অভিযাত্রীর ডায়েরি- দেশের নামে হিমালয়ের শৃঙ্গ by এম এ মুহিত
হিমালয়ের একটি শৃঙ্গ আছে, যে পর্বতশৃঙ্গের নাম ‘নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর’। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেছি দু-দুবার। জয় করেছি ছোট-বড় আরও কত পর্বত। সব অভিযানই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, রোমাঞ্চকর ও অবিস্মরণীয়।
কিন্তু আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে যে অভিযানটি তার নাম, ‘নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর’ অভিযান।
২০১০ সালের কথা। তখন আমরা ইনাম আল হকের নেতৃত্বে বিএমটিসি ক্লাবের (বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব) সদস্যরা হিমালয়ে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিচ্ছি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, হিমালয় পর্বতে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের নামটি স্থাপন করা। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব! বিশ্ব রেকর্ডধারী পর্বতারোহী পেম্বা দর্জি শেরপা সেই সম্ভাবনার দ্বারটি খুলে দিলেন একদিন। পেম্বা জানান, পৃথিবীর কোনো মানুষ কখনো আরোহণ করেননি, এমন এক শৃঙ্গে বাংলাদেশ ও নেপালের পর্বতারোহীরা যৌথ অভিযান চালাতে পারে এবং তা সফল হলে পর্বতশৃঙ্গটির নাম হবে নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর। ইতিপূর্বে চীন ও জাপানের সঙ্গে এ ধরনের দুটি সফল অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের (এনএমএ) সভাপতিকে তখন থেকেই চিঠি লেখা শুরু। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উত্তর আর আসে না। অবশেষে ২০১০ সালের আগস্টে প্রতীক্ষিত সেই ই-মেইলটি এল। এনএমএর সভাপতি জিম্বা জাংবু শেরপা লিখেছেন, নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত ২০ হাজার ৫২৮ ফুট (ছয় হাজার ২৫৭ মিটার) উঁচু ‘চেকিগো’ নামের অ-বিজয়ী শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। অনুমোদন তো পাওয়া গেল; এখন অজ্ঞাতনামা এই চেকিগো শিখরে অভিযান পরিকল্পনা করব কী করে! এনএমএর তথ্যমতে চেকিগো শিখরে ইতিপূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে; কিন্তু সবই ব্যর্থ। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যানই বলছে, চেকিগো কত কঠিন ও ভয়ংকর এক শিখর। তার পরও কথা আছে। অভিযান পরিচালনার জন্য অর্থের সংস্থান। ভাগ্য ভালো বলতে হয় আমাদের। অর্থের জন্য খুব একটা বেগ পেতে হলো না। কসমস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ইউএনবির সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান অভিযানের অর্ধেক ব্যয় বহন করতে রাজি হলেন। বাকি অর্ধেক ব্যয় বহন করার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলেন প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান। আমরা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে ছয়জন ও নেপাল থেকে সাতজন অভিযাত্রীর অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা হলো। নেপাল দলের নেতৃত্ব দেবেন পেম্বা দর্জি শেরপা। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হলো। বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন নিশাত মজুমদার, সাদিয়া সুলতানা, সজল খালেদ, নুর মোহাম্মদ ও কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব। আর নেপাল দলের সদস্যরা হলেন মিংমা গ্যালজে শেরপা, দা-কিপা শেরপা, মিংমা দর্জি শেরপা, দাওয়া ইয়াংজুম শেরপা, সুস্মিতা মাসকে ও নাওয়াং ফুটি শেরপা।
