ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস by মুহম্মদ শফিকুর রহমান

‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’ কথাটি বলেছেন ছাত্রলীগের জনক বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তখন সামনে সমবেত সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বিজয়ী বীররা। যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২৬তম জন্মদিনের অনুষ্ঠান। স্বাধীনতার প্রায় দুবছর এবং বিজয়ের এক বছর, চারদিকে চলছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ। আর এই পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের সবচেয়ে সাহসী তরুণ প্রজন্ম তথা সৈনিক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। বাংলার কাদামাটির সোঁদা গন্ধে পবিত্র। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে জন্মের ঋণ পরিশোধ করে ধন্য। এমন ভাগ্যবান প্রজন্ম কয়টি আছে একটি জাতির জীবনে, যারা দেশমাতৃকার সম্মান সমুন্নত রাখতে হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করতে পারে! না পেরেছে কেউ কোনকালে? পেরেছিল কেবল এই বাংলারই সন্তান ক্ষুদিরাম, অভিরাম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, ওয়াজিউল্লাহ, মনু মিয়ারা। তাদেরই উত্তরসূরি একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
তারা কারা?
তারা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। মুজিবের সৈনিকরা।
তারা কারা?
বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা।
তারা কারা?
বাংলাদেশের কিষান-কিষানীর সন্তানরা।
তারা কারা?
বাংলাদেশের প্রগতির চাকার সাহসী চালকরা।
তারা কারা?
বাংলার মা-বোনেরা।
তারা কারা?
অবরোধবাসিনীরা।
তারা কারা?
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, বেগম সুফিয়া কামালরা।
কী অসম সাহসে হেঁটেছে বাংলার মাঠ-ঘাট-পথে-প্রান্তরে। কাঁধে রাইফেল বুকে বল, সূর্যাস্তও থামাতে পারেনি যাদের, এগিয়ে গেছে সম্মুখপানে। ওরা (পাকি) ৩০ লাখ প্রাণ হরণ করেছিল, পৌনে ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল, জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, তবু প্রভাতের সূয ওঠা থামাতে পারেনি। মুজিবের সৈনিকদের থামিয়ে রাখা যায় না। সম্ভব নয়। আজও নয়।
এ লেখা যখন লিখছি তখন ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৬তম জন্মদিন বা ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করছে বাংলার ছাত্রসমাজ। কদিন আগে ২৯ ডিসেম্বর হয়ে গেল আওয়ামী লীগের ১৯তম কাউন্সিল অধিবেশন। সামনে ১০ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। এমনই প্রেক্ষাপটে এবারের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কিংবা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অতীতের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ববহ এ কারণে যে, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনেও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দেয়া ওয়াদাগুলো পূরণ করতে হবে। কোন কারণে যদি আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করতে না পারে তাহলে কী কী ভয়াবহতা সামনে আসতে পারে?
ক্ষমতায় আসবে পাকি-ফসিল থেকে জন্ম নেয়া বিএনপি এবং ধর্মের নামে অধর্ম চর্চাকারী জামায়াতে ইসলামী জোট।
প্রথমেই ওরা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেবে। বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধী গোলাম-নিজামী-মুজাহিদ, সাকা-সাঈদী, আলিম-জালিম-কাশেম আলীদের কারাগার থেকে বের করে এনে আবার তাদের গাড়িতে শহীদের রক্তরঞ্জিত পতাকা তুলে দেবে।
আবার হাওয়া ভবনের দরজা খুলবে।
আবার খোয়াব ভবনের দরজা খুলবে।
হাওয়ায়-খোয়াবে আবার জাতীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ চলবে।
আবার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি দখল হবে।
আবার বিদেশে পলাতক দুর্নীতিবাজ ম্যাডাম-সন্তানরা দেশে ফিরে আসবে।
আবার বিদেশে টাকা পাচার হবে।
আবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবে।
আবার খাদ্য ঘাটতি হবে।
শিবিরের তা-বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করবে।
পদ্মা সেতু হবে না।
বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ হবে।
আবার মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে!
