বইমেলা আমার নিজস্ব ইতি-নেতি বিশ্লেষণ- মাসুদা ভাট্টি
বইমেলা_ বাংলাদেশে হরে-দরে হাজারো মেলার মাঝে বইমেলা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন বইমেলার নাম শুনলেই প্রাণ নেচে ওঠে তা ভেবে বের করার বিষয় নয়, এটা আসলে একটা উপলব্ধির ব্যাপার।
মজার ব্যাপার হলো, খুব কঠিন-প্রাণ মানুষও যখন মেলার নাম শুনলেই নাক শিঁট কোন কিংবা নানা অজুহাতে নিজে বা ছেলেমেয়েদের সেখানে যেতে নিষেধ করেন তারা কিন্তু বইমেলার ব্যাপারে অসম্ভব এক উদার অবস্থান নিয়ে থাকেন। শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা আপামর বাঙালীর কাছে এক অদ্ভুত প্রাণজোয়ার সৃষ্টিকারী ও ব্যাপক উদ্দীপনাদায়ী। আর বাংলা ভাষায় যাঁরা লেখেন তাঁদের কাছে তো বইমেলা আসলে সারা বছর ধরে বালুময় পথে হেঁটে এসে এক সবুজ শীতল মরূদ্যানে বসে খানিকণ জিরিয়ে নেয়ার জায়গা। বই বিক্রি হওয়া এখানে মুখ্য বিষয় নয়, এখানে পাঠকের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়া, প্রাণের আদান-প্রদান হওয়া এবং সবের্াপরি বছরে একবারও দেখা না হওয়া অন্য লেখকদের সঙ্গে দেখা হওয়া_ সব মিলিয়ে বাংলা ভাষার লেখককূল এই মেলার পথচেয়ে থাকেন ফেব্রুয়ারির শেষ দিন যখন এই মেলা শেষ হয় সেদিন থেকেই, কবে আবার এই মেলা ফিরে আসবে সে জন্য।আরও একটি মজার ব্যাপার হলো, বাঙালী মানসকে বুকে ধারণ করে যাঁরা মনে হাজারো কষ্ট পুষে রেখে শুধু জীবনের প্রয়োজনে প্রবাসে বসবাস করেন তাদের জন্য এই বইমেলা এক অনন্য সুযোগ বাংলাদেশে আসার। বছরে একটিবারও যদি কেউ দেশে বেড়াতে আসেন তাহলে এই বইমেলাকে কেন্দ্র করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে আসার তারিখ ঠিক করেন, সে অনুযায়ী কর্মত্রে থেকে ছুটি নেন। বাঙালী জীবনের অনেক ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গের সঙ্গে বইমেলা এখন প্রধানতম জায়গাটি দখল করে নিয়েছে, বিশেষ করে শিতি মধ্যবিত্ত বাঙালীর।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এবং আন্তজর্াতিকভাবে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু বইমেলায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। যেমন ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার, ব্রিটেনের হে ফেস্টিভ্যাল, কলকাতা বইমেলা, কায়রো বুক ফেয়ার, মস্কো বুক ফেয়ার ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি জায়গায় ল্য করেছি যে, এখানে মূলত পাঠকের পাশাপাশি ুদ্র ুদ্র লাইব্রেরী মালিকেরা আসেন বিশেষ মূল্য ছাড়ের সুযোগ নিয়ে সারা বছরের বই কিনে নিতে। প্রকাশকরা এসব মেলা থেকে পেয়ে যান ভাল এবং সম্ভাব্য ডিস্ট্রিবিউটর। এদিক দিয়ে বাংলা একাডেমীর বইমেলা কেবল পাঠক-লেখক-প্রকাশকদেরই মিলনত্রে। আমি জানি না, এখান থেকে পুস্তক-ব্যবসায়ীরা সুলভে বই কিনে নেন কি না। যদি নেন তাহলে বলার কিছু নেই, কিন্তু যদি না নেন তাহলে এই মেলা ডিস্ট্রিবিউটরদের সে সুযোগ করে দিতে পারে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু বিশ্বের অন্যত্র বইমেলা ছাড়াও মানুষ সারা বছর বিপুল পরিমাণে বই কিনে থাকেন। বাংলাদেশে এই অভ্যাসটি অনুপস্থিত। তাই কেবলমাত্র এই মেলাকে কেন্দ্র করে বই বিক্রির পরিমাণ নিধর্ারণ আসলে আমাদের জাতীয় দীনতাকেই ফুটিয়ে তোলে, অন্য কিছু নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাঙালীর পাঠাভ্যাস যে অনেক কমে গেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত মহলে আলোচনা করলেই। কিছু বাজার চলতি বইয়ের নাম মুখস্ত করে রেখে আলোচনার সময় তা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে পাঠক প্রমাণের চেষ্টা কোন ভাল ইঙ্গিত বহন করে না। অনেকে হয়ত অভিযোগ করবেন যে, এক