রবিশঙ্কর প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর আইএইচটি থেকে অনুবাদ : by এনামুল হক
আমার সঙ্গে দেখা হলেই কেউ হয়ত মজার কোন কৌতুক পরিবেশন করত, কেউ বা শূন্যে সেতার বাজানোর ভঙ্গি করে নাকি সুরে সেতারের ঝঙ্কার তুলত কিংবা আমার মেয়ে নোরা জোন্সের সঙ্গে একটা ডেটের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাত। যতবার এ ধরনের মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতো ততবার এক রুপী করে পেলে আমি এতদিনে বড়লোক হয়ে যেতাম।
হেন একটা দিন যায়নি যেদিন আমার নামে নাম বিশ্বসঙ্গীতের এই অমর শিল্পীর কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া না হয়েছে। আমার জীবন কেটেছে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ধারণ করে, দ্বিতীয় রবিশঙ্কর হিসেবে। আমার পরিচয় বা সত্তার সঙ্কট ভার্জিনিয়ার শহরতলির সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে। সেখানে আমার বালামচিবিনুনী, হাস্যসুন্দরী শিক্ষয়িত্রী মিজ ফাতুমা একদিন আমাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে সময়ের আগেই আমার পড়াশোনায় এগিয়ে থাকার প্রশংসা করলেন এবং জানালেন যে, আমার এক বিশেষ প্রতিভা আছেÑ ঠিক সেই মানুষটির মতো যার নামে আমার নাম।তবে নবম গ্রেডে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার সম নামের সত্তাটি আমার বাস্তব জগতে আবির্ভূত হয়নি। একদিন বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম এমন সময় ছোটখাটো একটা রেডিও ক্যাসেট থেকে সুর ভেসে উঠল ‘পেইন্ট ইট ব্ল্যাক’। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলোÑ গিটারের এই সুরটা আমার বেশ ভালো লেগেছে। এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলল : ‘ওটা গীটার নয়, সেতার। আর বাজাচ্ছেন একজন ভারতীয়। নাম রবিশঙ্কর। বুঝতে পারলেÑ আসল রবিশঙ্কর।
বিখ্যাত কোন নামের অধিকারী হওয়া একটা ঝকমারি ব্যাপার। এনপিআর সম্প্রতি এ বিষয়টির ওপর এক অনুষ্ঠান করেছে। আমার ক্ষেত্রে অদৃষ্টের লিখনটা একই সঙ্গে অভিশাপ ও আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিল। নর্থ ক্যারোলিনার এক লাইব্রেরিতে আমি কবিতা পাঠ করেছিলাম, যে ঘটনার কথা আমি ভুলব না। সেখানে আমি মঞ্চে উঠে দাঁড়াতেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকারের সুরে বলে উঠলেন :‘এ রবিশঙ্কর নয়’Ñবলতে বলতেই অকুস্থল থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখাদেখি অনুষ্ঠানস্থল থেকে গণহারে লোকজন বেরিয়ে গেল।
আশীর্বাদের ঘরে আমি রেখে দেব সোনার এমবোস করা একটি আমন্ত্রণপত্র যা আমি পেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। পিয়ের পন্ট মরগ্যান লাইব্রেরিতে রবার্টো ক্যালাসোর গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি বীরদর্পে গিয়েছিলাম। সঙ্গে নিয়েছিলাম এক বন্ধুকে। সন্ধ্যায় ডোম পেরিং ননে ডিনার ছিল লবস্টার ক্যানাপেসের। সেই সঙ্গে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে খোশগল্প। পরে এক সময় আমার বন্ধুটি কেনই যে জিজ্ঞেস করল একথাÑ ‘ওরা কি তোমাকে নেমতন্ন করেছিল’, আমি বলেছিলাম; ‘সামান্য একটু নামের ভুলে।’
কিছু সময়ের জন্য আমার ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘বাস্তব’ রবিশঙ্করের সঙ্গে দেখা করা। আমাকে প্রচ্ছন্নভাবে এই অনুভূতি পেয়ে বসেছিল যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলে আমার জীবনে যেসব অস্তিত্বগত ফাঁক আছে তার কয়েকটি হয়ত জোড়া লেগে যাবে। আমাদের পরিচয় পর্বটা কেমন হতে পারে তার একটা মহড়াও দিয়েছিলাম। আমি বলব : নমস্তে রবিশঙ্কর। আমার নামও রবিশঙ্কর।’ অথবা বলব : ‘শুভেচ্ছা, প-িত শঙ্কর। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে নিজেকে আমি অতীব সম্মানিতবোধ করছি। আপনার নামে আমারও নামটি রাখা হয়েছে বিধায় আমি এ নামের যোগ্য হওয়ার প্রেরণা বোধ করছি।’
