একুশের বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা by ইকবাল আজিজ
বাংলাদেশে অমর একুশের বইমেলা যেন আমাদের প্রাণের মেলা। গত প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেছে।
পাশাপাশি প্রতিবছরেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে 'ঢাকা আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলাম্বর আয়োজন করা হচ্ছে, কিন্তু সে মেলাটির কোন আন্তর্জাতিক চরিত্র আজ অবধি গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া তা কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক মেলাতেই পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মেলা সেখানে জমে ওঠেনি। অপরদিকে বাংলা একাডেমীর আঙ্গিনায় প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে যে 'অমর একুশের বইমেলাম্ব বসছে তা আমাদের স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অন্য যে কোন বইমেলার তুলনায় এ মেলায় বই বিক্রিও প্রচুর হয়; এ দেশের সকল শ্রেণীর পাঠক সারা বছর অপোয় থাকে, কবে বসবে একুশের বইমেলা! সৃজনশীল প্রকাশক এবং লেখকদের কাছে এ মেলা সারা বছরের সেরা উৎসব। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকদের মিলনমেলা আমাদের বাংলা একাডেমীর বইমেলা।অন্যবারের 'একুশের বইমেলাম্বর সঙ্গে এবারের বইমেলার একটি মৌলিক তফাৎ হলো, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বাঙালী জাতি ওই প্রথম এক ধরনের কলঙ্কমুক্ত ও দায়মুক্ত পরিবেশে 'একুশের বইমেলাম্বয় অংশ নিচ্ছে। এতদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা এই পৃথিবীতে তাদের কুৎসিত অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করেছে। একজন লেখক হিসাবে প্রায়ই মনে হতো, বাঙালীর এত সৃজনশীল গল্প-কবিতা নির্মাণের সব উদ্যোগই হয়ত ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি বাংলাদেশের স্থপতির খুনীদের কোন বিচার না হয়। তবে কীসের এই মিলনমেলা? আর কেনই বা অমর একুশের বইমেলা? বাঙালী জাতি কলঙ্কমুক্ত হওয়ার পর এবারের একুশের বইমেলা আমাদের চিন্তা ও চেতনায় একটি আলাদা মাত্রা যোগ করবে। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনীর সহযোগী ও স্বাধীনতা বিরোধীরা চুপ করে বসে থাকবে বলে মনে হয় না। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তারা বাঙালী জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও বিএনপি-জামায়াত চক্র সব সময়ই চেয়েছে, উদ্ভট 'বাংলাদেশী সংস্কৃতিরম্ব ছদ্মবেশে এদেশে সুপরিকল্পিতভাবে এক ধরনের পাকিস্তানী সংস্কৃতি কায়েম করতে। লেখক ও প্রকাশকদের ছদ্মবেশে এদেরই একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ একুশের বইমেলা ও অনান্য সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে তাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। এরা সুকৌশলে আমাদের বাঙালিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে চায়। বইমেলায় যাতে এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র অনুপ্রবেশ না করতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এদের রুখতে হবে। বাংলা একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান দীর্ঘকাল বাঙালীর লোকসংস্কৃতির গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে প্রতিমুহূর্তেই মনে হয়েছে, বাঙালী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর ধারণা ও অভিজ্ঞতা খুবই সমৃদ্ধ। তিনি অবশ্যই বাঙালীর মননের প্রতীক বাংলা একাডেমীর বইমেলাকে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে গড়ে তুলবেন_ এ বিশ্বাস আমাদের সবার।
একুশের বইমেলার সঙ্গে কলকাতা বইমেলা কিংবা পৃথিবীর আরও অনেক বইমেলার একটি বড় পার্থক্য হলো, অন্যসব বইমেলার মূল ভিত্তি বাণিজ্যিক; কিন্তু আমাদের বাংলা একাডেমীর মেলার মূল ভিত্তি বাঙালীর ভাষা, সাংস্কৃতিক বোধ ও ঐতিহ্য। প্রতিবারই একুশের বইমেলায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা উপল েএখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের যে আনন্দমেলা বসে, তা একটি মহৎ সাংস্কৃতিক বোধকে ধারণ করে বিকশিত হয়েছে। একুশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ফসল বাংলা একাডেমী বাঙালীর ভাষা ও সাহিত্য গবেষণার মূল কেন্দ্র; বাংলাদেশ ও বিশ্বের প্রতিটি বাঙালীর কাছে বাংলা একাডেমীর অবস্থান অনেকটা তীর্থের মতো। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছেন, বইমেলার জায়গা বাড়ানোর ল্যে একুশের বইমেলাকে অন্য বড় ময়দানে স্থানান্তর করা হোক। এই প্রস্তাবটি খুবই বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একুশে বইমেলা বিকশিত হয়েছে বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্র করে, বর্তমানে এই বইমেলা ও বাংলা একাডেমী প্রায় সমার্থক। তাই অমর একুশে বইমেলাকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে বাঙালী জাতির জন্য আত্মঘাতীর শামিল। এ ছাড়া ইতোমধ্যে বর্ধমান হাউসকে বাঙালীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। একাডেমীর গুরুত্ব এখন দেশ ও জাতির কাছে আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলা একাডেমীর ঐতিহ্যবাহী পুকুরের পাশে একাডেমীর প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। তবে কাজী নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত এই পুকুরটি যেন সম্পূর্ণ বুজিয়ে ফেলা না হয়_ একাডেমীর নির্বাহী পরিষদের কাছে এ আমার একান্ত অনুরোধ। নতুন গণতান্ত্রিক পরিবেশে ২০১০ সালের অমর একুশের বইমেলা আমাদের চেতনায় নিঃসন্দেহে মানবতাবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটাবে। সেই আশির দশকের সূচনা থেকে এই মেলায় আমি নিয়মিত আসছি। এক সময় আহসান হাবীব, শওকত ওসমান, কামরুল হাসান অমর একুশের বইমেলায় ঘুরে বেড়াতেন। কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে এখানে কত সন্ধ্যা কেটেছে আমাদের। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীকম্ব। দিনটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম অবিস্মরণীয় দিন। বন্ধু, শুভাকাঙ্ী ও অচেনা পাঠকেরা দল বেঁধে এসে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এবং 'অনিন্দ্য প্রকাশনীম্বর স্টল থেকে আমার স্বারিত বইটি কিনেছিলেন। সেই মফস্বল থেকে কেবলমাত্র সাহিত্যের জন্যে রাজধানীতে এসে বহু সংগ্রাম ও সাধনার পর বাংলা একাডেমীর বইমেলাতে সেই প্রথম বই বিক্রির দিনগুলোকে মনে হয়েছিল স্বর্গীয় আনন্দের দিন। এক বিকেলে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আবু হেনা মুস্তফা কামাল মেলা পরিদর্শনে এসে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এ ছিল নিঃসন্দেহে এক মহৎ মানুষের মহানুভবতা। এখন একবিংশ শতকে জীবনের এই জটিল দুঃসময়ে ভাবি, হেনা স্যারের মতো এমন মহৎ মানুষ কি আর পাওয়া যাবে?
আমরা চাই প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একুশের বইমেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হোক। একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপল েসারা পৃথিবীতে উদ্যাপিত হচ্ছে। আমার স্বপ্ন 'অমর একুশের বইমেলাম্ব একদিন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে 'মাতৃভাষার মেলাম্ব বা 'মাতৃভাষার উৎসবম্ব হিসাবে বিবেচিত হবে। পুকুরপারে নির্মীয়মাণ বহুতল ভবনটিই যেন হয় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে নির্মিত শেষ ভবন। এখন দরকার এখানকার বটতলা, প্রতিটি বৃ, পুকুর ও বিশাল অঙ্গনটিকে রা করা। শুনতে পাচ্ছি, এবারও দেশের সব বিখ্যাত, অখ্যাত, প্রবীণ ও নবীন প্রকাশনা সংস্থা অমর একুশের বইমেলায় অংশ নেবে। প্রতিদিন মেলায় আসবেন বিপুল সংখ্যক পাঠক ও ক্রেতা। তাঁরা শুধু বই কিনতেই আসবেন না, আড্ডা দেয়াও অমর একুশের বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ। সুতরাং ক্যান্টিন বা রেস্টুরেন্টের সংখ্যা অবশ্য পাঁচ-সাতটি হওয়া দরকার। শুধুমাত্র বাংলা একডেমীর মালিকানাধীন একটি ক্যান্টিন কি এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধারণ করতে পারে? এ ছাড়া আরও একটি জিনিস আবশ্যক। সবারই অভিযোগ, বিশেষ করে মহিলাদের অভিযোগের পাল্লাটা এেেত্র ভারি; এত বড় মেলায় পরিচ্ছন্ন টয়লেট একটিও নেই। একাডেমী কর্তৃপ কি মানুষের এই মৌলিক ও অপরিহার্য প্রয়োজনের বিষয়টি ভাববেন?
সারাদেশে সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা এখন কিছুটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। কিন্তু তাদের বিষয়ে সদা সতর্ক থাকা দরকার। আগেই বলেছি, স্বাধীনতাবিরোধী ও ধমর্ীয় কট্টরপন্থী সন্ত্রাসীদের হামলার অন্যতম ল্য অবশ্য বাঙালী সংস্কৃতি। তাই মেলা প্রাঙ্গণে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দরকার। এ বিষয়ে একাডেমী ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কতখানি সতর্ক? রমনা বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার কথা কি আমরা ভুলে গেছি? এ ছাড়া মেলার মাঝখানে লেখকদের বসার সুব্যবস্থা থাকবে তো? ফাল্গুন মাসে মেলায় ধুলো যাতে না ওড়ে, সে জন্য মেলা প্রাঙ্গণে পানি ছড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। ধুলোর কারণে অনেক বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি অমর একুশের বইমেলায় যেতে চান না। তাই চাই পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সুব্যবস্থা।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এক নতুন বাংলাদেশ। কামনা করি, ২০১০ সালের অমর একুশের বইমেলা বাঙালী জাতির সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
No comments