অভিযানের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ১ অক্টোবর। নিশাত, সাদিয়া, সজল, নুর, মজনু আর আমি কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লাম। অতঃপর নেপাল যখন পৌঁছালাম, তখন পেম্বা দর্জি শেরপা ও নেপাল দলের সব সদস্য কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে ঐতিহ্যবাহী শেরপা রীতিতে আমাদের গলায় কাঁথা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এবার সত্যিকারের অভিযানের পালা। ৫ অক্টোবর, ২০১০, সিংগাতি থেকে বেদিং পর্যন্ত আমাদের অনেক ঝুলন্ত সেতু পার হতে হলো; এর কয়েকটি ছিল কাঠের তৈরি আর নড়বড়ে। অবশেষে চার হাজার ৫৪০ ফুট উঁচুতে যখন পৌঁছাই, সূর্য তখন মাথার ওপর। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হলো আমাদের দ্বিতীয় দিনের ট্রেকিং। আজকের গন্তব্যের নাম সিমিগাঁও। আড়াই ঘণ্টা পর যেখানে পৌঁছালাম, তার নাম ‘ছ্যাত-ছ্যাত’। ছ্যাত-ছ্যাত থেকে সিমিগাঁও পৌঁছতে বেজে গেল বেলা তিনটা। এই পৌঁছানোটা ছিল বেশ কষ্টকর। সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, সঙ্গে খাড়া ঢাল বেয়ে উত্তরণ। সিমিগাঁওয়ের উচ্চতা প্রায় ছয় হাজার ৯০০ ফুট। ৭ অক্টোবর ২০১০। আজ আমাদের গন্তব্য ডংগং। তামাকোশি নদীর একটি উপধারার পাশ দিয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠতে থাকি। বেশ কিছু জায়গায় জোঁকের উপদ্রবের শিকার হয়ে অনেকেরই রক্ত ঝরল। এ রকম নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আট হাজার ৮৫০ ফুট উঁচু ডংগংয়ে পৌঁছালাম। ডংগং থেকে পরদিন ভোরে আবার হাঁটা শুরু হলো। এবার যাচ্ছি বেদিং। উচ্চতা যতই বাড়ছে, অক্সিজেনের পরিমাণ ততই কমছে; সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কষ্টের মাত্রা। জাপলুক গ্রাম পার হয়ে বেলা তিনটার দিকে আমরা বেদিং গ্রামে পৌঁছালাম। এখানের উচ্চতা প্রায় ১২ হাজার ১৪০ ফুট। এই উচ্চতায় অক্সিজেন-স্বল্পতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এখানেই দুই রাত থাকব আমরা তাঁবুতে। ১০ অক্টোবরে বেদিং ছাড়লাম। রওনা দিলাম বেস ক্যাম্পের (বিসি) উদ্দেশে। বেস ক্যাম্পটি অবশ্য এক দিন আগেই এসে নেপাল দলের সদস্যরা তৈরি করেছেন। বেলা সোয়া তিনটায় আমরা বিসিতে পৌঁছালাম। আগামীকাল আমরা অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প (এবিসি) যাব। এবিসি যাওয়ার পথে বড় বড় পাথরের বোল্ডার ডিঙাতে হলো। আমরা একজনের পেছনে আরেকজন লাইন করে হেঁটে হেঁটে অবশেষে সাড়ে ১১টায় এবিসি পৌঁছালাম। এবিসির উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ৪০০ ফুট। এবিসি আমাদের মূল ক্যাম্প। এখানে বেশ কয়েক দিন থাকতে হবে আমাদের। এবিসির পর আমাদের যাত্রা হাইক্যাম্পে। ১৫ অক্টোবর পেম্বার দল রাত তিনটায় এবিসি ছাড়ল। আর আমরা ছয়জন ও নেপালের সদস্য ভুটিক, সুস্মিতা ও ইয়াংজুম ভোর ছয়টা ৩০ মিনিটে এবিসি থেকে রওনা হলাম। সকাল নয়টায় আইস অ্যাক্স ও ক্র্যাম্প অনের সাহায্যে হিমবাহে আরোহণ শুরু হলো। