পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অনন্য উৎসব
রাজপুণ্যাহ পার্বত্য চট্টগ্রামের এক অনন্য উৎসব। চাকমা, মারমা ও বোমাং সার্কেলের রাজারা তাঁদের প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে বছরে একবার এই পুণ্যার আয়োজন করে থাকেন। রাজা পুণ্যা পার্বত্য মানুষের প্রাণপ্রিয় অনুষ্ঠান।
শীতের তিথিতে কিংবা শীত ছুঁবে এমন কোন দিন রাজ পুণ্যার আয়োজন করা হয়। দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার পাহাড়ী নর-নারী, শিশু-কিশোর দুর্গম পাহাড়ী পথ ভেঙ্গে এসে ভিড় জমায় রাজবাড়িতে। এ সময় মৌজাপ্র্রধান, পাড়াপ্রধান সবাই আসেন। বিগত এক বছরের জুমের উৎপাদিত ফসলের কর দিতে সহজ সরল পার্বত্যবাসীরা রাজদরবারে আসে। রাজা প্রজাদের সম্মিলন এবং বিনোদনে তাদের মন ভরে দিতে আয়োজন করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার। মেলা বসে। বেচাকেনা হয়। লোকে থাকে লোকারণ্য। ঐতিহ্যময় সাংস্কৃিতক দল-পালাগান, যাত্রা অভিনয় করে থাকে। প্রতিবছর সেই অনেক আগে থেকেই রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে রাজ পুণ্যা মেলা হয়ে আসছে।বছরের খাজনা আদায় এবং প্রজাদের সঙ্গে রাজার সম্মিলনের আন্তরিক ইচ্ছে নিয়ে পাহাড়ের তিন রাজা রাজ পুণ্যার ব্যবস্থা করে আসছেন। বাংলাদেশে শুধুমাত্র চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল ও বোমাং সার্কেলে আজো এই ঐতিহ্যবাহী ‘রাজ পুণ্যা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এ সময় তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত মেলাও হয়ে থাকে। পুণ্যার দিনের প্রতীক্ষায় প্রতিবছর প্রহর গোনে সরলপ্রাণ জুমিয়ারা। একদিকে জুমের কর দেবে আর অন্য দিকে রাজাকে এক নজর দেখে আসবে এই অভিব্যক্তি নিয়ে তারা ছুটে আসে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে হেঁটে রাজবাড়ির মাঠে। রাতভর উপভোগ করে সেই পুরনো দিনের পালানুষ্ঠান। সরলপ্রাণ এসব মানুষের মনে আজো এই বিশ্বাস রয়েছে যে, এক নজর রাজার দেখা পেলে আগামী দিনগুলো যাবে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে। সমৃদ্ধি ফিরে আসবে ঘরে। তাই চারদিকে থেকে পাহাড়ী পল্লীর এসব মানুষ তাদের প্রিয় রাজার জন্যে বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসে। রাজ পুণ্যা তিন পার্বত্য জেলার জনগোষ্ঠীর এক প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী প্রধান উৎসব, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পুণ্যাকে পার্বত্যবাসী আশ্রয় হিসেবে ধরে নিয়ে থাকে। রাজপুণ্যা উপলক্ষে বর্তমান রাজাত্রয় আজো তাদের পূর্বসূরিদের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। রাজারা তাঁদের সভাসদ নিয়ে রাজবাড়িতে বৈঠকে বসেন। খোঁজ খবর নেন গোটা অঞ্চলের। সোনালি কারুকাজে খচিত সুসজ্জিত রাজা যখন রাজবাড়ি থেকে সভাস্থলে আসেন, তখন উৎসুক প্রজারা রাজাকে এক নজর দেখার অধীর আগ্রহে চঞ্চল হয়ে ওঠে। সিপাহি পাইক পেয়াদা সভাসদ নিয়ে রাজা নেমে আসেন। রাজার চলার পথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো থাকে কিশোর-কিশোরীরা। রাজা হাঁটছেন ছাতার ছায়াতলে অগ্রভাগে সিপাহি। বিউগলের উচ্চকিত শব্দ দোলা দেয় অভ্যাগত মানুষের হৃদয়ে। রাজার চলার পথে ছিটানো হয় ফুল আর ফুলের পাপড়ি। বছরের একটি মুহূর্তে তাই পার্বত্যবাসীর কাছে অনেক প্রতীক্ষার, অনেক আকাক্সক্ষার সোনালি স্বপ্ন। প্রতিবছর রাজপুণ্যার রাজস্ব আদায়ের এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে তিন পার্বত্য জেলায় প্রচুর দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে ।
Ñজীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি
No comments