রাজা পাইলাপ্রু মং সার্কেলের ঐতিহ্যের প্রতীক
রাজা পাইলাপ্রু“চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সার্কেলের ঐতিহ্যের প্রতীক। পাহাড়ের শান্তি স্থাপনের পাহাড়ী ও বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু বন্ধনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত ২০০৮ ইং সনের ২২ অক্টোবর পাহাড়ের মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তার অকাল এ মৃত্যুটি কেউ মেনে নিতে পারেনি। বাসচালকের অসর্তকতার কারণে পাহাড়ের এই প্রিয় রাজাকে অকালে হারাতে হলো।
স্বল্পভাষী উজ্জ্বল অবয়বের একজন সরল ছায়া ঘেরা মানুষ হারানোর বেদনায় পাহাড়ের মানুষ অস্তির হয়ে উঠেছিল। যদিও রাজা পাইলাপ্রু“ চৌধুরী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ছিলেন তবুও তিনি ছিলেন বাঙালীদের কাছে প্রিয়। অনুরূপভাবে তিনি চাকমা, ত্রিপুরা, হিন্দু, বড়–য়া, খ্রীস্টান সকল সম্প্রদায়ের কাছে ছিল প্রিয়। সাদা মনের মানুষ হিসেবে সকলের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধারপাত্র। তিনি অপ্রিয় কোন আচরণ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত তার নিন্দুক যারা তারাও কোন দিন তুলতে পারবে না। উদার, মুক্তমনের পরিমিত ভাষী একজন সাদা মনের মানুষ এ পৃথিবীতে আয় হয়ত আসবে না। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির মেল বন্দন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় এবং পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এ ছিল তার অজেয় মনের সুপ্ত দৃষ্টিভঙ্গী।রাজা পাইলাপ্রু“ চৌধুরী সবসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতেন। মৃত্যুর আগেও তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উন্নয়ন সম্ভাবনা শীর্ষক এক সেমিনার থেকে জ্ঞান অর্জন করে এসছিলেন। ইউএনডিপি’র আন্তর্জাতিক এই সেমিনারটির আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু রাজা প্রাইলাপ্রু“চৌধুরী তার অর্জিত জ্ঞানটি আর পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। ২০০৮ সনের ২১ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে তিনি তার প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসার জন্য ছিলেন বেকুল। ঐ দিন রাত ১২টায় তিনি নৈশ্য কোচ সৌদিয়া ওঠেন খাগড়াছড়ি আসার জন্য। এর আগে প্রিয় পিতা রাজা পাইলাপ্রু“ চৌধুরীকে এগিয়ে আনার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন যুবরাজ সাচিংপ্রু চৌধুরী কিন্তু যুবরাজ সাচিংপ্রু“জানতেন না পিতাকে তিনি জীবিত অবস্থায় আর নিজ প্রসাদে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। ২২ অক্টোবর সকলটি যেন অপেক্ষা করছিল পার্বত্যবাসীর কাছে কোন এক দুঃসংবাদে জন্য। এদিন ভোরে যখন নৈশ কোচটি পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে আসছে তখন ভোরের শিবির ভেজা শীতল বাতাসে বাসের সকল যাত্রীই ছিল প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। এই তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমঘুম ভাব নিয়ে বাসচালক যখন গাড়ি চালাচ্ছিল তখনই ঘটে গেল এক ভয়যাবহ দুর্ঘটনা। জেলার রামগড় উপজেলার কালাডেবা এলাকার পাগলা পাড়া নামক স্থানে বাসটি গতিনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ২ শত ফুট গভীর খাদে পড়ে যায়। আর এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় পাহাড়ের প্রিয় মানুষ মংরাজা পাইলাপ্রু“চৌধুরী। এ সময় তার একমাত্র প্রিয় পুত্র যুবরাজ সাচিংপ্রু“চৌধুরী ও মারাত্মক আহত হয়। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। জ্ঞান ফিরে জানতেন না তার প্রিয় পিতা আর এ পৃথিবীতে নেই। যাকে তিনি ঢাকা থেকে নিজ প্রসাদে নিয়ে আসে গিয়ে ছিলেন ঢাকায়। সুদূঢ় অস্ট্রেলিয়া থেকে তিনি নিরাপদে ফিরে আসলেও নিজ দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে আর জীবিত অবস্থায় রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে পারলেন না রাজা পাইলাপ্রু“ চৌধুরী। পুত্র সাচিংপ্রু“চৌধুরী পিতাকে ঠিকই রাজবাড়িতে নিয়ে আসলেন তবে জীবিত নয়, পিতার নিথর দেহটিকে নিয়ে।
মৃত্যু যে তাকে এভাবে ছিনিয়ে নেবে, তার স্বপ্নের সম্ভাবনা বীজ বোনা বন্ধ করে দেবে, এ কথা রাজা পাইলাপ্রু চৌধুরী যেমন জানতেন না। তেমনি পাহাড়ের সহজ সরল মানুষগুলোও জানেননি। যমদূত যেন ছোঁ মেরে তার শান্তির বার্তাটি ছিনিয়ে নিল। ২২ অক্টোবর সকালটি যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিকের জন্য একটি দুঃসংবাদ হয়ে উঠল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সার্কেলের জনসাধারণের সামাজিক ব্যবস্থা এবং জীবনযাপন কেন্দ্রীভূত হয়েছে মং রাজার শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে। এই শাসনব্যবস্থার কারণে মারমা জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। মারমা জাতির ঐতিহ্যবাহী এবং ঐতিহাসিক জীবন ধারার প্রতীক মংরাজা। মারমা জাতির ইতিহাসে রাজাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজার নেতৃত্বের হেডম্যান ও কারবারিদের মাধ্যমে মারমা সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
