দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন- পানি সম্পদ সম্মেলন
গঙ্গা বহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর অববাহিকাসমূহে বাংলাদেশ ভারত চীন নেপালের প্রায় ১শ’ কোটি লোক বসবাস করে। এসব অববাহিকা রাজনৈতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হলেও পানি ও পলিমাটির প্রবাহ এবং অংশীদার সকল দেশের জন্য ন্যায্য ব্যবহারের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
শুক্রবার দক্ষিণ এশিয়ার পানি সম্পদ: বৈরিতা থেকে সহযোগিতা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে। সম্মেলনে আগত অতিথিরা বলেন, পানি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহে এ যাবত একক বিচ্ছিন্ন ধারায় অগ্রসর হয়েছে। প্রতিটা দেশ পানি সম্পদ নিজ সীমানার ভেতরে সর্বাধিক ব্যবহারে সচেষ্ট হয়েছে। প্রতিবেশী অংশীদার দেশসমূহের সঙ্গে সমন্বয়ের কোন চেষ্টা করেনি। কিন্তু এ ধারা পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার অর্জনের সহায়ক হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে তা সংঘাতের সৃষ্টি রয়েছে।এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার নদী অববাহিকাভিত্তিক এবং বহুদেশীয় সহযোগিতার অভাবে পানি ভাগাভাগি ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি করছে। নদী দূষণ নৌ পরিবহন, বন্যা খরা, প্রশমন পলিমাটির প্রবাহ, ভূগর্ভস্তরের পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার এবং সুন্দরবন রক্ষাসহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এতে উঠে আসে চীন ও ভারতে এককভাবে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি। বলা হয় চীনে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরাংশ থেকে পানি সরিয়ে আরও উত্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চীনের এমন পদক্ষেপে ভাটির দেশ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক তেমনি উজানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত বিভিন্ন নদ নদীর ওপর পানি প্রত্যাহারকারী এবং প্রবাহ নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য কাঠামো নির্মাণ করছে। ফরাক্কা বাঁধের ফলে গঙ্গা নদীর পানি পদ্মা থেকে ভারতের ভাগিরথী হুগলি নদীতে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গজলডোবা বাধ দ্বারাও ভারত তিস্তা নদীর পানি অপসারণ করছে। বকরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করার কাজে অগ্রসর হচ্ছে। এসব একক প্রকল্পের ওপর যোগ হয়েছে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। সম্মেলনে বলা হয় পানি অপসারণকারী এসব প্রকল্প ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি সম্পদ ব্যবহারে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক কাঠামোতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক কাঠামো প্রয়োজনীয় সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। নদ নদী বিষয়ে ভারত বাংলাদেশ ও ভারত নেপালের মধ্যকার বিভিন্ন বিরোধ যেমন রয়ে গেছে তেমনি ব্রহ্মপুত্র বিষয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিরোধ বিশেষ শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট নিরসনে সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পানি সম্পদ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
শুক্রবার সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পানির ব্যবহারে অধিকার সবার রয়েছে। এক্ষেত্রে এমন কিছু করা ঠিক নয় যাতে ভাটিতে বসবাসকারীরা তাদের পানি প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বিশ্বে পানি সমস্যা অন্যতম উল্লেখ করে বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে ন্যায্য পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বৈরিতা কারও কাম্য নয়। পানি ব্যবহারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অর্থনৈতিক ও শিল্পন্নোয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানির চাহিদাও বাড়ছে। পাশাাপাশি পানির প্রাপ্তিও কমে আসছে। আগে যেখানে সারা বছর পানি পাওয়া যেত এখন সেভাবে পানি পাওয়া যায় না।
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে আয়োজিত দু’দিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার পানি সম্পদ বৈরিতা থেকে সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ ইনভাইরনমেন্ট নেটওয়ার্ক বেন এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপানের বিশেষজ্ঞ ও অনুরাগী যোগ দেন।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ড. হাছান মাহমুদ আরও বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলেও পানির প্রাপ্তি আগের চেয়ে অনেক কমে যাচ্ছে। সবার বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তাও দিনে দিনে কমছে। ফলে পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে দেশে বিদেশে সৃষ্টি হচ্ছে বৈরিতা। বাংলাদেশের সঙ্গে ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও বৈরিতা বিরাজ করছে। কিন্তু উভয় দেশেই এখন উপলদ্ধি শুরু হয়েছে বৈরিতা নয় সমঝোতার ভিত্তিতেই পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত বাংলাদেশের পানি ভাগাভাগি নিয়ে বৈরিতা অনেক কমে এসেছে। গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে। পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের উপলব্ধি সৃষ্টি হলে বৈরিতা নিরসনে সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিবেশের ওপর অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছে। নদী ও পানি দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আগে যেখানে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে বছরের এক লাখ টাকাও জরিমানা করা কঠিন ছিল সেখানে এ সরকার প্রায় ১শ’ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে। দূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হয়নি। দূষণকারীরা যত বড় শক্তিশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিক হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ সরকার পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা পালনকারীদের পরিবেশ পদক প্রদান শুরু করেছে। এমনকি যারা এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করছে তাদের পুরুস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। সরকার ক্ষমতায় এসেই একজন ভিক্ষুককে পরিবেশ পদক প্রদান করা হয়েছে, যে কিনা ভিক্ষা করে গাছ রোপণ করত।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বুয়েটের ভিসি ড. এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিরাট জনগোষ্ঠী সুপেয় পানির প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বিভিন্ন কারণে নদী ও অন্যান্য উৎসের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। ভূগর্ভস্তরের পানি নিচে নেমে সেখানে আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। মৎস্য ও কৃষি কাজের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টির পানি পর্যাপ্ত হলে তা কোন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা কোন প্রকার বর্জ্য শোধনাগার ছাড়াই চলছে। ফলে ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। দূষণরোধে পরিবেশ আইন থাকলেও কার্যকর করা যাচ্ছে না। পানির দূষণরোধে তিনি সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বাপার সভাপতি এএসএম শাজাহান বলেন, পৃথিবীতে পানির অপব্যবহারের কারণে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন কারণে নদ নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতার কারণে নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দখল দূষণে নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বের পানির প্রাপ্তি হুমকির মুখে পড়ছে। এর বিরুদ্ধে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ড. মো. খালেকুজ্জামান ও বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন।
No comments