আবার তারুণ্যের মডেল হবে শিক্ষার আলোবিহীন লুটেরা দাম্ভিক যুবা।
আবার জাতিগঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে।
আবার জাতি গঠন হবে লক্ষ্যহীন আদর্শহীন।
আবার জিডিপি নামবে ৫ শতাংশের ঘরে।
আবার মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা কেড়ে নেয়া হবে।
আবার নারীর ক্ষমতায়ন বন্ধ হবে।
আবার জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটবে।
আবার বাংলাদেশ হবে অস্ত্র ও মাদক পাচারের রুট।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হতে পারে তার কিছুটা আলামত এখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আমার এক বন্ধু একাত্তরের সহ-মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন লেকু জানালেন, কদিন আগে একটি টেলিভিশন নিউজে দেখানো হয়েছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘সরকার তাঁদের দাবি না মানলে আরেকটি ‘৭৫ হবে?’ এর অর্থ কী? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর কিছু নষ্টভ্রষ্ট অফিসারের নেতৃত্বে একটি বিভ্রান্ত সেনা দল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। সে রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাঁরা শহীদ হন তাঁরা হলেন বেগম ফজিলাতুন্নিছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ও তাঁর নবপরিণীতা বধূ আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল, দ্বিতীয় পুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ও তাঁর নবপরিণীতা বধূ রোজী জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেল (বয়স ৯ বছর), বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের আরও কয়েকজন, কর্তব্যরত সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জামিল ও অন্যরা। ড. খন্দকার মোশাররফ সে ইঙ্গিতই করেছেন। অর্থাৎ আরেকটি ’৭৫ হওয়া মানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। লেকু আমাকে জানিয়েছিলেন, টিভির নিউজটি সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছে। কয়েকটি কাগজ দেখে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবু খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম বন্ধু লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন ‘সপরিবারে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি, নিরপেক্ষ থাকার সময় এটা না’ শিরোনামে গত বৃহস্পতিবার দৈনিক জনকণ্ঠে যে কলামটি লিখেছেন তাতে নিউজটিও পেয়ে গেলাম। তাতে দেখলাম দৈনিক সমকাল নিউজটি ছেপেছে এভাবেÑ
‘খন্দকার মোশাররফ বলেছেন, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েম করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। এ সরকারও যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে তাঁদেরও ’৭৫-এর মতো পরিণতি বরণ করতে হবে।’
এ কেবল হুমকি নয়, এ এক ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। অথচ কেউ এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে প্রফেসর মামুন দেখিয়েছেন। না মধ্যরাতের গলাজীবীরা, না আওয়ামী লীগ ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী তথা সুশীলরা। আমিও প্রফেসর মামুনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘কোথায় ঐক্য-সাংবাদিকরা, কোথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গলাজীবী শিক্ষক আসিফরা, কোথায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়াস করিমরা (তাকে পিয়াজ করিম ডাকাটাই শ্রেয় হবে)?
এই ড. খন্দকার মোশাররফ মিয়া ম্যাডাম খালেদার মতো কখনও ‘বিএ পর্যন্ত পড়েছেন’ বা কখনও ‘স্বশিক্ষিত’, তা কিন্তু নন; রীতিমতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই মাস্টারী করেছেন, বিদেশের ডিগ্রী আছে ঝুলিতে। ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ যখন ডাকসুর ভিপি এখন সম্ভবত হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম ভিপি ছিলেন খন্দকার ড. মোশাররফ মিয়া। মহসীন হল ১৯৬৭ সালে ওপেন হয় এবং আমরা হলের প্রথম আবাসিক ছাত্র ছিলাম। মোশাররফ মিয়া ছাত্রলীগই করতেন। জিয়ার মিলিটারির চাপে অথবা অর্থবিত্তের লোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারী ছেড়ে হালুয়া-রুটির জগতে প্রবেশ করেছিলেন। বিএনপি নামক এই দলটি এভাবেই গড়ে ওঠে। এভাবেই নষ্ট ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, পাকি-ফসিল মুসলিম লীগ, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত বা লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী এতে ভিড় জমায়।