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের এই সাক্ষাত কখনই ঘটেনি। এবং শঙ্করও আমার এই শোচনীয় নাটুকেপনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। তবে তাঁর মেয়ে ও সহশিল্পী আনুষ্কার সঙ্গে ১০ বছর আগে এক কাফে কনসার্টে আমার দেখা হয়েছিল। সে রাতে ভাবাবিষ্ট হয়ে আনুষ্কা বলেছিলেন, তিনি ও তাঁর বাবা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলোডিপ্রধান রাগ সঙ্গীত পরিবেশন করে পরমানন্দ লাভ করে থাকেন। বুৎপত্তিগতভাবে ‘রাগ’ শব্দের অর্থ বর্ণ বা রঙ। তবে এর আরেক অর্থও আছে এবং তা হলো প্রবল আবেগ বা আসক্তি। রাগের লক্ষ্য হলো পরমানন্দের এক ভাববিহ্বল আবেশ সৃষ্টি করা। আমার ক্ষেত্রে এমন কোন কোন মুহূর্ত আসে যখন সঙ্গীত সবকিছু পেয়ে বসে বা গ্রাস করে নেয়Ñ মনের কলরব যখন থেমে যায় এবং তার পরিবর্তে মন সঙ্গীতের বিশুদ্ধ ধ্বনির সঙ্গে যুগলনৃত্যে মিলিত হয়ে যায়। রাগমালায় রবিশঙ্কর লিখেছেন : ‘সঙ্গীত হলো অর্চনার মতো। সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করা হয়।’
যখনই প-িত রবিশঙ্করকে সরাসরি সেতার বাজাতে শুনেছি ঠিক এমন অনুভূতিই আমাকে গ্রাস করেছিল এবং সেই অনুভূতির জোয়ারে আমি ভেসে গিয়েছিলাম। ২০০৫ সালে বোস্টনে এক কনসার্টের কথা মনে পড়ে। তাঁকে কত ছোট ও দুর্বল দেখাচ্ছিল এবং যে সেতারটি তিনি একটা শিশুর মতো করে পরম মমতায় ও ভালবাসায় ধরে রেখেছিলেন সেটিকে কতই না বিশাল দেখাচ্ছিল। তিনি বন্দনা দিয়ে শুরু করলেন। তারপর পরিবেশন করলেন সুকি কাব্যনির্ভর তারানা। তবে অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল পিতা ও কন্যার পরিবেশিত দ্বৈত রাগ। মনে আছে একত্রে রাগ পরিবেশন করতে গিয়ে প-িত রবিশঙ্কর কিভাবে কন্যা আনুষ্কার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। গর্ব ও অহঙ্কারের প্রভায় উদ্ভাসিত ছিল তাঁর মুখম-ল। যেন তিনি বলছিলেন, ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা।’
এবং তিনি এখন অমৃতলোকেই চলে গেলেন। রবিশঙ্কর ভারতীয় সংস্কৃতির আদর্শ প্রতিভূ ছিলেন। শিল্পী হিসাবে তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সংশ্লেষক। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; অথচ অবাধে নতুন অনেক কিছুই উদ্ভাবন করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য কনসার্টের ব্যাপারে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। জন কোনট্রেনকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ দিয়েছিলেন। ক্রেমলিনের ভিতর চমক লাগানো অনুষ্ঠান পরিবেশনায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্র এবং বলসইয়ের নতর্কীদের সঙ্গে সঙ্গীতের নতুন প্রযুক্তির বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। চেম্বার মিউজিক এ্যালবাম প্যাসেজ নিয়ে ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে কাজ করেছেন। ফিল্ম ও টিভির জন্য লিখেছেন। রবিশঙ্কর সীমাহীন ও সৃজনশীল কৌতূহল, সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ধারায় তাঁর পরিপূর্ণ সম্পৃক্ততা তবে সর্বদাই নতুনের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে থাকাÑ এটাই আমি তাঁর ব্যাপারে যতবার লিখতে গেছি ততবারই তীব্রভাবে অনুভব করেছি। রবিশঙ্কর নাম হওয়ায় কিছু কিছু বিচিত্র উপায়ে আমার মধ্যে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার তাড়না জোরদার হয়েছে। আমার বাবা সনাতন মনমানসিকতার একজন ভারতীয়। এমন একটা ক্যারিয়ারকে তিনি উপযুক্ত পেশার তালিকায় ভাঁড়ের সমপর্যায়ের পেশা বলে গণ্য করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও আমি শিল্পকলার জগতে পা বাড়িয়েছিলাম। আরেক রবিশঙ্কর যিনি একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবিস্মরণীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তিনিই আমার এ পথটা সুগম করে দেন। রবিশঙ্করের প্রয়াণের ওপর লিখতে গিয়ে তিনি যাদের রেখে গেছেন তাদের তালিকায় আমি এখনও হয়ত নোরা জোন্সের নাম উল্লেখ করব না। তথাপি তাঁর মতো একই নামের অধিকারী হওয়ার যে অসামান্য সৌভাগ্য আমার হয়েছে তার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমার এ কথা মনে থাকবে প-িত।
[নিবন্ধকারের নাম রবিশঙ্কর। পেশায় লেখক ও সম্পাদক। শিল্পকলাবিষয়ক ইলেকট্রনিক জার্নাল ‘ড্রাংকেন বোর্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক]
No comments