রিপোর্টারের ডায়েরি- এখনও মানুষ আছন
২১ ডিসেম্বর, সোমবার। বেলা প্রায় একটা। সেলফোনে বেজে ওঠে অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করতেই অপর প্রানত্ম থেকে পুুরম্নষ কণ্ঠ। নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন নাম আবু সুফিয়ান।
শিকদার মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক শিকদারের একানত্ম ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। আরও জানালেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহোদয় এৰনি শহীদজায়া বাসনত্মী রানী দাসের সঙ্গে কথা বলতে চান। ঘন কুয়াশার কারণে মফস্বল শহরটিতে কখনও দিনের কাগজ আসেনি। তবে জনকণ্ঠের মফস্বল সম্পাদক অশোকেশ দা'র সুবাদে আগেই জেনেছি এদিন শেষ পাতায় আমার পাঠানো বাসনত্মী রানী দাসের ফিচারটি ছাপা হয়েছে। পরে আরও কয়েকজন পাঠক ঢাকা থেকে ফিচারটির প্রশংসা করে ফোন করেছেন। এক ফাঁকে ওয়েবসাইটেও দেখে নিয়েছি। ফিচারটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাক হানাদার ও রাজাকাররা কতটা নির্মমভাবে বাসনত্মী রানী দাসের স্বামী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শানত্মিরঞ্জন দাসকে হত্যা করেছে এবং স্বাধীনতাপরবতর্ী দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেয়া একখানা চিঠি আর শহীদ স্বামীর এক জোড়া জুতো কী ভাবে আগলে রাখছেন। কি করে দারিদ্র্যের বিরম্নদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করছেন। তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।আবু সুফিয়ানের তাগাদায় বেশ বিপদে পড়ি। চাইলেই যে বাসনত্মী রানী দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। তিনি তা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। প্রথমত. বাসনত্মী রানী দাস উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকেন। দ্বিতীয়ত, তার ছোট ছেলের একটি সেলফোন নম্বর থাকলেও সেটি বার বার কল করেও বন্ধ পাচ্ছি। অন্য কয়েকজনকে দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। গ্রামের বাড়িতে লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু কেউ খুঁজে বের করতে পারেননি। আবু সুফিয়ান কিছুতেই এসব কারণ শুনতে চাইছেন না। দু'চার মিনিট পর পরইে তিনি ফোন করছেন। তার এক কথা_ স্যার এৰুনি কথা বলতে চাইছেন। এক পর্যায়ে তার তাগাদায় অস্থির হয়ে উঠি। শেষ পর্যনত্ম পেটে ৰুধা নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনের প্রতিনিধি মাসুদুর রহমানের সঙ্গে ভাড়ার মোটরসাইকেলের পিঠে চড়ে বসি। শহীদ জায়া বাসনত্মী রানী দাসের গ্রামের বাড়ি যখন পেঁৗছি, তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। কিন্তু সেখানে পৌঁছেও হতাশ হতে হয়। তিনি গ্রামের বাড়ি নেই। সেখান থেকে আরও প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে উলানিয়া বন্দরে তিনি তাঁর আরেক ছেলের বাসায় আছেন। একদিকে মিনিটে মিনিটে আবু সুফিয়ানের তাগাদা। তারওপর বাসনত্মী রানীকে না পেয়ে মনমেজাজ কিছুটা বিগড়ে যায়। কিন্তু কি আর করা। উপায় নেই। আবার ছুটে চলি উলানিয়ার উদ্দেশে। সেখানে পেয়ে যাই তাঁকে। কথা বলিয়ে দেই ন্যাশনাল ব্যাংক চেয়ারম্যান জয়নুল হক শিকদারের সঙ্গে। চেয়ারম্যান মহোদয় দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলেন বাসনত্মী নারীর সঙ্গে। কথা শুনে বুঝতে পারি উভয়েই আবেগ আপস্নুত হয়ে পড়েছেন। চোখ দিয়ে বার বার জল গড়িয়ে পড়ে বাসনত্মী রানীর। ফোনের ওপ্রাপ্ত থেকে বাসনত্মী রানী দাস এক পর্যায়ে সহায়তার আশ্বাস পেলেন। দেনায় দেনায় জর্জরিত হলেও তিনি নগদ অর্থকড়ি কিছুই চাইলেন না। শুধু চাইলেন এসএসসি পাস বেকার ছেলেটির একটি চাকরি। ছেলে ধনঞ্জয় দাসের বয়স প্রায় ৩৯ বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে যখন তাঁর বাবাকে পাকসেনা ও রাজাকাররা কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তখন সে তাঁর মায়ের পেটে চার মাসের। এসএসসির পাসের পরে অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। কাজ নিয়েছিলেন একটি কম্পিউটারের দোকানে। ওয়ান ইলেভেন পরবতর্ী সময়ে দোকানটি উচ্ছেদ করা হয়। তারপর থেকেই তিনি বেকার। সেলফোন ছেড়ে দিয়েই বাসনত্মী রানী দাস ছুটে গেলেন ঠাকুরঘরে। হাতজোড় করে ঠাকুরকে প্রণাম জানালেন। একটু সময় নিয়ে ধাতসত্ম হলেন। জানালেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক শিকদার তাকে বলেছেন সারা জীবন তিনি এ পরিবারটির পাশে থাকবেন। যখন যা প্রয়োজন, তা মেটাবেন। তাকে মা বলে সম্বোধন করেছেন। কাল মঙ্গলবার সকালেই ছেলে ধনঞ্জয়কে দেখা করতে বলেছেন। চাকরি নিশ্চিত। খবরটি শুনে অভুক্ত অবস্থায় সারাদিনের ছুটে চলাকে সার্থক মনে হয়। বাসনত্মী রানী দাস বার বার জনকণ্ঠের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। আফসোস করলেন কেন আরও আগে তার কথা জনকণ্ঠ তুলে ধরেনি। তাহলে দুঃখ-কষ্ট অনেক আগেই লাঘব হতো। শেষ পর্যনত্ম বাসনত্মী নারী দাসের কাছ থেকে যখন বিদায় নেই, তখন বিকাল গড়িয়ে রাতের অাঁধার নামতে শুরম্ন করেছে। চারদিক ক্রমেই ঢেকে যায় অাঁধারে। তীব্র শীত হুল ফোটায়। কাঁপন ধরায় শরীরে। দ্রম্নতগতির মোটরসাইকেল কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। রাত দশটার দিকে ঢাকাগামী গাড়িতে বসে সেলফোনে ধনঞ্জয় দাস জানান, ব্যাংক থেকে তাকে জানানো হয়েছে, কম্পিউটার সেকশনে তার চাকরি হবে। বেতন কম করে হলেও ১৬/১৭ হাজার টাকা।
একটি শহীদ পরিবারের এমন সুখবরে মন ভাল হয়ে যায়। সারাদিন অভুক্ত আর জার্নির কারণে শরীরে কানত্মি ভর করলেও ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফিরি। মাঠের একজন সংবাদকমর্ী হিসেবে নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হয় আর কিছু না হোক, একজন ব্যাংক চেয়ারম্যানের কল্যাণে একটি শহীদ পরিবার পেয়েছে নিশ্চিনত্মে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, আর এতে আমি জনকণ্ঠের একজন কমর্ী হিসেবে অংশ নিতে পেরেছি। এর চেয়ে এ মুহূর্তে আর বড় কোন সুখবর থাকতে পারে না।
_শংকর লাল দাশ, গলাচিপা
রাজশাহীতে মানুষের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস
২৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টা। শহরের সাগরপাড়ার বাসা থেকে রওনা হয়েছি। রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ ২০০৯ কভার করব এবং পরিবারের সঙ্গে অনুষ্ঠান উপভোগ করবে বলে। গৌরহাঙ্গা রেলগেটে পেঁৗছাতেই দুই পুলিশ সদস্য রিক্সার গতি রোধ করলেন। রিক্সা নিয়ে আর সামনে যাওয়া যাবে না। চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষ জেলা স্টেডিয়ামের দিকেই যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে কোন মতে ভাড়া মিটিয়ে রওনা হলাম। কয়েক গজ দূরে যেতেই সহযাত্রী স্ত্রী, পুত্র ও ভাগি্নকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেললাম। একটু