খুনীর গড়া মসজিদ মাদ্রাসাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে
গলাচিপা, ৩১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী আর্টিলারি মহিউদ্দিন শর্ষিনা পীরের 'খলিফা' ছিল। নিজ এলাকায় পীরের মুরিদের সংখ্যা বাড়াতে চেয়েছিল। এজন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাহফিল করত। বাড়ির দরজায় তৈরি করেছিল মসজিদ ও মাদ্রাসা।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে গ্রহণ করেনি। পঁচাত্তরের পর থেকেই মানুষ জানত সে একটা খুনী। যে কারণে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। গরম্ন কেটে ভূরিভোজ করার পরেও তার মাহফিলে মানুষ যেত না। তার মসজিদে নামাজ পড়ত না। মাদ্রাসায় কেউ ভর্তি হয়নি। তার হাতে গড়া মসজিদ-মাদ্রাসা মুখথুবড়ে পড়ে আছে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাকিসত্মান আমলে স্কুলজীবনেই বঙ্গবন্ধুর খুনী লে. কর্নেল (অব) আর্টিলারি মহিউদ্দিন আহম্মেদ শর্ষিনা পীরের মুরিদ হয়েছিল। একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে 'গনিমতের মাল' আখ্যা দিয়ে শর্ষিনার তৎকালীন পীর হিন্দু নারীদের পাকিসত্মানী সেনাদের হাতে তুলে দিতেন। সেই 'যোগ্য' পীরের মুরিদ মহিউদ্দিনও পঁচাত্তরে জাতির জনকের হত্যাকা-ে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করে পীরের কাছে আরও 'সুযোগ্য' হয়ে উঠেছিল। তাই তো মুরিদ থেকে তার পদোন্নতি হয়েছিল 'খলিফা' পদে। এ তথ্যের সত্যতা জানিয়ে মহিউদ্দিনের স্কুল জীবনের সহপাঠী, পারিবারিক আত্মীয় ও বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হানিফ মিয়া জানান, পঁচাত্তরের পর থেকে গ্রেফতারের আগ পর্যনত্ম সময়ের মধ্যে মহিউদ্দিন প্রতিবছর শীতের সময়ে অনত্মত ২/১ বার এলাকায় আসত। হাতে তসবি নিয়ে ঘুরে বেড়াত গ্রাম। মানুষদের মুরিদ বানানোর চেষ্টা করত। আয়োজন করত মাহফিলের। কিন্তু সে যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে সক্রিয় জড়িত ছিল সে তথ্য আমরা আগে থেকেই জানতাম। আমরা তাকে ঘৃণা করতাম। তাই তো তার মাহফিলে মানুষ যেত না। তার ভ-ামি মানুষ ধরে ফেলেছিল। তিনি আরও জানান, মাহফিলে মানুষ হতো না দেখে মহিউদ্দিন কৌশলের পথ ধরেছিল। মাহফিলের দিন গরম্ন জবাই করে গরিব মানুষদের দাওয়াত দিত। খাওয়ার জন্য মানুষ জড়ো হলে সে শর্ত জুড়ে দিত আগে মাহফিল শুনতে হবে। তারপরে খাওয়া। কিন্তু সে কৌশলেও কাজ হতো না। মানুষ খেতে যেত না। মুরিদ বাড়ানোর উদ্দেশ্য যেমন সফল হয়নি, তেমনি মহিউদ্দিনের মাহফিলের উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। এসব তথ্যের সাথে আরেকটু যোগ করে মহিউদ্দিনের বাড়ির পাশের রেজিস্ট্রি পাইমারি স্কুলের প্রধান শিক মাহবুব বাবু, প্রতিবেশী সোবাহান মোলস্নাসহ কয়েকজন জানান, খাওয়ার আয়োজনের জন্য মহিউদ্দিন বড় বড় ডেকচি পাতিল হাঁড়ি কিনেছিল। বাড়ির সামনে মসজিদ ও মাদ্রাসা বানিয়েছিল। কিন্তু গ্রামের একটি মানুষও তার মসজিদে নামাজ আদায় করত না। মাদ্রাসায় কোন শিশু ভর্তি হয়নি। মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য সে ইমাম রেখেছিল। সেই ইমামও একদিন পালিয়ে গেছে।খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে গ্রেফতারের আগ পর্যনত্ম মহিউদ্দিন নিয়মিত মৌডুবি গ্রামে আসত এবং মাহফিলের আয়োজনের চেষ্টা করত। মহিউদ্দিন যে কয়েকদিন গ্রামে থাকত সে ক'দিন নিজের হাতে গড়া মসজিদে বাড়ির লোকজনদের নিয়ে নামাজ পড়ত। বাড়ির কয়েকজন জানিয়েছেন, ভয়ে ভয়ে তারা নামাজ পড়তেন। মহিউদ্দিন চলে গেলে তারা আর মহিউদ্দিনের মসজিদে যেতেন না। জেনেশুনে একজন খুনীর মসজিদে নামাজ আদায় করাকে তারা ভাল কাজ বলে মনে করতেন না। এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে মহিউদ্দিনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিছ বেগম (৪৬) জানান, সে চলে গেলে মসজিদ-মাদ্রাসা খালি পড়ে থাকত। কেউ নামাজ আদায় করতে আসত না। মাদ্রাসাটি তো শুরম্ন থেকেই খালি পড়ে ছিল। এখন তো দু'টোই মুখথুবড়ে পড়েছে।
দেখা গেছে, মহিউদ্দিনের নিজ হাতে গড়া মসজিদ-মাদ্রাসা দু'টোই মুখথুবড়ে পড়ে আছে। আশপাশের কেউ কেউ বেড়ার টিন খুলে নিয়ে গেছে। দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই যে, এগুলো এক সময়ে মসজিদ-মাদ্রাসা ছিল। মাহফিল মসজিদ-মাদ্রাসা বর্জন ছিল গাঁয়ের মানুষের একটি নীরব প্রতিবাদ। কিন্তু খুনী মহিউদ্দিন তা বুঝতে পেরেছিল কিনা তা গাঁয়ের মানুষ জানতে পারেনি। তবে ফাঁসির মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হলেও গাঁয়ের মানুষ মহিউদ্দিনের এসব কার্যকলাপ মনে রাখবে দীর্ঘদিন।
No comments