পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র- তদন্তে অসন্তুষ্ট বিশ্বব্যাংক by শওকত হোসেন
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে সন্তুষ্ট হয়নি বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল। তারা বলেছে, দুদকের করা তদন্ত অসম্পূর্ণ এবং নিরপেক্ষ হয়নি।
বিশেষজ্ঞ দলটি প্রশ্ন করেছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় কেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম নেই। তারা মনে করে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মূল ব্যক্তি হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। অথচ মামলায় সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিরই নাম রাখা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের মনোনীত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পো ৯ জানুয়ারি দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে একটি চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েছেন। চিঠিতে কেন সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম নেই, তার ব্যাখ্যাও জানতে চাওয়া হয়েছে। দুদক সূত্রে চিঠির এই বিবরণ পাওয়া গেছে।
তবে দুদককে আনুষ্ঠানিকভাবে অসন্তোষের কথা জানানো হলেও গতকাল সোমবার দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের উল্টো তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক খুশি। দুদকের কমিশনার আরও বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিক্রিয়ায় দুদক সন্তুষ্ট।’
তবে চিঠিতে পরিষ্কার অসন্তুষ্টির কথা থাকলেও কমিশনারের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য নিয়ে যোগাযোগ করা হয় গোলাম রহমানের সঙ্গে। গতকাল রাতে প্রথম আলোর কাছে তিনি এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘দুদক এ পর্যন্ত যা করেছে, তা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য। পরবর্তী তদন্ত পর্যায়েও বিশ্বব্যাংকের প্যানেল সহায়ক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।’
তবে দুদক সূত্র জানায়, মো. সাহাবুদ্দিন স্বপ্রণোদিত হয়েই গতকাল বিশ্বব্যাংকের চিঠি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অথচ এ নিয়ে কথা বলা নিষেধ ছিল বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্তে তিনি এসব কথা বলেননি। সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছেন, তাই তিনি বলেছেন। তিনি এ সময় আরও বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট, তাই দুদক সন্তুষ্ট।’
পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর শর্ত সাপেক্ষে অর্থায়নে ফিরে আসতে সম্মতি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। শর্ত ছিল দুর্নীতি নিয়ে সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং এই তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী আর্জেন্টিনার নাগরিক লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে বিশ্বব্যাংক। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান।
দলটি গত অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে। এর পরই গত ১৭ ডিসেম্বর সাতজনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার এজাহারের বিস্তারিত বিবরণ পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংককে। এর পরই ৯ জানুয়ারি চিঠি দেয় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের শর্ত হচ্ছে, দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ, সঠিক, স্বচ্ছ, পর্যাপ্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তবেই অর্থায়নে ফিরে আসবে দাতা সংস্থাটি।
লুই মোরেনো ওকাম্পো দুদককে দেওয়া চিঠিতে লিখেছেন, তদন্ত শেষে এজাহার দেওয়া দুদকের একটি প্রাথমিক ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিশেষজ্ঞ দলটি এই এজাহার পরীক্ষা করে দেখেছে। তবে প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে ঘটনা বিশ্লেষণ করার পর বিশেষজ্ঞ দলটি মনে করে, এটা প্রতিষ্ঠিত যে, দুর্নীতির অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে জড়িত। যেকোনো ধরনের কার্যাদেশ দিতে মন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার অনুরোধে মন্ত্রী কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন নিয়ে দর-কষাকষি করতে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকের পরই কাজ পেতে কাকে কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হবে, তার সিদ্ধান্ত হয় এবং এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মোট বরাদ্দের ৪ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহর ডায়েরিতে এই ঘুষের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি মনে করে, সম্পূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত এবং অবশ্যই তাঁকে এজাহারভুক্ত আসামির তালিকায় সংযোজন করতে হবে।
চিঠিতে সাবেক সেতু সচিবের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাওয়ার কথা ছিল ১ শতাংশ। কারণ, তিনিই ছিলেন উভয় পক্ষের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র।