পরেই ওদের খুঁজে পেলাম। স্টেডিয়ামের দিকে যেতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান গেটের কাছেই বিনোদন পিয়াসী নারী-পুরম্নষ ও শিশুদের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার দেখে অভিভূত হলাম। এত মানুষের স্টেডিয়ামে জায়গা হবে তো (!) আরেকটু এগিয়ে জেলা স্টেডিয়ামের গেটের কাছাকাছি জনস্রোতের প্রচ- ভিড় দেখে প্রথমে ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়লাম। স্টেডিয়ামে বুঝি আর প্রবেশ করা যাবে না। ভিড় ঠেলে কোন মতে স্টেডিয়ামের প্রধান গেটে গিয়ে জানা গেল ওই গেট দিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। কারণ আমাদের ভিভিআইপি পাস নেই। প্রবেশ করতে হবে দণি পাশের গেট দিয়ে। স্ত্রী ও ভাগি্নকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে পাঁচ বছর বয়সী পুত্রকে নিয়ে দণি দিকের গেটের কাছে যেতেই আমন্ত্রিত দর্শক ও মহিলাদের ওপর পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের বেপরোয়া লাঠিচার্জের কবলে পড়লাম। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও রেহাই পেলাম না। এক পর্যায়ে লাঠিচার্জ উপো করে পুত্রকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বাইরে লোকে লোকারণ্য, স্টেডিয়ামের ভেতরেও একই অবস্থা। সেখানে আগন্তুক হিসেবে আমার প্রবেশ পাস চেক করছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক। উত্তেজনায় মেয়র লিটনের ব্যক্তিগত বডিগার্ডের সামনেই পুলিশ কতর্ৃক মহিলাদের লাঞ্ছনার ঘটনা নিয়ে তাকে ধমকালাম। মেয়রের বডিগার্ড আমাকে বোঝালেন, সাধারণ মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার সামল দিতে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েই তারা লাঠিচার্জ করছিল।
ভিভিআইপিরা এক নম্বর গেট দিয়ে, সাধারণ ভিআইপিরা দুই নম্বর গেট দিয়ে এবং সাধারণ লোকজন চার নম্বর গেট দিয়ে গ্যালারিতে প্রবেশ করছিল। স্টেডিয়ামের অপর গেটগুলো বন্ধ ছিল। গোটা এলাকায় আমন্ত্রিতরা শানত্মিপূর্ণভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও গেটের কাছে আমন্ত্রিতদের চাপের অজুহাতে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিভিন্ন গেটে লাঠিচার্জ শুরম্ন করে। লাঠিচার্জ সত্ত্বেও বিকাল ৫টা পর্যনত্ম দর্শকরা স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নারী-পুরম্নষকে বাইরে রেখেই পুলিশ ভেতরে জায়গা নেই বলে সব গেট বন্ধ করে দেয়। এ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরম্নষদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ফের লাঠিচার্জ করে।
বিকাল সাড়ে ৫টায় অনুষ্ঠান শুরম্ন এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সরাসরি সমপ্রচারের কথা থাকলেও তা যথাক্রমে সাড়ে ৬টায় এবং রাত ৮টায় শুরম্ন হয়। শুরম্নতেই দেশবরেণ্য নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ ও শামীম আরা নিপা নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠের ৭ প্রতিযোগী রিপন, শাকিলা, কোনাল, তিথি, চৈতি, নদী ও রাফসান মঞ্চে আসেন প্রজাপতি সুসজ্জিত নসিমন ভ্যানে চড়ে। পরে তারা যৌথ কণ্ঠে পরিবেশন করেন 'তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে...' এরপর মহোৎসবের প্রধান বিচারক সুবীর নন্দী, রম্ননা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন ও আলাউদ্দিন আলীকে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ফারজানা ব্রাউনিয়া। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। এছাড়া বক্তব্য রাখেন রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রম্নজ্জামান লিটন। অনুষ্ঠানে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ৭ প্রতিযোগী তাদের পারফর্ম করেন। প্রথমইে মঞ্চে আহ্বান করা হয় প্রতিযোগী রিপনকে।