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি ঢালে দড়ি ও জুমার ছাড়াই উঠতে হচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের চিৎকার শুনে চেয়ে দেখি, বিপ্লব নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন এবং আইস অ্যাক্স দিয়ে পতন ঠেকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। আইস অ্যাক্স দিয়ে একের পর এক হিমবাহে আঘাত করতে করতে অবশেষে বিপ্লব বড় ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন। পেম্বার দল আজ তিন হাজার ফুট দড়ি লাগিয়েছে। কিন্তু এখনো শিখর পর্যন্ত দড়ি লাগানোর কাজ করা হয়নি। পরিকল্পনা হলো, আগামীকাল ভোর চারটায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে আমরা চূড়া বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হব। দুই শেরপাসহ পেম্বার অগ্রবর্তী দল অবশিষ্ট পথে দড়ি লাগাবে এবং আমরা বাকি সদস্যরা সেই দড়ি ব্যবহার করে তাদের পেছনে যাব। ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসাহসী পরিকল্পনা। কিন্তু চূড়া বিজয় করতে হলে ওই পরিস্থিতিতে নিরাপদ কোনো পথ ছিল না। অবশেষে শিখরের উদ্দেশে যাত্রা।
১৬ অক্টোবর রাত চারটায় আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। বাইরে তখন হালকা তুষারপাত হচ্ছে। ক্রমেই বাড়তে থাকল। বেগতিক দেখে শিখর আরোহণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো। পরদিনও আবহাওয়া ভালো না থাকায় অভিযান শুরু করা গেল না। মনে হচ্ছিল, এত কষ্ট করে এত দূর আসার পরও আমাদের ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হবে। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলাম। রাত একটার দিকে আমার ঘুম ভাঙল। তাঁবুর ওপর তুষার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি আকাশ ভরা তারা। তাড়াতাড়ি তাঁবু থেকে বেড়িয়ে এসে পেম্বাকে ঘুম থেকে জাগালাম। ‘আবহাওয়া ভালো; যত দ্রুত সম্ভব চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা করা উচিত, ’বললাম আমি। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। নেপালের দুই সদস্য সুস্মিতা ও ভুটিক অসুস্থতার জন্য হাইক্যাম্পে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা বাকি ১০ জন রাত তিনটায় হেডলাইটের আলোতে শিখরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। অন্ধকারের মধ্যে দড়িতে জুমার লাগিয়ে আমরা এক সারিতে এগিয়ে চলছি। প্রত্যেকের মাথায় বাঁধা হেডলাইট। ছুরির ফলার মতো ভয়ংকর সরু পথ (নাইফ-রিজ) দিয়ে আমরা যাচ্ছি। ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে সামনের জনের পদচিহ্নের ওপর পা ফেলে এগিয়ে চলছি। নাইফ-রিজ অতিক্রম করে আমরা শেষ হার্ডলের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রায় হাজার ফুট উঁচু বরফের দেয়ালটি প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাড়া, কোথাও আবার ওভার-হ্যাং। সবার আগে পেম্বা সেই বরফের দেয়ালে ওঠা শুরু করলেন। ভোর ছয়টায় আমি বরফের দেয়ালে ওঠা শুরু করলাম। আমার পেছনে নিশাত, নুর, সজল ও বিপ্লব। ওপর থেকে মাঝেমধ্যেই বরফের টুকরা গড়িয়ে আমার আশপাশ দিয়ে নিচে পড়ছে। কোনোটা আমাদের গায়েও পড়ছে; যদিও তা তেমন বিপজ্জনক ছিল না। মাথা তুলতেই চোখের সামনে দেখলাম, আমাদের নেপালের চার বন্ধু দড়িতে ঝুলে আছেন। নিচে তাকিয়ে দেখি, একই অবস্থায় রয়েছে আমার দলের চারজন। কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চলছি। চোখের সামনেই শিখর; কিন্তু শরীর এতই ক্লান্ত যে পা আর চলতে