আমিও মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে একমত যে, এত বড় একটা হুমকি দেয়া হলো, অথচ তার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলবেন না, এটা কেমন করে হয়? কোন তদন্ত হবে না, এমনটি কি ভাবা যায়? আমরা কেন ভুলে যাব, এই মোশাররফরা ২০০১-২০০৬ ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল! আইভি রহমানসহ অনেকে সে হামলায় হতাহত হন।
এই ধরনের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করার কাজ ছাত্রলীগের। সে কারণেই আমি ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিষয়বস্তু করে লেখাটা শুরু করেছি। তবে প্রতিবাদের ধরনে যেন বিশ্বজিতের জীবন হরণ না হয়, বরং ছাত্রলীগ ১৯৪৮-৫২ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন থেকে শুরু করে, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, ’৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৬-৬৯-এর আগরতলা ষড়যন্ত্রবিরোধী আন্দোলন, ’৬৯-এর ৬+১১ দফাভিত্তিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো মুজিব বাহিনীর প্রতিবাদ দরকার। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ড. মোশাররফ এমন এক নেত্রীর নেতৃত্বে রাজনীতি করছেন যিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসে ভুয়া জন্মদিনের কেক কেটে স্যাডিস্টিক প্লেজার পান।
এদের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হতে হবে।
এই বিএনপিকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। কে না জানে খালেদা জিয়ার দুই সোনার ছেলের কথা! কী করে তারা লন্ডন-মালয়েশিয়ার মতো ব্যয়বহুল দেশে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গাড়ি-বাড়ি নিয়ে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেÑ এ প্রশ্ন কি কারও মনে আসে না? মধ্যরাতের গলাজীবীদেরও না! আশ্চর্য এই দেশ। এখানে যে যত বেশি অপকর্ম করবে রাজনীতিতে সে তত বেশি সাফল্য পাবে, অন্তিমে না পেলেও। নইলে শেখ হাসিনা যখন এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন তখন মনে হয় অপরাধ (?) করেছেন, তারেক-কোকোর ওই জীবন অপরাধ নয়, শেখ হাসিনার বলাটা অপরাধ? শুনেছি তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন এবং আছেন। কিন্তু ৫ বছর ধরে কী চিকিৎসা করাচ্ছেন? তাহলে তো বুঝতে হবে তার অবস্থা সঙ্গিন এবং তিনি শারীরিক-মানসিকভাবেই রাজনীতিতে অযোগ্য বলে ধরে নিতে হবে।
কী বলেছিলেন (সিলেটের জনসভায়) শেখ হাসিনা? আমি যে কথাগুলো এখন বললাম সেগুলোই আরও সফ্্ট্্ করে বলেছেন তিনি। অতীতেও একই কথা আমি বলেছি, খালেদা জিয়া যেদিন এক সমাবেশে বললেন, তাঁর ছেলেরা ‘সৎ, তাদের কোন সম্পদ নেই’Ñ ঠিক তার পরদিনই সিঙ্গাপুরে পাচার করা প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ফেরত আনে দুর্নীতি দমন কমিশন। আরও ৭ কোটি টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। তাহলে কি কমিশন মিথা বলেছে? সিঙ্গাপুরের সরকার এবং ব্যাংকইবা কেন এত বিশাল অঙ্কের টাকা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে ফেরত পাঠাবে?
অথচ অবাক করে দিয়ে বিএনপির ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এজন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
ছাত্রলীগ বসে আছে। ওরা কিন্তু বসে নেই। আমরা ভাগ্যবান প্রজন্ম এই অর্থে যে, ৬ দফাপরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকার এবং নেতাদের পেছনে চোঙ্গী ফোঁকার সুযোগ হয়েছিল। অবশ্য এতে আমার বা আমাদের প্রজন্মের কোন বিশেষত্ব নেই। এটা ঘটেছে ওই সময়টির কারণেÑ ক্যাম্পাসে ছিলাম বলে। তবে এটা ঠিক, আমাদের সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা নেতাদের পকেট হাতাত না বা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করত না। বাড়ি থেকে মা-বাবার পাঠানো টাকা বা স্কলারশিপের অর্থ বা টিউশনির পয়সা দিয়ে নিজের খরচ চালাত এবং রাজনীতি করত। মনে পড়ে, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেত্রী মমতাজ বেগম নিউমার্কেটের পাশের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ইনস্টিটিউটের হলে থাকতেন। তাঁর পাশের তৎকালীন আর্ট কলেজেরও বেশ কিছু ছাত্র থাকতেন। মমতাজ আপা তাদের দিয়ে রাতভর পোস্টার আঁকাতেন (তখন রঙিন পোস্টার ছাপার ছাপাখানা খুব কম ছিল) আর আমরা ভোরে গিয়ে তা নিয়ে ক্যাম্পাসে ও আশপাশের এলাকার দেয়ালে লাগাতাম। আর্ট কলেজের সেই সব ছাত্রের মধ্যে যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে তাদের মধ্যে রয়েছে সাধন বোস (দৈনিক ইত্তেফাকের চীফ আর্টিস্ট), সৈয়দ লুৎফুল হক (ইন্ডিপেন্ডেন্টের চীফ আর্টিস্ট) ও আবদুর রাজ্জাক (এক সময় বিটিভিতে ছিলেন)। অন্যদের নাম মনে নেই।