রাজা পাইলাপ্রু চৌধুরী মারমা জাতির এক ক্লান্তিলগ্নে রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠ হন। প্রয়াত মংচীফ রাজা মংপ্রু“সাইনের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার মনোনয়ন নিয়ে যখন মারমা জাতিগোষ্ঠী অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন মারমা জাতীর দিকপাল হিসেবে রাজা পাইলাপ্রু“চৌধুরী রাজবংশের রক্তের ধারা নিয়ে বেরিয়ে আসেন।
মং সার্কেলের ষষ্ট রাজা মংপ্রু“ সাইন ছিলেন নিঃসন্তান। ১৯৮৪ সনে তিনি মারা গেলে তার সহধর্মিণী রানী নীহার দেবী মং সার্কেলের ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৯১ সনে রানী নীহার দেবী বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলে তৎকালীন সরকার মং রাজা পরিবারের উত্তরাধিকার বিবেচনায় রাজা মংপ্রু“সাইন’র ভাই ক্যাসোয়েউ চৌধুরীর পুত্র পাইলাপ্রু“চৌধুরীকে মং সার্কেলের ৭ম রাজা হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৯৮ সনের ২৭ অক্টোবর তিনি মং সার্কেলের ৭ম রাজা হিসেবে শপথ নেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাঁর শপথ গ্রহণের দিনের তারিখই অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর ২০০৮ ইং সনে অনুষ্ঠিত হয় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। তাঁর ১০ বছরের মং সার্কেল শাসনকালে তাঁকে নতুন করে সবকিছু তৈরি করতে হয়েছে। প্রথমত, তাকে সাবেক মং রাজপ্রাসাদটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে খাগড়াছড়িতে। শহরের ‘জিরো’মাইল এলাকায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মাণ করতে হয়েছে নতুন রাজবাড়ি। এছাড়া গঠন রতে হয়েছে রাজপ্রহরী বা সৈন্য। একটি নতুন কিছু করার মানসিকতা নিয়ে যখন তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই সৃষ্টিকর্তার নিষ্ঠুর নির্দেশে তাঁকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি জীবিত অবস্থায়ই বলতে তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন পরবর্তী রাজা অর্থাৎ রাজপুত্র সাচিংপ্রু চৌধুরী।
রাজা পাইলাপ্র“ চৌধুরী ১৯৬০ সালের ২৩ শে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের অর্পনাচরণ চৌধুরী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তাঁর বড় ভাই সুয়েথোয়াই চৌধুরী ও বড় বোন উক্রইঞো চৌধুরী বার্ধক্যজনিত করনে ইতিপূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পিতার ক্যসোয়েউ চৌধুরী ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর মাতার নাম বুলু চৌধুরী।
রাজা পাইলাপ্র চৌধুরীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় খাগড়াছড়ি সরকারী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৭৫ সনে তিনি খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৭ সালে খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭৯ সনে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮০ সনের ২২ জানুয়ারী তিনি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গোলাবাড়ী এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক মংথু চৌধুরী ও চিংম্রা চৌধুরীর কন্যা মাধবী লতা চৌধুরীর সাথে পরিনত সূত্রে আবদ্ধ হন। রাজা পাইলাপ্র“ চৌধুরী ৩ সন্তানের জনক তাঁর ১ম কন্যা উমাচিং চৌধুরী, ২য় কন্যা উনুচিং চৌধুরী ও ৩য় সন্তান রাজপুত্র সাচিংপ্র“ চৌধুরী। বড় রাজকন্যা উমাচিং বিবাহিত। ১৯৮০ সনে তিনি তৎকালীন রামগড় মহকুমার জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৩ সনের ৭ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলায় উন্নীত হলে তিনি খাগড়াছড়ি জেলায় জেলা তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্নাঢ়্য কর্মজীবনে অধিকারী রাজা পাইলাপ্র“ চৌধুরী ২০০৬ ইং সনের ১১ মার্চ খাগড়াছড়ি জেলা শহরের এক বর্নাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় মং সার্কেলের রাজা হিসেবে প্রথম রাজপূন্যাহ অনুষ্ঠান করেন। ঐ দিনে তিনি রাজপ্রহরীর গার্ড এফঅনারের মাধ্যমে রাজ পোষকে সজ্জিত হয়ে ঐতিহাসিক তলোয়ার ধারন করে ৭ম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন।
Ñজীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি
No comments