এক পর্যায়ে উপস্থাপিকা ফারজানা ব্রাউনিয়া দ্বিতীয় রানারআপ নদীরাজ-এর নাম ঘোষণা করলে উপস্থিত দর্শকরা নীরবতা ভেঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। এরপর প্রথম রানারআপ চৈতী এবং সবশেষে সেরাদের সেরা কোনালের নাম ঘোষণা করা হয়। সমাপনী অনুষ্ঠানে চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রম্নজ্জামান লিটন, চ্যানেল আই পরিচালক শাইখ সিরাজ, অনুষ্ঠান পরিচালক জহির উদ্দিন ও আব্দুর রশিদ উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার বাইরে রাজশাহী স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো আয়োজিত চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ ২০০৯ উপল েআয়োজিত মহোৎসবকে ঘিরে স্থানীয় গণমানুষের মধ্যে এত বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস রাজশাহীতে ইতোপূর্বে আর দেখিনি। এ নিয়ে কয়েকদিন থেকেই চলছিল রাজশাহীর মানুষের প্রস্তুতি। মহোৎসবে ঢাকা থেকে শামিল হতে আসা ৫ শতাধিক সেলিব্রিটি অতিথিদের সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন রাজশাহীর লাখো দর্শক। দর্শকদের চিৎকার, চেঁচামেচি আর হর্ষধ্বনিতে সমগ্র স্টেডিয়াম চত্বর হয়ে ওঠে মুখরিত।
সেরাকণ্ঠের জ্বরে আক্রানত্ম হাজার রাজশাহীবাসীর প্রবেশকার্ড পেয়েও স্টেডিয়ামে প্রবেশের সুযোগ না পেয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন। অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য আগে থেকেই রাজশাহীর সর্বসত্মরের মানুষের মাঝে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছিল তার বহির্প্রকাশ ঘটে কয়েকদিন আগে থেকেই। রাজশাহী শহর ছাড়াও জেলার প্রত্যনত্ম এলাকার মানুষ বিনামূল্যের প্রবেশ পাসের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সাধারণ উপায়ে প্রবেশ পাস সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে পরিচিতরা সাংবাদিকদের কাছেও ধর্না দেয়। কিন্তু বিধিবাম, আয়োজকরা অনুষ্ঠান কভার করার জন্য সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কোন প্রবেশ পাস দেয়নি। শুধু তাই নয়, স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানস্থলে সাংবাদিকদের বসার জন্যও পৃথক কোন ব্যবস্থা রাখেনি। ফলে ভেতরে প্রবেশ করেও বসার জায়গা না পেয়ে সাংবাদিক হিসেবে মহাদুশ্চিনত্মায় পড়লাম। শেষ পর্যনত্ম দাঁড়িয়েই অনুষ্ঠান দেখছিলাম আর নোট নিচ্ছিলাম। রাত ১০টার দিকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বাসায় ফেরার সিদ্ধানত্ম নেই। কিন্তু গেটের কাছে আসতেই আবারও পুলিশের লাঠিচার্জের কবলে পড়ে দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ও মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হই। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে কোন মতে বাসায় ফিরে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। তখন মাথায় কোন কাজ করছিল না। রাতেই অফিস থেকে শ্রদ্ধেয় জলি আপার ফোন, আনিস সেরাকণ্ঠের নিউজটা পাঠাবে না। আপাকে স্টেডিয়ামের ঘটনা ও আমার আহত হওয়ার বর্ণনা দেই। আমার শারীরিক-মানসিক অবস্থার কথা বলে নিউজ পাঠানোতে অপারগতার কথা বলি। তারপরও প্রথম আলো ও সমকালের সহকর্মীদের ফোন করি, তারা নিউজ পাঠাচ্ছে কিনা? তারা জানায়, পত্রিকার ঢাকা অফিস থেকে তাদের রিপোর্টার এসেছেন। সুতরাং নিউজের চিনত্মা তাদের নেই। আবার ফোন করি বিডিনিউজের ইসমাইল হোসেনকে। ইসমাইলও অপরাগতার কথা জানায়। প্রচ- শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার কারণে আমিও এক পর্যায়ে নিউজের চিনত্মা ছাড়তে বাধ্য হই। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি ঘটনা অনেক দূর গড়াবে। ২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিউজ লিখতে বসি। এর মধ্যে ডেপুটি চীফ রিপোর্টার কাওসার ভাই ফোন করে রাতের অনুষ্ঠান, পরিস্থিতি ও নিউজের বিষয়ে কথা বললেন। তিনি মূল নিউজের পাশাপাশি একটি রিপোর্টারের ডায়েরি পাঠাতে বলেন। কথা সেরে পুনরায় নিউজে মনোযোগ দেই। দুপুরের মধ্যে অফিসে নিউজ পাঠিয়ে বাসায় ফিরি। সন্ধ্যায় পরম শ্রদ্ধেয় উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব ভাইয়ের ফোন, আচ্ছা এত বড় ঘটনার নিউজটা তুমি রাতে পাঠাওনি কেন? আমরা নিউজটা কেন মিস করলাম? ইত্যাদি। আমি তোয়াব ভাইকে রাতে অনুষ্ঠানস্থলের পরিস্থিতি, পুলিশের লাঠিচার্জ ও আমার শারীরিক-মানসিক অবস্থার কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তোয়াব ভাই বুঝতে চান না। রাতে জলি আপার ফোন ও নিউজ পাঠানোর বিষয়ে কথাসহ আমার শারীরিক-মানসিক অবস্থার কথা বলার শত চেষ্টা করেও তোয়াব ভাইকে বোঝাতে পারলাম না। তিনি আবারও ফোন করেন এবং আমাকে গুরম্নত্বপূর্ণ নিউজের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার জন্য সতর্ক করে টেলিফোন রেখে দেন। এতবড় একটা নিউজ আমার পাঠাতে না পারা এবং জনকণ্ঠের মিস করাতে তোয়াব ভাইয়ের কষ্ট আমিও অনুভব করি। কিন্তু আমারও তো কোন উপায় ছিল না। আশা করি এই রিপোর্টারের ডায়েরি প্রকাশিত হলে প্রিয় পাঠক প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন এবং বিষয়টি মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
_আনিসুজ্জামান, রাজশাহী
নদী বাঁচুক, মানুষ বাঁচুক, পরিবেশ বাঁচুক
৬ জানুয়ারি বুধবার। সব জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সরকার নদী দূষণমুক্তকরণের কাজ শুরম্ন করেছে। ওইদিন ৪টি কাটার মেশিন নিয়ে তারা নদী থেকে বর্জ্য উত্তোলন করতে শুরম্ন করে। বুড়িগঙ্গা নিয়ে দীর্ঘদিন রিপোর্ট করার কারণে ওইদিনের রিপোর্ট কভারেজের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। কুয়াশা ঘেরা শীতের সকালে ছুটতে হলো সদরঘাটের উদ্দেশে। কিনত্ম পথের জ্যামে তারপর আবার জাতীয় পার্টির কাউন্সিল থাকার কারণে পেঁৗছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। যখন সদরঘাটে পেঁৗছি তখন বর্জ্য অপসারণ উদ্বোধনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। লঞ্চঘাটের পন্টুনে উঠে কোথায় বর্জ্য অপসারণের কাজ হচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর মিলল না। অবশেষে ফোন করলাম কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি সালাউদ্দিন মিয়ার কাছে। সে জানালো, ঘাটের দৰিপাড়ে বর্জ্য অপসারণ কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রথমদিন তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে অফিসে ফিরলাম। দ্বিতীয় দিনে আবার গেলাম সরেজমিনে। নৌকায় ওপারে ভাড়া নিল ১০ টাকা। পানিতে ব্যাপক দুর্গন্ধ যে টিকা দায়। তবুও ৰণিকের নৌকা ভ্রমণে অনেক মজার মনে হলো। এরপর ওপারে গিয়ে বর্জ্য অপসারণকারীদের সঙ্গে কথা বলে আবার ফিরে এলাম অফিসে। এরপর কয়েকদিন নদী নিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করলাম। কিন্তু নদীর করম্নণ দশা দেশে খুব দুঃখ পেলাম।