চায় না। বুক-পকেটে রাখা লাল-সবুজ পতাকাটার কথা আমার মনে পড়ল। এই পতাকাটি শিখরে ওড়ানোর জন্যই তো এই মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া। হঠাৎ শরীরে একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। কষ্ট ভুলে গায়ের সব শক্তি দিয়ে উঠতে থাকলাম। সকাল আটটায় পেম্বা শিখরে উঠে গেছেন। অবশেষে সকাল পৌনে নয়টায় আমি শিখরে উঠে আনন্দে পেম্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর নিশাত শিখরে পা রাখল। তারপর এলেন নুর ও সজল। আমরা চারজন ওপর-নিচে আগ-পিছ করে কোনোমতে ছবি তুললাম। শিখরে আর দাঁড়ানোর স্থান নেই, তাই বিপ্লবকে একটু নিচে দড়িতে ঝুলে থাকতে হলো। শিখরটুকু খুবই নড়বড়ে, যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পেম্বা তাঁর আইস অ্যাক্স দিয়ে রিজের বরফ ভেঙে কোনোমতে একজন বসতে পারেন, এমন একটি জায়গা তৈরি করেছেন। সেখানে বসে বুক-পকেট থেকে জাতীয় পতাকা বের করে আইস অ্যাক্সে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম। দুই বছর ধরে আমরা যে স্বপ্ন লালন করে আসছি, আজ তা বাস্তবে পরিণত হলো। আমাদের বিজয়ের খবর পেয়ে ইনাম আল হক কাঠমান্ডু এলেন। কাঠমান্ডুর পাঁচতারকা হোটেল ‘ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি’তে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে চেকিগো পর্বতশৃঙ্গের নাম ‘নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর’ ঘোষিত হলো।
যত দিন হিমালয় থাকবে, তত দিন বাংলাদেশের নামে এই পর্বতশৃঙ্গ থাকবে। আগামী দিনের পর্বতারোহীরা জানবেন, বাংলাদেশের নামে এই পর্বতশৃঙ্গের নামকরণ হয়েছে। এখানে যতবার অভিযান হবে, প্রতিবারই বাংলাদেশের নামটি উচ্চারিত হবে। আমাদের মতো নগণ্য কয়েকজন অভিযাত্রীর কাছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু কি হতে পারে!
এম এ মুহিত: দুবার এভারেস্টজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি
mountaineeৎmohit@gmail.com
২০১০ সালের কথা। তখন আমরা ইনাম আল হকের নেতৃত্বে বিএমটিসি ক্লাবের (বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব) সদস্যরা হিমালয়ে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিচ্ছি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, হিমালয় পর্বতে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের নামটি স্থাপন করা। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব! বিশ্ব রেকর্ডধারী পর্বতারোহী পেম্বা দর্জি শেরপা সেই সম্ভাবনার দ্বারটি খুলে দিলেন একদিন। পেম্বা জানান, পৃথিবীর কোনো মানুষ কখনো আরোহণ করেননি, এমন এক শৃঙ্গে বাংলাদেশ ও নেপালের পর্বতারোহীরা যৌথ অভিযান চালাতে পারে এবং তা সফল হলে পর্বতশৃঙ্গটির নাম হবে নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর। ইতিপূর্বে চীন ও জাপানের সঙ্গে এ ধরনের দুটি সফল অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের (এনএমএ) সভাপতিকে তখন থেকেই চিঠি লেখা শুরু। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উত্তর আর আসে না। অবশেষে ২০১০ সালের আগস্টে প্রতীক্ষিত সেই ই-মেইলটি এল। এনএমএর সভাপতি জিম্বা জাংবু শেরপা লিখেছেন, নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত ২০ হাজার ৫২৮ ফুট (ছয় হাজার ২৫৭ মিটার) উঁচু ‘চেকিগো’ নামের অ-বিজয়ী শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। অনুমোদন তো পাওয়া গেল; এখন অজ্ঞাতনামা এই চেকিগো শিখরে অভিযান পরিকল্পনা করব কী করে! এনএমএর তথ্যমতে চেকিগো শিখরে ইতিপূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে; কিন্তু সবই ব্যর্থ। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যানই বলছে, চেকিগো কত কঠিন ও ভয়ংকর এক শিখর। তার পরও কথা আছে। অভিযান পরিচালনার জন্য অর্থের সংস্থান। ভাগ্য ভালো বলতে হয় আমাদের। অর্থের জন্য খুব একটা বেগ পেতে হলো না। কসমস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ইউএনবির সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান অভিযানের অর্ধেক ব্যয় বহন করতে রাজি হলেন। বাকি অর্ধেক ব্যয় বহন করার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলেন প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান। আমরা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে ছয়জন ও নেপাল থেকে সাতজন অভিযাত্রীর অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা হলো। নেপাল দলের নেতৃত্ব দেবেন পেম্বা দর্জি শেরপা। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হলো। বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন নিশাত মজুমদার, সাদিয়া সুলতানা, সজল খালেদ, নুর মোহাম্মদ ও কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব। আর নেপাল দলের সদস্যরা হলেন মিংমা গ্যালজে শেরপা, দা-কিপা শেরপা, মিংমা দর্জি শেরপা, দাওয়া ইয়াংজুম শেরপা, সুস্মিতা মাসকে ও নাওয়াং ফুটি শেরপা।
অভিযানের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ১ অক্টোবর। নিশাত, সাদিয়া, সজল, নুর, মজনু আর আমি কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লাম। অতঃপর নেপাল যখন পৌঁছালাম, তখন পেম্বা দর্জি শেরপা ও নেপাল দলের সব সদস্য কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে ঐতিহ্যবাহী শেরপা রীতিতে আমাদের গলায় কাঁথা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এবার সত্যিকারের অভিযানের পালা। ৫ অক্টোবর, ২০১০, সিংগাতি থেকে বেদিং পর্যন্ত আমাদের অনেক ঝুলন্ত সেতু পার হতে হলো; এর কয়েকটি ছিল কাঠের তৈরি আর নড়বড়ে। অবশেষে চার হাজার ৫৪০ ফুট উঁচুতে যখন পৌঁছাই, সূর্য তখন মাথার ওপর। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হলো আমাদের দ্বিতীয় দিনের ট্রেকিং। আজকের গন্তব্যের নাম সিমিগাঁও। আড়াই ঘণ্টা পর যেখানে পৌঁছালাম, তার নাম ‘ছ্যাত-ছ্যাত’। ছ্যাত-ছ্যাত থেকে সিমিগাঁও পৌঁছতে বেজে গেল বেলা তিনটা। এই পৌঁছানোটা ছিল বেশ কষ্টকর। সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, সঙ্গে খাড়া ঢাল বেয়ে উত্তরণ। সিমিগাঁওয়ের উচ্চতা প্রায় ছয় হাজার ৯০০ ফুট। ৭ অক্টোবর ২০১০। আজ আমাদের গন্তব্য ডংগং। তামাকোশি নদীর একটি উপধারার পাশ দিয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠতে থাকি। বেশ কিছু জায়গায় জোঁকের উপদ্রবের শিকার হয়ে অনেকেরই রক্ত ঝরল। এ রকম নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আট হাজার ৮৫০ ফুট উঁচু ডংগংয়ে পৌঁছালাম। ডংগং থেকে পরদিন ভোরে আবার হাঁটা শুরু হলো। এবার যাচ্ছি বেদিং। উচ্চতা যতই বাড়ছে, অক্সিজেনের পরিমাণ ততই কমছে; সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কষ্টের মাত্রা। জাপলুক