পাঠশালায় হাতেখড়ি by রবিউল হুসাইন
ছোটবেলা আসলে সবার জন্য বড় বেলা। বয়স বাড়ার সঙ্গে বয়স কিন্তু কমে যায়, তাই না। অর্থাৎ একজন যতদিন বাঁচে সেই সময়ের দৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে। সেই হিসেবে ছোটবেলায় সবার মতো আমারও অনেক বড় বেলা আর অনেক সময় ছিল।
এখন তা কমে শূন্যের কোঠায় যাওয়ার আর বেশি দেরি নেই। তবে এই সময়ে সেই ছোটবেলা নামক বড় বেলার কথা খুব মনে পড়ে। জীবনের জন্য সেই সময় ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর নানান রূপ-বৈচিত্র্য, মানুষ, পশু-পাখি, জীবজন্তু, গাছপালা, নদী-খাল, বিল-হাওড়, ফুল-ফল, আকাশ-বাতাস, ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-জোছনাÑযা যা দেখি তাই দেখে রাতে দিনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। আর শুধু একে-ওকে জিজ্ঞেস করি এটা কী, ওটা কী, সেটা কেন ইত্যাদি। মনে হয় সেই বয়সটা শুধু জিজ্ঞাসার এবং এই জিজ্ঞাসার আকুতি বা ইচ্ছা কখনও শেষ হবার নয়, সারাটা জীবন ধরে বহমান। জানার ইচ্ছাটাই হচ্ছে জ্ঞানলাভের প্রাথমিক পর্যায়। তাই প-িতেরা বলে থাকেন, নিজেকে জানো, তাহলে সব জানতে আর বুঝতে পারবে। এই পর্যায়ে যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়স তখন আমাকে পাঠশালায় ভর্তি করার ব্যবস্থা হলো। আর আমার সে যে কী ভয়! মাকে ধরে কান্নাকাটি, আমি কিছুতেই স্কুলে যাবো না। শেষে বাবা আমাকে কোলে তুলে তখনকার কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গায় সেই ১৯৪৯-৫০ সালের কথা, মানে ৬৪ বছর আগের স্মৃতি-সেখানকার পাঠশালা বা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। হেড প-িত আমাকে আদর করে বললেন, রবি তুমি কান্নাকাটি করো না, তুমি থাকো, খেলাধুলা করো, ওই দেখ ছেলেমেয়েরা ঘোরাফেরা করছে, তুমিও ওদের সঙ্গে যোগ দাও। আমি তো আরও কান্নায় ভেঙে পড়ি। আব্বা তো হেসেই আকুল। আমাকে আবার হাত ধরে এদিক ওদিকের গাছ-পালার ভেতর নিয়ে বলেন, ওই দেখ গাঁদা ফুল, এইটে নিম গাছ, এটা নারকেল, এটা সুপারিÑএইসব। সামনে একটা জলটলমল পুকুর। পুকুরের পাড়ে সান বাঁধানো সিঁড়িওয়ালা ঘাট। সবুজ-শ্যাওলা পানির নিচে এর ভেতরে ছোট ছোট মাছ লেজ নাড়িয়ে ঘোরা-ফেরা করছে। কাছেই একটা ব্যাঙ গলা ফুলিয়ে ডাকছে। পাশের একটা জবা ফুল গাছে মৌমাছি উড়ছে। হঠাৎ করে একঝাঁক টিয়া পাখি বাতাসে ঢেউ তুলে চলে গেলÑমনে হলো এক বাতাসের ঝাপটা, শরীর ছুঁয়ে গেল। এর মধ্যে হেড প-িত এসে হাজির। পুকুরের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। ততক্ষণে আমার কান্না থেমে গেছে। চারদিকের সবুজ গাছ, আকাশের সাদা মেঘ, পুকুরের স্বচ্ছ পানি, বাবার কাছাকাছি থাকা, ছেলেমেয়েদের হুটোপুটি, হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি আমাকে নির্ভয় করে তুলেছে। হেড স্যার বললেন, তোমার এখন পড়াশোনার হাতেখড়ি দেয়া হবে। কোন ভয় নেই। আমি যা যা বলব, শুধু তুমি তাই করবে। আমি বাবার দিকে তাকাই। চারদিকে অন্যসব ছেলেমেয়ে খুশিতে ডগমগ। তাদের জন্য যেন একটা মজার ব্যাপার। স্যারের হাতে একটা বাঁশের ঝাঁপি। তার ভেতরে সবুজ কলাপাতার ওপর সাদা খৈ, গুড়ের কয়েকটা বাতাসা আর একটা লাল জবা ফুল। আমার হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়ে স্যার বললেন এখন তুমি এই পাত্রটা নিয়ে পুকুরের একেবারে পাশে এসে দাঁড়াবে। তারপর দুই হাতে ধরে ওই খৈ-ভর্তি ঝাঁপিটা পুকুরের ভেতর ছুড়ে ফেলে দেবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখবে আস্তে আস্তে সেটা পানিতে ডুবে যাচ্ছে আর এরপর তুমি পেছনে ফিরে চলে আসবে। তবে শোন, খবরদার পুকুরের দিকে পেছন ফিরে আর ঘাড় ঘোরাবে না তার মানে ঝাঁপি পুকুরে ফেলে দিয়ে সোজা চলে আসবে পেছনের দিকে না তাকিয়ে। বুঝেছো তো, খুব সহজ, কেমন। এবার যাও, যা যা যেমন করে বললাম, তাই তাই করো, এই নাও ঝাঁপি। আমি তো ভয়ে আবার ঘাবড়ে গেলাম। বাবা সাহস দিয়ে বললেন, যাও কোন অসুবিধা নেই। আমি তো আছি। গুটি গুটি পায়ে আমি পুকুর পাড়ে গিয়ে ঝাঁপি ধরে পানিতে সব ছুড়ে ফেলে দিলাম। আশপাশের ছেলেমেয়েরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু যা হবার তাই হলো। স্যার যেটা করতে বারণ করেছিলেন আমি তাই করে বসলাম, মানে ঝাঁপিটা ফেলে আমি পেছন ফিরে যে-ই তাকিয়েছি খুব কৌশলে আর অমনি স্যার বলে উঠলেন আরে তুমি যে পেছনে তাকালে! এই কথা শুনে প্রিয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে ওই যে আমার কান্না শুরু হলোÑতা বাসা পর্যন্ত গিয়ে মাকে দেখে থামল।সেই কত আগের কথা। আজ এই পড়ন্ত জীবনে এসে মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। মানুষের জীবন এক রৈখিক অর্থাৎ ওয়ানওয়ে ট্রাফিক। যেটা অতীত হয়ে গেছে তা আর কখনও ফিরে আসবে না। তাই আমাদের স্বপ্ন গড়তে হবে ভবিষ্যতের আশায়, অতীতকে নিয়ে বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে, তাই নয় কী!
অলঙ্করণ : শাহ্রিন আক্তার
No comments