দুদককে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্রয়সংক্রান্ত আইন (পিপিএ ২০০৬) অনুযায়ী কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতার কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। পিপিএ অনুযায়ী, কোনো ধরনের অনিয়ম, শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়ম মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না। বাস্তবে বাংলাদেশে কেনাকাটার সব ধরনের অনুমোদন দেন মন্ত্রী নিজেই। এ অবস্থায় ক্রয় আইনের সব বিধান মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নীতিগতভাবে কেনাকাটার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে লিখিতভাবে দরপত্র কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত এর সঙ্গে মন্ত্রীর সংযুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া আইনে কোনো ধরনের অপরাধমূলক অভিযোগ থেকে মন্ত্রীকে কোনোভাবেই দায়মুক্ত করার সুযোগ নেই।
দুদক সূত্র জানায়, গত অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বিশেষজ্ঞ দলের সফরের সময় উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে বলা আছে, বাংলাদেশের আইনেই আছে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মন্ত্রীও সমান অভিযুক্ত হবেন। অথচ দুদকের করা মামলায় এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।
সবশেষে চিঠিতে বিশেষজ্ঞ দলটির পক্ষ থেকে দুদকের কাছ থেকে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। যেমন ২০১১ সালের ২৯ মে এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবুল হোসেনের বৈঠক হয়েছিল। এর পর পরই এসএনসি-লাভালিন দরপত্র মূল্যায়নে শীর্ষস্থান পায় এবং এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহ তাঁর ডায়েরিতে মন্ত্রীকে ৪ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কথা লেখেন। চিঠিতে পর পর এই ঘটনার যোগসূত্রের বিষয়ে দুদকের মতামত জানতে চেয়েছেন লুই ওকাম্পো।
মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে রাখা না হলেও অধিকতর তদন্তের কথা বলেছে দুদক। কীভাবে এই তদন্ত করা হবে, তা-ও জানতে চেয়েছে বিশেষজ্ঞ দল। বিশেষ করে, এজাহারে বলা আছে, সরকার প্রথমে একটি জাপানি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে আগ্রহী ছিল। এ বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়। সবশেষে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক সেতু সচিব ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব কাজি ফেরদাউসকে রিমান্ডে নিয়ে দুদক যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তারও বিস্তারিত বিবরণ এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে তারা।
দুদক কমিশনারের বক্তব্য: বিশ্বব্যাংকের এই চিঠি পাওয়ার পরও দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাবেক দুই মন্ত্রীকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল সরাসরি এবং সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। আমরা স্বাধীনভাবে তদন্ত কার্যক্রম করছি।’
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে মামলায় আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলেও তাঁদের কার্যক্রম বিশদভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম আসবে কি না, জানতে চাইলে মো. সাহাবুদ্দিন সবশেষে বলেন, ‘তাঁদের বাদ দিয়ে তদন্তের অবকাশ নেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পক্ষ থেকেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের মনোনীত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পো ৯ জানুয়ারি দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে একটি চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েছেন। চিঠিতে কেন সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম নেই, তার ব্যাখ্যাও জানতে চাওয়া হয়েছে। দুদক সূত্রে চিঠির এই বিবরণ পাওয়া গেছে।
তবে দুদককে আনুষ্ঠানিকভাবে অসন্তোষের কথা জানানো হলেও গতকাল সোমবার দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের উল্টো তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক খুশি। দুদকের কমিশনার আরও বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিক্রিয়ায় দুদক সন্তুষ্ট।’
তবে চিঠিতে পরিষ্কার অসন্তুষ্টির কথা থাকলেও কমিশনারের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য নিয়ে যোগাযোগ করা হয় গোলাম রহমানের সঙ্গে। গতকাল রাতে প্রথম আলোর কাছে তিনি এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘দুদক এ পর্যন্ত যা করেছে, তা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য। পরবর্তী তদন্ত পর্যায়েও বিশ্বব্যাংকের প্যানেল সহায়ক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।’
তবে দুদক সূত্র জানায়, মো. সাহাবুদ্দিন স্বপ্রণোদিত হয়েই গতকাল বিশ্বব্যাংকের চিঠি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অথচ এ নিয়ে কথা বলা নিষেধ ছিল বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্তে তিনি এসব কথা বলেননি। সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছেন, তাই তিনি বলেছেন। তিনি এ সময় আরও বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট, তাই দুদক সন্তুষ্ট।’
পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর শর্ত সাপেক্ষে অর্থায়নে ফিরে আসতে সম্মতি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। শর্ত ছিল দুর্নীতি নিয়ে সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং এই তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী আর্জেন্টিনার নাগরিক লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে বিশ্বব্যাংক। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান।