বুড়িগঙ্গা আজ এমনভাবে দূষিত যে, আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এর পাড়ে গেলে মনে হয় যেন নর্দমার ড্রেন। পানির রং এত কালো যে, আলকাতরাকেও হার মানায়। দুর্গন্ধে মুখে রম্নমাল চেপে ধরতে হয়। তীর যেন আবর্জনার ভাগাড়। কিন্তু যে নদী মানুষের জীবনধারাকে অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন স্বচ্ছল করে রাখল তার প্রাপ্য কি এই? এই কি মানুষের প্রতিদান। যে নদীর পানি পান করে মানুষ জীবন ধারণ করে সে নদীতে এখন মাছও বাস করতে পারে না। অক্সিজেনের মাত্রা জিরোতে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গায় এখন নৌচলাচলও নিরাপদ নয়। কিন্তু বুড়িগঙ্গার এই অবস্থা একদিনে হয়নি। শিল্পায়ন ও ভূমিদসু্যদের অতি লোভের কারণে নদীকে যেমন দখল করে দিনে দিনে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা, তেমনি কলকারখানার বর্জ্য এর পানিকে করেছে দূষিত। কিন্তু কোন সময়ে নদী বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। এখন নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার শিল্পকারখানা। এসব শিল্প কারখানার প্রায় ৫০ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। হাজার হাজার সু্যয়ারেজের লাইন এসে মিশেছে এই নদীতে। আইন অনুযায়ী বর্জ্য শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধিত না করে নদীতে ফেলা নিষেধ। এ আইনের প্রয়োগ বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাসত্মবে প্রয়োগ করা হয়নি কখনও। বুড়িগঙ্গা নিয়ে পরিবেশবাদীরা আন্দোলন তো কম করেনি। কিন্তু কে বাঁচাবে বুড়িগঙ্গা। কার দায়িত্ব আছে বাঁচানো। জনগণ তো রয়েছে অবচেতন। তারা ঘূর্ণাৰরেও বুঝতে পারেনি তাদের অগোচরে কত ৰতি হয়ে গেল। এখন তো হায় হায় করে কোন লাভ নেই। কারণ নদীর তো কোন অভিভাবক নেই। বুড়িগঙ্গার অভিভাবক হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেয়া হলো তারা কারসাজি করে নদীর জমি অন্যের কাজে লিজের নামে চিরতরে বরাদ্দ দিয়ে দিল। সংশিস্নষ্টরা বলছেন, সরকার যে সিদ্ধানত্ম নিয়েছে তা ইতিবাচক। কিন্তু কতটা বাসত্মবায়ন করা যাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বর্জ্য অপসারণ এখানও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায়নি। নদীতে আবর্জনা আগের মতো ফেলছে। যে পলিথিনের কারণে নদীর এ অবস্থা উৎপাদন নিষিদ্ধ থাকলে উৎপাদনকারীরা থেমে নেই। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বর্জ্য অপসারণে সঙ্গে সঙ্গে পলিথিনের উৎপাদন কঠোর হসত্মে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নদীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ কলকারখানার বর্জ্য ও লঞ্চ থেকে পোড়া মবেল ও তেল ফেলা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। আর সরকার এটা করতে পারলে নদী দূষণমুক্ত হবে। মানুষ বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে।
_শাহীন রহমান
No comments