্মত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদনের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত বিশেষ বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়ে এই রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে।
দেশের বিশিষ্ট কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান আহমদ, গবর্নর ড. আতিউর রহমান, পিকেএসএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মেসবাহ উদ্দীন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সাবেক গবর্নর ড. ফরাস উদ্দীন আহমেদ, ব্র্যাকের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেনসহ দেশের প্রতিথযশা ২১ বিশেষ বিশেষজ্ঞ নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি এ পর্যনত্ম ৩০টি, জাতীয় পর্যায়ে প্রধান খাতভিত্তিক ১০টি পরামর্শসভা এবং দেশের ৩০টি উপজেলার ৩০টি অঞ্চল জরিপ করেছে। সার্বিকভাবে এই পরিকল্পনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে এই পরিকল্পনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যেসব সুপারিশ প্রসত্মাব করা হয়েছে_ প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সকল বিদ্যালয়ে কম্পিউটারল্যাব স্থাপন, সকল জেলায় একটি করে সফটওয়্যার তৈরির কারখানা স্থাপনসহ ছয়টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সরবরাহের ওপর গুরম্নত্বারোপ করা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী সকল ল্য অর্জন করে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়নত্মির বছর থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের আবির্ভাব হবে।
সূত্র জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের রোডম্যাপের প্রাথমিক ল্য নির্ধারণ করা হয়েছে দেশের কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রতি এক হাজারে ২২ জন কম্পিউটার ব্যবহার করছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ৩৬ জনে উন্নীত করা হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২১ সালে প্রতিহাজারে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর এ সংখ্যাকে ২০১৬ সালে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরকিল্পনা বাসত্মবায়ন শেষে ৩৬ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাসত্মবায়ন শেষে ৭৩ জনে উন্নীত করা হবে।
ডিজিটাল রোডম্যাপের পরিকল্পনায় বলা হয় যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং আইসিটি একটি সর্বজনীন বিষয়। এসব বিষয়ের সঙ্গে শিা, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান, বেসরকারী খাত উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, ুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ অনেক বিষয় জড়িত। এতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের জাতীয় বাজেটে শিা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। আবার এই বাজেট থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গবেষণা এবং আইসিটি উন্নয়ন খাতে যে ব্যয় করা হয় তা একেবারেই নগণ্য। অথচ মানসম্পন্ন উন্নত গবেষণা ছাড়া এ খাতে সফলতা পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
রোডম্যাপের পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ শিা খাতের অধীনে বাসত্মবায়ন করা হবে। সে হিসেবে শিা ব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামোতে যে পরিমাণ খরচ করা হয় এতে করে দেশের শিা ব্যবস্থাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় এ খাতে যদি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার জন্য সবচয়ে বেশি প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে গবেষণা। তাই দেশকে আগামী ১১ বছরের মধ্যে একটি সর্বাধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বর্তমানে যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে কোনক্রমে সঙ্কুলান হবে না। বর্তমানে বাজেটে শিা খাতের জন্য জিডিপির মাত্র ২দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়। তাই সরকারের কাছে কমিটি আগামী বাজেট থেকে মধ্য আয়ের দেশের মতো জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ করেছে।
