মধ্য হিমালয়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ by শাহীন রহমান
হিমালয়ের পাদদেশে যে কোন সময় ভয়াবহ ভূমিকম্পের আভাস দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। আর বাংলাদেশ থেকে এর দূরত্ব মাত্র সাড়ে চার শ’ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ন্যানাং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি জানিয়েছেন, যে কোন সময়ে মধ্য হিমালয়ে ৮ থেকে সাড়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এটি হলে হিমালয়ের ওপররিভাগ ভেঙ্গে পড়তে পারে। এতে বলা হয়েছে, মধ্য হিমালয় বরাবর একটি ফাটল রেখা সৃষ্টি হয়েছে, যা থেকে ভয়াবহ ভূমিকম্প হতে পারে। এ ফাটলরেখাটি হিমালয়ের সম্মুখভাগে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আর এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে এসে পড়তে পারে। পল ট্যাপোনিয়ার নামের একজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, অতীতে এ এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। ভবিষ্যতে এ এলাকায় এ ধরনের ভূমিকম্প আবার হতে পারে। আর এটি হলে পৃথিবীর শীর্ষ ভূপৃষ্ঠ ভেঙ্গে পড়তে পারে। পল ট্যাপোনিয়ার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন ১২৫৫ সালে এবং ১৯৩৪ সালে দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখানো হয় নেপালের প্রধান চুতিরেখা থেকে হিমালয় বরাবর ফাটলরেখার অস্তিত্ব রয়েছে। ভারত এবং এশিয়ান টেকটোনিক প্লেট বরাবর এ ফাটল রেখাটি অবস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমালয় বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস। অতীতে এলাকায় ভায়বহ ভূমিকম্পে সংঘটিত হয়েছে। নতুন করে ভূমিকম্প হওয়ার জন্য প্রচুর শক্তি জমা হয়েছে। তাঁরা বলেন, হিমালয় পর্বতমালা থেকে যে কোন সময় ভূমিকম্প হতে পারে এ কথাটি বিশেষজ্ঞরা বার বার বলে আসছেন। সম্প্রতি তাঁরা জোর দিয়ে বলছেন যে কোন সময় এখান থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এর প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়তে পারে। বিশেষ করে মধ্য হিমালয়ে যেখানে চ্যুতিরেখার অস্তিত্ব রয়েছে তা ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে চার শ’ কিলোমিটার দূরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রের পরিচালক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, শিলং মালভূমির উত্তরে বিশাল ভূতাত্ত্বিক গ্যাপ রয়েছে। এ গ্যাপের উভয় পাশে গ্যাপ থেকে এ শতকে দু’বার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। এখন মধ্যবর্তী এলাকায় নতুন করে ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ১৯৫০ সালে হিমালয়ের অরুণাচল এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আর ১৯৩৪ সালে বিহার নেপালের দিকে হয় শক্তিশালী অন্য আরেকটি ভূমিকম্প। স্বাভাবিকভাবেই এ গ্যাপের মধ্যবর্তী অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছে হিমালয় পর্বতমালার। এলাকায় অতীতে বহুবার ভূমিকম্প হয়েছে যার কোন রেকর্ড নেই। এ ছাড়া ১৮৯৭, ১৯০৫, ১৯৩৪ এবং ১৯৫০ সালে এ এলাকা থেকে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। যার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ৯ রিখটার স্কেলের মধ্যে। বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার বিলহামও কয়েক বছর আগেই হিমালয়ের পাদদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন হিমালয় পাদদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্য যথেষ্ট ভূতাত্ত্বিক গ্যাপ রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে ৮ মাত্রার দুটি এবং ৭ মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের সংঘর্ষের কারণে নয়নাভিরাম হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি। তাঁদের মতে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তা, শ্রীলঙ্কান, আরব সাগর এবং বঙ্গোসাগর জুড়ে রয়েছে ভারত প্লেটের অবস্থান। ভারতের উত্তরে ইউরেশিয়া প্লেট। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বে মুজ্জাফরাবাদ থেকে শুরু হয়ে হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে ভারতের উত্তর-পূর্বে অরুণাচল-চীন সীমান্ত পর্যন্ত ২৫শ’ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এ প্লেটের অবস্থান। আর পূর্বে বর্মা প্লেটের সঙ্গে রয়েছে এর সংযোগ। এই সংযোগ উত্তরে অরুণাচল-চীন সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম পাশ দিয়ে এবং দক্ষিণে সুমাত্রা পর্যন্ত ৩ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
তবে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ভয়াবহ ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা করা হলেও বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়ের কারণ রয়েছে দেশের অভ্যন্তর থেকে সৃষ্ট ভূমিকম্পের ফলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে একাধিক ফাটলরেখা রয়েছে যা হিমালয় পাদদেশ থেকে সৃষ্ট ভূমিকম্পের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে সিলেটের ডাউকি ফল্ট বাংলাদেশের জন্য বেশি ভযাবহ বলে উল্লেখ করেন। এ ফল্টটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩শ’ কিলোমিটার বরাবর দীর্ঘ। মেঘালয়ের একটি শহরের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে ডাউকি ফল্ট। এটি মেঘালয় থেকে ক্রমেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে যত প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ভূমিকম্প। এটি কোন প্রকার আগাম সতর্কতা ছাড়াই আঘাত হানে। ভূমিকম্প কোটি কোটি বছর ধরে বিদ্যমান একটি চলমান ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যা দুটি প্লেটের সংঘর্ষে হয়ে থাকে। এর প্রলয়ঙ্করী আঘাতে পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। একমাত্র চীনেই ভূমিকম্পের আঘাতে মৃতের সংখ্যা ২৬ লাখ ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি ভূমিকম্পের ব্যাপকতা আরও বাড়ছে।
বিশেষ করে বিগত ৩০ বছরে ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়েছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। সম্প্রতি এ হার ক্রমেই বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন হিসেবে দেখা গেছে, ১৯শ’ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে ১শ’টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬০ সালের পর ৬৫টির বেশি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ হার আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভূমিকম্পের হার বাড়লেও রিখটার স্কেলের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কমই ছিল।
বাংলাদেশ ক্রমেই ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠছে। মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায়ই দুলে উঠছে। এসব ভূমিকম্প দেশের অভ্যন্তর থেকে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, আবার দেশের বাইরে হওয়া ভূমিকম্পের প্রভাবও পড়ছে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক এ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সাইসমিক ডিজাস্টার জরিপেও ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (টিআইটি) সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ভূমিতে বিভিন্ন প্রকারের মাটি (লাল মাটি, নরম মাটি ইত্যাদি) রয়েছে। ঢাকার সম্প্রসারিত অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা আবাসন এলাকা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের সময় নরম মাটি ও ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয়। গবেষকরা তাই ঢাকার বর্ধিতাংশের আলগা মাটি সমৃদ্ধ জনবসতিকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন।
No comments