কেজি চাল জোগাড় করাই যেখানে কষ্টের সেখানে টাকা খরচ করে বই কেনার সামর্থ অনেকেরই থাকার কথা নয়। এ কথা খুবই যৌক্তিক সন্দেহ নেই, কিন্তু যাদের সামর্থ আছে তাঁরা? তাঁরা কি বই কেনেন? সন্তান কিংবা প্রিয়জনদের বই উপহার দেন? আমার জানা এবং পরিচিত ব্যক্তিদের কাউকে এই কাজটি করতে দেখিনি। তাঁরা লাখ লাখ টাকা দিয়ে সাহাবুদ্দিনের একটি ছবি কিনে বসার ঘরে ঝুলিয়ে নিজেদের শিল্প-প্রেমের জানান দেন কিন্তু তাঁদের অনেকের বাড়িতেই হ্যাজাক বাত্তি দিয়ে খুঁজেও একটি বই পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। বাঙালীর এই মেধা-বিনাশী চরিত্র আমাকে অবাক করে খুব। লক্ষ্মীর সঙ্গে স্বরসতীর সম্পর্ক নেই বলে যে প্রবাদের কথা আমরা বলে থাকি তা বোধ করি বাঙালীরই নিজস্ব, এতে অন্য কোন জাতির হিস্যা নেই। বইমেলা নিয়ে আরও একটি নেতিবাচক কথা বলে লেখাটি শেষ করব। বিগত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বই মেলায় হাজির থেকে একে খুব কাছে থেকে দেখে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। এর আগে বইমেলায় এসে বই কেনার অদম্য সাধ হলেও সাধ্যে কুলাতো না। কেনা এবং সংগ্রহে রাখার মতো এত বই এই মেলায় থাকত যে, সেগুলো কিনতে না পারার কষ্ট চেপে রাখা দায় হতো। আর এখন? কেনার সামর্থ আছে কিন্তু হাতে গোনা একটি দুম্বটি ছাড়া মেলায় আসা নতুন বইয়ের বেশিরভাগই কেনা কিংবা সংগ্রহে রাখার যোগ্য নয়। আমার লেখক সত্তাকেও আমি একই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একটু উঁচু গলায়ই বলতে চাই যে, এই প্রতিবছর মেলায় হাজার হাজার নতুন বই বের হয় সেগুলো থেকে কম্বটি বই আসলেই পাঠযোগ্য, প্রণিধানযোগ্য এবং আরেকজনকে পড়ার জন্য অনুরোধযোগ্য তা হাতে গুনে বলে দেয়া যাবে নিঃসন্দেহে। সেদিক দিয়ে বইমেলা নতুন লেখকদের বই প্রকাশের বিশেষ করে গাঁটের কড়ি খরচ করে প্রকাশককে দিয়ে বই প্রকাশের একটি উত্তম জায়গায় পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু বাংলাদেশের প্রকাশকরা লেখকদের পয়সা দেন না বলে চরম একটি দুনর্াম রয়েছে সেহেতু এই বই মেলা দিন দিন হয়ে পড়ছে সম্পূর্ণ বৈষয়িক একটি ব্যাপার। মেলা মানেই ব্যবসা_ এটা সত্য বলে মেনে নিলেও বই নিয়ে ব্যবসার মধ্যে খানিকটা মহত্ত্বযোগ থাকে এবং বাংলা একাডেমীর বইমেলা এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু দিন দিন তার এই পতন আসলে আমাদের বাঙালী চরিত্রের আরেকটি দিককেই প্রতিফলিত করে তুলছে আর সেটি হচ্ছে, আমরা আমাদের যে কোন অর্জনকেই খুব দ্রুত বিসর্জনের দিকে নিয়ে যেতে পারি। এটা আমাদের স্বাধীনতার েেত্র যেমন প্রযোজ্য তেমনই প্রযোজ্য বইমেলার েেত্রও। কিন্তু তারপরও এই বইমেলার গুরুত্ব লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মহামিলনে এবং এক মাসব্যাপী এক অনিন্দ্যসুন্দর উৎসব মুখরতায়_ এর সঙ্গে যদি সত্যি সত্যি কিছু কেনার মতো এবং সংগ্রহে রাখার মতো বইও আমরা লেখককূল পাঠককে উপহার দিতে পারতাম তাহলে সোনার সঙ্গে সোহাগও যোগ হতো। আপাতত যতটুকু পাচ্ছি তাতেই আমি খুশি, তারপরও আশা করতে অসুবিধে কোথায়? পুঁজিবাদের এই দণ্ডকারণ্যে একটি নিরাপদ এবং নির্মল বইয়ের মেলা যে আমাদের জন্য কতটা জরুরী সেটা মধ্যবিত্ত বাঙালী মাত্রেই জানেন। আশা করি এবারের বইমেলায় অযাচিত ও পীড়াদায়ক কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে আইন-শৃক্মখলা রাকারী বাহিনী নজর রাখবে এবং একে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সরকার তা নিশ্চিত করবে। কারণ বাঙালীর প্রাণে আনন্দ দেয় এমন নির্মল ত্রে আর বেশি অবশিষ্ট নেই।
শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১০
বট্রলঢটঠদর্টর্ধআদর্মবটধফ.ডমব
No comments