অথচ এখন নেতারাই নাকি ছাত্রদের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে লাগান। নিয়মিত ছাত্ররাও এই কর্মটি করেন বলেও শোনা যায় (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। মিলিটারি জিয়া যেভাবে ছাত্রদের চরিত্র হরণ করেছেন তার উত্তরসূরি মোনেম খাঁর মতো, হিজবুল বাহারে করে মেধাবী ছাত্রদের হাতে ডলার-গ্লাস তুলে দিয়েছিলেন যেমন করে মোনেম খাঁ এনএসএফ-এর গু-াদের জন্য শেরাটন-শাকুরায় টেবিল বুক করে রাখতেন। সেই ধারা ক্ষেত্রবিশেষে আজও অব্যাহত আছে। অথচ আমাদের সময় কোন নিয়মিত ছাত্রের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলে বা মাস্টার্স ডিগ্রী নেয়া হয়ে গেলে অন্য সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে রাজনীতি করতেন। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী নাকি এভাবে তিন সাবজেক্টে এমএ ডিগ্রী নিয়েছিলেন। অনেকে আবার এমএ ডিগ্রীর পর আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ক্যাম্পাসে থাকার চেষ্টা করতেন, জবরদখল করে নয়। আজকাল তো ক্যাম্পাসে থাকে জবরদখল করে এবং চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির রেট বাড়ানোর জন্য। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যার যত বেশি নাম ছাপা হবে পত্রিকার পাতায় তার রেটও তত বেশি বেড়ে যায়।
কিন্তু এটা ছাত্রলীগের ইতিহাস নয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে হয় ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস’ এবং এ ইতিহাস রচিত হয়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। অর্থাৎ ত্যাগের ইতিহাস। আগেই বলেছি ছাত্রলীগের জন্মই হয়েছে আন্দোলনের মাঝে, আওয়ামী লীগের এক বছর আগে (আওয়ামী লীগের জন্ম হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন)। সেই থেকে ছাত্রলীগ ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন করে বাঙালী জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে-সংগঠনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের।
আজ আবার সময় এসেছে ছাত্রলীগকে তার ৬৫ বছরের ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারায় অবতীর্ণ হওয়ার। কারণ ’৭৫-এর প্রতিবিপ্লবী পাকি-রাজাকার-আলবদর শক্তি এবার কতগুলো কারণে অনেক বেশি উগ্র, অনেক বেশি জঙ্গী। এই যেমন :
* চলমান যুদ্ধাপরাধীদের আজকের বিচার কার্যক্রম শেষ হবে। রায় কার্যকর হবে এ বছরই।
* যে কারণে বিএনপির রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবে (এরই মধ্যে শুরু হয়েছে, দূষিত রক্ত কতদিন ধমনীতে ধারণ করা যায়)।
* এসব কারণে বিএনপিও আগামী নির্বাচনে আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। যে তরুণ প্রজন্ম ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ম্যান্ডেট দিয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য, সেই তরুণরাই রায় হয়ে যাওয়ার পর বছর শেষে অনুষ্ঠিতব্য ১০ম পার্লামেন্ট নির্বাচনেও শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য।
* ছাত্রলীগ নিশ্চয়ই দেখেছে কিভাবে শিবির দাড়ি-টুপির পরিবর্তে ক্লিন সেভ করে, জিন্স-টিশার্ট, কেড্স পরে প্রকাশ্য রাজপথে কখনও চোরাগোপ্তা কখনও সরাসরি পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে, কখনও গাড়ি জ্বালাচ্ছে, ভাংচুর করছে। এমনকি এই অপশক্তি নববর্ষের শুরুতেও মালিবাগে জঙ্গী তৎপরতা প্রদর্শন করেছে। এসবকে হেলাফেলা করার কোন সুযোগ নেই।
কাজেই ছাত্রলীগকে এসব বিষয় ভাবতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা কি ৬৫ বছরের গৌরব ও ঐতিহ্য অনুযায়ী তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দেবে, নাকি পেছনে পেছনে হাঁটবে?

ঢাকা, ৩ জানুয়ারি, ২০১৩
লেখকÑ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.