ব্যাংকের অলস টাকা পুঁজি বাজারে ।। আগ্রাসী অর্থায়ন- ০ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত তারল্য শেয়ারবাজারে- ০ অস্থিরতার আশঙ্কা- ০ অতি মূল্যায়িত শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ দেয়া হচ্ছে- ০ ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের সুদের হার কমায় সাধারণ মানুষও ঝুঁকছেন by রাজু আহমেদ
বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য বিনিয়োগের জন্য শেয়ারবাজারে আগ্রাসী অর্থায়ন করছে কিছু কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শিল্প খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়ায় মুনাফার লৰ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকিং ও ব্রোকারেজ হাউসের ঋণ কার্যক্রম প্রসারিত করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
শুধু তাই নয়, ব্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মুনাফা বাড়ানোর নির্দেশ পেয়ে অতিমূল্যায়িত কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন সংশিস্নষ্টরা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের প্রবণতা শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক লেনদেন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, আগ্রাসী অর্থায়নের কারণে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। একটি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের উচিত ওই শেয়ারে ঋণ সুবিধা কমিয়ে আনা, যাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কোন হসত্মৰেপ করতে না হয়। কোন শেয়ারের দাম ৫০০ টাকা থাকা অবস্থায় যে হারে ঋণ দেবেন, শেয়ারটির দর এক হাজার টাকা হওয়ার পরও যদি সে হারে ঋণ দেয়া হয়_ তাহলে নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকি বাড়ে। আমি কোনভাবেই এ ধরনের আগ্রাসাী অর্থায়নে বিশ্বাস করি না। আশা করি এ বিষয়ে সবাই সজাগ থাকবেন।
ডিএসই এবং এসইসির এসব সতর্কবাণী সত্ত্বেও ঋণ সঙ্কোচনের পরিবর্তে অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রসারিত করছে। প্রতিদিন আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধির ৰেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মার্জিন ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিষয়টি ইতোমধ্যেই এসইসি এবং ডিএসইর নজরে এসেছে বলে জানা গেছে। বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো অতি মূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখায় শেষ পর্যনত্ম সোমবার মার্জিন ঋণ নিয়ন্ত্রণে নতুন নিয়ম চালু করেছে এসইসি। ব্রোকারেজ হাউসের ঋণের ৰমতা ১ঃ২ থেকে কমিয়ে ১ঃ১.৫ করা হয়েছে। এছাড়া বাজার মূল্য ও আয়ের (পিই) অনুপাত ৫০-এর ওপরে থাকা কোন শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে পিই অনুপাত ৭৫ পর্যনত্ম ঋণ দেয়া যেত।
সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে আমানতের স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত থাকলেও প্রায় তিন বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দা ভাব বিরাজ করছে। শিল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই ব্যাংক ঋণে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিদু্যত ও গ্যাস সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠায় উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না। এ কারণে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়ে গেছে।
জানা গেছে, কয়েকটি বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে প্রতি বছরই মুনাফার লৰ্যমাত্রা বেধে দেয়া হয়। ওই লৰ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়তে হয়। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে দীর্ঘদিন মুনাফা অর্জনের অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে আসছে। তিন বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় মুনাফার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে প্রতিটি ব্যাংকই অর্থায়নের বিকল্প খাত অনুসন্ধান করছে।
একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় টানা দু'বছর কোন ব্যাংকই মুনাফার লৰ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। ধারণা করা হয়েছিল, নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে বিনিয়োগে গতিশীলতা আসবে। এ কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই গত বছর মুনাফার লৰ্যমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। মূলত রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণেই অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে বড় কোন পরির্বতন না আসায় বড় ব্যাংকগুলোর পৰে পরিচালনা পর্ষদের বেধে দেয়া লৰ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বরং বিনিয়োগের ৰেত্র না বাড়ায় উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থের একাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফার লৰ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, একাধিক ব্যাংকের উচ্চ পর্যায় থেকে মার্চেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ ও ব্রোকারেজ হাউসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে কোন উপায়ে এ খাত থেকে মুনাফা বাড়ানোর জন্যও তাগিদ দেয়া হয়েছে। উর্ধতন কতর্ৃপৰের চাপের কারণে ব্যাংকের মালিকানাধীন এসব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক মার্জিন ঋণের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি অতিমূল্যায়িত শেয়ারের বিপরীতে ঋণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। দু'-একটি প্রতিষ্ঠান মার্জিন ঋণ প্রদানের ৰেত্রে এসইসির নির্দেশনা মানছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মার্জিন ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গত ২৫ জানুয়ারি একটি বৈঠক ডেকেছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ওই বৈঠকে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ঋণ প্রাবহ বাড়াতে উর্ধতন কর্তৃপৰের চাপের কথা প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, কমপৰে তিনটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মুনাফা বাড়াতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রসারিত করতে তাদের ওপর চাপ রয়েছে। এমনকি উচ্চ পর্যায়ের চাপে অতিমূল্যায়িত শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রাইম ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান শেখ মোর্তজা হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত দু'বছরে শেয়ারবাজারে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে_ তাতে অনেকেই তাদের করণীয় সম্পর্কে শিৰালাভ করেছে। এসইসির নানা পদৰেপের কারণেও অনেকে সতর্ক হতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এখন বুঝে-শুনে ঋণ দিচ্ছে। ১ঃ১.৫ হারে ঋণ দেয়ার ৰমতা থাকলেও কেউ কেউ এরচেয়েও কম দিচ্ছে। তবে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে কোন কোন ব্যাংক ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।
তিনি বলেন, সবাই এখানে ব্যবসার জন্য নেমেছে। ফলে লোকসানের আশঙ্কা থাকলে কেউই বিনিয়োগ করবে না। এর পরও যদি কেউ আগ্রাসী অর্থায়ন করে থাকে_ তবে অবশ্যই তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তবে শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোন মনত্মব্য করা ঠিক হবে না।
শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বৃদ্ধি নয়_ শেয়ারবাজারে অর্থ প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেস্নষকরা। নানা মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকছেন। এ কারণেই প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়লেও সেগুলো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হয়ে শেয়ারবাজারে আসছে। তাছাড়া কালো টাকা সাদা করার শর্তহীন সুযোগ গ্রহণ করে অনেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। কারণ অন্যান্য খাতের চেয়ে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে ঝামেলা কম, মুনাফার সুযোগ বেশি। চলতি অর্থবছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার ৰেত্রে বেশকিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিল্প ও অবকাঠামো খাতে এ ধরনের টাকা বিনিয়োগের ৰেত্রে কর্মসংস্থানের সংখ্যাসহ সামগ্রিক পরিকল্পনা জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। কোন প্রকল্পে ঘোষিত কর্মসংস্থান না হলে কালো টাকার বৈধতা বাতিল করা হবে। বাড়ি ও জমি কেনার ৰেত্রেও এক ব্যক্তির জন্য একবার সুযোগ দেয়ার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ৰেত্রে এ ধরনের কোন শর্ত না থাকায় গত ৬ মাসে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে বলে সংশিস্নষ্টরা ধারণা করছেন।
এসব কারণে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। ৬ মাস আগে ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৬৮১ কোটি টাকা। সর্বশেষ সোমবার লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬৮৯ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গত এক মাসে একদিনের জন্যও লেনদেনের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার নিচে নামেনি। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ডিএসই সাধারণ মূল্যসূচক প্রায় ১ হাজার পয়েন্টে বেড়েছে। বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৯৯০ কোটি ৩০ লাখ ৪১ হাজার টাকায়।
কালো টাকার আগমনে শেয়ারবাজারে লেনদেন বৃদ্ধির প্রভাবেই বাজারে শেয়ার-সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠছে। কারণ অপ্রদর্শিত বা কালো টাকায় কেনা শেয়ার দু'বছরের আগে বিক্রি না করার শর্ত বেধে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক শেয়ার নিয়মিত লেনদেনের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব কারণে বাজারে ভাল শেয়ারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে সংশিস্নষ্টদের ধারণা। এ অবস্থায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া গতিশীল করে শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে না পারলে বাজারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাল শেয়ারের যোগান বাড়াতে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সম কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সক্রিয় বিদেশী কোম্পানিগুলোকেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে একদিকে যেমন পুঁজিবাজার শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরাও ভাল শেয়ারে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে যে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে সেই তুলনায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিনিয়োগ প্রবাহ আরও বেড়ে গেলে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। অনাকাঙ্ৰিত পরিস্থিতি এড়াতে এখনই উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে।
No comments