সূত্র জানায়, বাসত্মবায়নের প্রধান ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরম্ন করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যনত্ম সকল সত্মরে প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হবে। এতে বলা হয়েছে, সকল প্রাইমারি স্কুলে অনত্মত একটি করে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করতে হবে। হাইস্কুলেও একটি করে করলেই চলবে। তবে কলেজগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী বা চাহিদার ভিত্তিতে ল্যাব স্থাপন করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাধিক ল্যাব স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
পরের সত্মরে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের ব্যবহার গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ই-কমার্স বা কম্পিউটারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন। যেমন বিদু্যত বিল, গ্যাস বিল, টেলিফোন বিলসহ সরকারী অফিস-আদালতের সকল বিষয় কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিচালনা করা। এতে দেশের সব ধরনের নাগরিক শিা এবং বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে সকল কার্যক্রমে আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করবে বলে মনে করেন তারা।
দেশের পলস্নী এলাকায় কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন। এ সেন্টার স্থাপনে সরকারী-বেসরকারী উভয়েরই এগিয়ে আসতে হবে। এতে বলা হয়, এই সেন্টারগুলোতে বিপুল সাড়া পড়তে পারে। তাই সাধারণ ব্যবসায়ীরাও এতে বিপুল আগ্রহ দেখাবে বলে মনে করেন তারা।
কমিটির সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ সুপারিশটি হচ্ছে_ দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সফটওয়্যার শিল্পের কারখানা স্থাপন। এতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক জেলায় সফটওয়্যার কারখানা স্থাপন করা হলে ওই এলাকার প্রচুর পরিমাণে মেধাবী ছাত্র সফটওয়্যার তৈরির প্রশিণের সুযোগ পাবে। পরবর্তীতে ওই ছাত্ররাই কারখানায় চাকরি নিয়ে উন্নতমানের সফটওয়্যার তৈরিতে সম হয়ে উঠবে। পর্যায়ক্রমে ওই সফটওয়্যার বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে এই খাত জিডিপিতে উলেস্নখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে।
কমিটির সুপারিশের মধ্যে সর্বাধিক গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কম্পিউটারাইজড করাকে। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২০১৪ সালের মধ্যে সকল উপজেলাকে কম্পিউটারাইজড করা হবে। পর্যায়ক্রমে এ ধারা অব্যাহত রেখে ২০২১ সালে সকল ইউনিয়ন পরিষদে কম্পিউটার বসিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সংসদসহ সকল নির্বাচনের ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে।
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ডিজিটালের পূর্বশর্ত বিদু্যত। তাই ২০২১ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদু্যতের ব্যবস্থা করতে না পারলে সব কিছুই অর্থহীন হয়ে যাবে। তাই, বর্তমান ৫ হাজার ৭শ' ১৯ মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদনকে ২০২১ সালের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে ৭ হাজার ৮শ' মেগাওয়াটে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে যে বিদু্যত উৎপাদন আছে তা দিয়ে দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ নাগরিক বিদু্যত ব্যবাহারের সুযোগ পাচ্ছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে তা যদি ১১ হাজার ৬ শ' মেগাওয়াটে উন্নীত করা যায় তাহলে দেশের ৭২ শতাংশ নাগরিক বিদু্যত ব্যবহার করতে পারবে। ২০২১ সালের মধ্যে যদি সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করা যায় তাহলে দেশের শতভাগ মানুষ বিদু্যত ব্যবহার করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে আরও বলা হয়েছে যে, ওই বিদু্যতও পরিবেশসম্মত উপায়ে উৎপাদন করতে হবে। যেমন বর্তমানে ৮৮ ভাগ বিদু্যত উৎপাদিত হচ্ছে গ্যাসের মাধ্যমে, ৬ শতাংশ ফার্নেস অয়েলের মাধ্যমে, ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কয়লার মাধ্যমে এবং ২ দশমিক ৭ শতাংশ হাইড্রো ইলেক্ট্রোসিটির মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে গ্যাসের মাধ্যমে বিদু্যত উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামাতে হবে। ফার্নেস অয়েলের মাধ্যমে উৎপাদন কমিয়ে আনতে হবে ৩ শতাংশে। কয়লায় বাড়িয়ে ৬৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। তবে বাধ্যতামূলকভাবে এ সময় পারমাণবিক বিদু্যত উৎপাদন করতে হবে কমপ ে১ হাজার মেগাওয়াট। তাহলেই বিদু্যত সঙ্কট কাটানোর পাশাপাশি পরিবেশসম্মত উপায়ে বিদু্যত উৎপাদন নিশ্চিত হবে।
No comments