গ্রাম পার হয়ে বেলা তিনটার দিকে আমরা বেদিং গ্রামে পৌঁছালাম। এখানের উচ্চতা প্রায় ১২ হাজার ১৪০ ফুট। এই উচ্চতায় অক্সিজেন-স্বল্পতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এখানেই দুই রাত থাকব আমরা তাঁবুতে। ১০ অক্টোবরে বেদিং ছাড়লাম। রওনা দিলাম বেস ক্যাম্পের (বিসি) উদ্দেশে। বেস ক্যাম্পটি অবশ্য এক দিন আগেই এসে নেপাল দলের সদস্যরা তৈরি করেছেন। বেলা সোয়া তিনটায় আমরা বিসিতে পৌঁছালাম। আগামীকাল আমরা অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প (এবিসি) যাব। এবিসি যাওয়ার পথে বড় বড় পাথরের বোল্ডার ডিঙাতে হলো। আমরা একজনের পেছনে আরেকজন লাইন করে হেঁটে হেঁটে অবশেষে সাড়ে ১১টায় এবিসি পৌঁছালাম। এবিসির উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ৪০০ ফুট। এবিসি আমাদের মূল ক্যাম্প। এখানে বেশ কয়েক দিন থাকতে হবে আমাদের। এবিসির পর আমাদের যাত্রা হাইক্যাম্পে। ১৫ অক্টোবর পেম্বার দল রাত তিনটায় এবিসি ছাড়ল। আর আমরা ছয়জন ও নেপালের সদস্য ভুটিক, সুস্মিতা ও ইয়াংজুম ভোর ছয়টা ৩০ মিনিটে এবিসি থেকে রওনা হলাম। সকাল নয়টায় আইস অ্যাক্স ও ক্র্যাম্প অনের সাহায্যে হিমবাহে আরোহণ শুরু হলো। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি ঢালে দড়ি ও জুমার ছাড়াই উঠতে হচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের চিৎকার শুনে চেয়ে দেখি, বিপ্লব নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন এবং আইস অ্যাক্স দিয়ে পতন ঠেকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। আইস অ্যাক্স দিয়ে একের পর এক হিমবাহে আঘাত করতে করতে অবশেষে বিপ্লব বড় ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন। পেম্বার দল আজ তিন হাজার ফুট দড়ি লাগিয়েছে। কিন্তু এখনো শিখর পর্যন্ত দড়ি লাগানোর কাজ করা হয়নি। পরিকল্পনা হলো, আগামীকাল ভোর চারটায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে আমরা চূড়া বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হব। দুই শেরপাসহ পেম্বার অগ্রবর্তী দল অবশিষ্ট পথে দড়ি লাগাবে এবং আমরা বাকি সদস্যরা সেই দড়ি ব্যবহার করে তাদের পেছনে যাব। ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসাহসী পরিকল্পনা। কিন্তু চূড়া বিজয় করতে হলে ওই পরিস্থিতিতে নিরাপদ কোনো পথ ছিল না। অবশেষে শিখরের উদ্দেশে যাত্রা।
১৬ অক্টোবর রাত চারটায় আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। বাইরে তখন হালকা তুষারপাত হচ্ছে। ক্রমেই বাড়তে থাকল। বেগতিক দেখে শিখর আরোহণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো। পরদিনও আবহাওয়া ভালো না থাকায় অভিযান শুরু করা গেল না। মনে হচ্ছিল, এত কষ্ট করে এত দূর আসার পরও আমাদের ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হবে। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলাম। রাত একটার দিকে আমার ঘুম ভাঙল। তাঁবুর ওপর তুষার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি আকাশ ভরা তারা। তাড়াতাড়ি তাঁবু থেকে বেড়িয়ে এসে পেম্বাকে ঘুম থেকে জাগালাম। ‘আবহাওয়া ভালো; যত দ্রুত সম্ভব চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা করা উচিত, ’বললাম আমি। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। নেপালের দুই সদস্য সুস্মিতা ও ভুটিক অসুস্থতার জন্য হাইক্যাম্পে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা বাকি ১০ জন রাত তিনটায় হেডলাইটের আলোতে শিখরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। অন্ধকারের মধ্যে দড়িতে জুমার লাগিয়ে আমরা এক সারিতে এগিয়ে চলছি। প্রত্যেকের মাথায় বাঁধা হেডলাইট। ছুরির ফলার মতো ভয়ংকর সরু পথ (নাইফ-রিজ) দিয়ে আমরা যাচ্ছি। ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে সামনের জনের পদচিহ্নের ওপর পা ফেলে এগিয়ে চলছি। নাইফ-রিজ অতিক্রম করে আমরা শেষ হার্ডলের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রায় হাজার ফুট উঁচু বরফের দেয়ালটি প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাড়া, কোথাও আবার ওভার-হ্যাং। সবার আগে পেম্বা সেই বরফের দেয়ালে ওঠা শুরু করলেন। ভোর ছয়টায় আমি বরফের দেয়ালে ওঠা শুরু করলাম। আমার পেছনে নিশাত, নুর, সজল ও বিপ্লব। ওপর থেকে মাঝেমধ্যেই বরফের টুকরা গড়িয়ে আমার আশপাশ দিয়ে নিচে পড়ছে। কোনোটা আমাদের গায়েও পড়ছে; যদিও তা তেমন বিপজ্জনক ছিল না। মাথা তুলতেই চোখের সামনে দেখলাম, আমাদের নেপালের চার বন্ধু দড়িতে ঝুলে আছেন। নিচে তাকিয়ে দেখি, একই অবস্থায় রয়েছে আমার দলের চারজন। কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চলছি। চোখের সামনেই শিখর; কিন্তু শরীর এতই ক্লান্ত যে পা আর চলতে চায় না। বুক-পকেটে রাখা লাল-সবুজ পতাকাটার কথা আমার মনে পড়ল। এই পতাকাটি শিখরে ওড়ানোর জন্যই তো এই মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া। হঠাৎ শরীরে একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। কষ্ট ভুলে গায়ের সব শক্তি দিয়ে উঠতে থাকলাম। সকাল আটটায় পেম্বা শিখরে উঠে গেছেন। অবশেষে সকাল পৌনে নয়টায় আমি শিখরে উঠে আনন্দে পেম্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর নিশাত শিখরে পা রাখল। তারপর এলেন নুর ও সজল। আমরা চারজন ওপর-নিচে আগ-পিছ করে কোনোমতে ছবি তুললাম। শিখরে আর দাঁড়ানোর স্থান নেই, তাই বিপ্লবকে একটু নিচে দড়িতে ঝুলে থাকতে হলো। শিখরটুকু খুবই নড়বড়ে, যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পেম্বা তাঁর আইস অ্যাক্স দিয়ে রিজের বরফ ভেঙে কোনোমতে একজন বসতে পারেন, এমন একটি জায়গা তৈরি করেছেন। সেখানে বসে বুক-পকেট থেকে জাতীয় পতাকা বের করে আইস অ্যাক্সে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম। দুই বছর ধরে আমরা যে স্বপ্ন লালন করে আসছি, আজ তা বাস্তবে পরিণত হলো। আমাদের বিজয়ের খবর পেয়ে ইনাম আল হক কাঠমান্ডু এলেন। কাঠমান্ডুর পাঁচতারকা হোটেল ‘ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি’তে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে চেকিগো পর্বতশৃঙ্গের নাম ‘নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর’ ঘোষিত হলো।
যত দিন হিমালয় থাকবে, তত দিন বাংলাদেশের নামে এই পর্বতশৃঙ্গ থাকবে। আগামী দিনের পর্বতারোহীরা জানবেন, বাংলাদেশের নামে এই পর্বতশৃঙ্গের নামকরণ হয়েছে। এখানে যতবার অভিযান হবে, প্রতিবারই বাংলাদেশের নামটি উচ্চারিত হবে। আমাদের মতো নগণ্য কয়েকজন অভিযাত্রীর কাছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু কি হতে পারে!
এম এ মুহিত: দুবার এভারেস্টজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি
mountaineeৎmohit@gmail.com
No comments