দলটি গত অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে। এর পরই গত ১৭ ডিসেম্বর সাতজনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার এজাহারের বিস্তারিত বিবরণ পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংককে। এর পরই ৯ জানুয়ারি চিঠি দেয় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের শর্ত হচ্ছে, দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ, সঠিক, স্বচ্ছ, পর্যাপ্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তবেই অর্থায়নে ফিরে আসবে দাতা সংস্থাটি।
লুই মোরেনো ওকাম্পো দুদককে দেওয়া চিঠিতে লিখেছেন, তদন্ত শেষে এজাহার দেওয়া দুদকের একটি প্রাথমিক ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিশেষজ্ঞ দলটি এই এজাহার পরীক্ষা করে দেখেছে। তবে প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে ঘটনা বিশ্লেষণ করার পর বিশেষজ্ঞ দলটি মনে করে, এটা প্রতিষ্ঠিত যে, দুর্নীতির অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে জড়িত। যেকোনো ধরনের কার্যাদেশ দিতে মন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার অনুরোধে মন্ত্রী কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন নিয়ে দর-কষাকষি করতে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকের পরই কাজ পেতে কাকে কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হবে, তার সিদ্ধান্ত হয় এবং এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মোট বরাদ্দের ৪ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহর ডায়েরিতে এই ঘুষের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি মনে করে, সম্পূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত এবং অবশ্যই তাঁকে এজাহারভুক্ত আসামির তালিকায় সংযোজন করতে হবে।
চিঠিতে সাবেক সেতু সচিবের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাওয়ার কথা ছিল ১ শতাংশ। কারণ, তিনিই ছিলেন উভয় পক্ষের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র।
দুদককে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্রয়সংক্রান্ত আইন (পিপিএ ২০০৬) অনুযায়ী কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতার কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। পিপিএ অনুযায়ী, কোনো ধরনের অনিয়ম, শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়ম মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না। বাস্তবে বাংলাদেশে কেনাকাটার সব ধরনের অনুমোদন দেন মন্ত্রী নিজেই। এ অবস্থায় ক্রয় আইনের সব বিধান মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নীতিগতভাবে কেনাকাটার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে লিখিতভাবে দরপত্র কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত এর সঙ্গে মন্ত্রীর সংযুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া আইনে কোনো ধরনের অপরাধমূলক অভিযোগ থেকে মন্ত্রীকে কোনোভাবেই দায়মুক্ত করার সুযোগ নেই।
দুদক সূত্র জানায়, গত অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বিশেষজ্ঞ দলের সফরের সময় উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে বলা আছে, বাংলাদেশের আইনেই আছে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মন্ত্রীও সমান অভিযুক্ত হবেন। অথচ দুদকের করা মামলায় এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।
সবশেষে চিঠিতে বিশেষজ্ঞ দলটির পক্ষ থেকে দুদকের কাছ থেকে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। যেমন ২০১১ সালের ২৯ মে এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবুল হোসেনের বৈঠক হয়েছিল। এর পর পরই এসএনসি-লাভালিন দরপত্র মূল্যায়নে শীর্ষস্থান পায় এবং এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহ তাঁর ডায়েরিতে মন্ত্রীকে ৪ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কথা লেখেন। চিঠিতে পর পর এই ঘটনার যোগসূত্রের বিষয়ে দুদকের মতামত জানতে চেয়েছেন লুই ওকাম্পো।
মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে রাখা না হলেও অধিকতর তদন্তের কথা বলেছে দুদক। কীভাবে এই তদন্ত করা হবে, তা-ও জানতে চেয়েছে বিশেষজ্ঞ দল। বিশেষ করে, এজাহারে বলা আছে, সরকার প্রথমে একটি জাপানি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে আগ্রহী ছিল। এ বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়। সবশেষে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক সেতু সচিব ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব কাজি ফেরদাউসকে রিমান্ডে নিয়ে দুদক যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তারও বিস্তারিত বিবরণ এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে তারা।
দুদক কমিশনারের বক্তব্য: বিশ্বব্যাংকের এই চিঠি পাওয়ার পরও দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাবেক দুই মন্ত্রীকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল সরাসরি এবং সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। আমরা স্বাধীনভাবে তদন্ত কার্যক্রম করছি।’
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে মামলায় আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলেও তাঁদের কার্যক্রম বিশদভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম আসবে কি না, জানতে চাইলে মো. সাহাবুদ্দিন সবশেষে বলেন, ‘তাঁদের বাদ দিয়ে তদন্তের অবকাশ নেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পক্ষ থেকেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
No comments