বিশ্ব বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে by মহসিন চৌধুরী
গত দু'মাসে কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতেই ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আনত্মর্জাতিক বাজারে চাল, ডাল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বুকিং রেট ধীরে ধীরে বাড়ছে। জানুয়ারিতে ভারতেই বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১৭ ভাগ।
চীনে বেড়েছে ১৩ ভাগ। এতে বাংলাদেশেও বিভিন্ন ধরনের আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই চলতি উৎপাদন মওসুমের মজুদ মূল্যায়ন না করলে আবারও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে এবং দাম বৃদ্ধি প্রবণতা লাগামহীন হতে পারে। নতুন করে সুযোগ নিতে পারে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো।খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের সূত্র জানায়, বাংলাদেশের চাহিদার প্রধান কৃষিজ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে চীন এবং ভারত থেকে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, ইংল্যান্ড এবং মধ্য ইউরোপ থেকেও বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। কিন্তু চলতি মওসুমে ভারতে উৎপাদন সনত্মোষজনক নয়। বিগত বর্ষায় খরার কারণে উৎপাদন আগে থেকেই ৩০ ভাগ কম হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। গত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে ভারতীয় বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরম্ন করে। আগেভাগে খাদ্যের মজুদ এবং রফতানির ওপরও বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। একই পরিস্থিতি চীনের বাজারেও। চীনে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত না হলেও আনত্মর্জাতিক বাজারের কারণে বিভিন্ন পণ্যের বুকিং রেট কমছে না। বরং সামান্য উর্ধমুখী। ভারতীয় বাজারের বরাত দিয়ে চট্টগ্রামে ইনডেন্টররা জানিয়েছেন, ডিসেম্বর মাসে ভারতে বিভিন্ন পণ্যের দাম উর্ধমুখী প্রবণতা শুরম্ন হয়। জানুয়ারিতে এখানে দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮১ ভাগ। চিনি, চাল, ডাল, আলু এবং দুধের দাম উর্ধমুখী। চালের উৎপাদনে প্রভাব পড়ায় আলুর চাহিদায় প্রভাব পড়েছে। ভারতে আলুর ব্যবহার বেড়ে গেছে পূর্ব বছরের চেয়ে দু'ভাগ বেশি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় কর্তৃপৰ আগেভাগেই বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা করেছে। কেবিনেট কমিটি অন প্রাইজ (সিসিপি)কে সক্রিয় করা হয়েছে। এ কমিটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং স্বয়ং উপস্থিত থেকে চিনি এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য পণ্যের উর্ধমুখী প্রবণতা রোধ করে বাজার স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে ভারতের বিভিন্ন বাজারে রেশনের মাধ্যমে পরিবার প্রতি ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম পরিবার প্রতি চাল এবং গম নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ভারতে কৃষিপণ্য উৎপাদন সনত্মোষজনক না হওয়ায় তারা এ বছরও ডাল, গমসহ বেশকিছু পণ্য রফতানির উপর বিধিনিষেধ রাখছে। খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে মজুদেরও ব্যবস্থা নিচ্ছে। এতে আনত্মর্জাতিক বাজারে এর প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়ছে। চীনে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বেশকিছু দিন থেকে উর্ধমুখী। অথচ, এখানেও কৃষিপণ্য মাঠ থেকে উৎপাদন শুরম্ন হয়ে গেছে। আশানুরূপ কমছে না দাম। পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের বুকিং রেট কয়েক ডলার করে বেড়েছে। এসব রেটে পণ্য আমদানি হলে স্থানীয় বাজারে দাম আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। গত দু'মাসে গড়ে এখানেও বিভিন্ন ধরনের পণ্যের বুকিং রেট বেড়েছে ১৩ ভাগ। অথচ, মওসুমের এ সময়ে আনত্মর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের দর নিম্নমুখী থাকে। কিন্তু কোন কোন পণ্য স্থিতিশীল আবার কোন কোন পণ্যের বুকিং উর্ধমুখী। এ নিয়ে বাংলাদেশের তথা খাতুনগঞ্জের ইনডেন্টররা উদ্বিগ্ন। বিশ্বের অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়তে পারে। আর ভারত আনত্মর্জাতিক বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে শুরম্ন করলে দ্রব্যমূল্য চরম আকার ধারণ করে।
এদিকে, খাতুনগঞ্জের আমদানি পণ্যের বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের দর ধীরে ধীরে উর্ধমুখী। নিয়মিতভাবে বাড়ছে চিনির দাম। চিনি আমদানিকারক এবং রিফাইনারি মালিকরা জানিয়েছেন, আনত্মর্জাতিক বাজারে 'র' ও ফিনিশড চিনির বুকিং রেট ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে তাদের করার কিছু নেই। বর্তমানে প্রতিমণ রেডি চিনির দাম ২২শ' টাকায় উন্নীত হয়েছে। অথচ, গত সপ্তাহেও স্থানীয় বাজারে চিনির দাম ছিল ২ হাজার টাকার নিচে। বর্তমান বুকিং রেটে চিনির কাঁচামাল এলে দাম আরও বাড়বে। চালের দামও বাড়ছে নিয়মিত। গত এক মাসে চালের দাম গড়ে কেজিপ্রতি ২/৩ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ, কৃষকের ঘরে মাত্র চাল উঠেছে। সামনে মজুদ ফুরালে আমদানি পণ্যের উপর চাপ পড়বে। একযোগে চাল আমদানি শুরম্ন হয়ে গেলে দাম আকাশচুম্বী হয়ে যেতে পারে। গমের বাজার কিছুটা স্বাভাবিক। তবে সাম্প্রতিকালে গমের আমদানি ছিল ব্যাপক। বর্তমানে গম আমদানি হ্রাস পেয়েছে। এতে গমের মজুদ শেষ হলে প্রভাব পড়তে পারে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দুধ, ভোজ্য তেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম ওঠানামা করছে। ভারতে পেঁয়াজের বুকিং রেট কমছে না। এ সময় সাধারণত পেঁয়াজের দাম থাকে নিম্ন পর্যায়ে। কিন্তু কলকাতাতেই পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি ৩০ টাকা। তাই স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য পণ্যের দামও প্রতি কেজিতে ৪/৫ টাকা করে বেড়েছে। বুকিং রেট উর্ধমুখী থাকায় এসব পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।
কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর উৎপাদন এবং স্থানীয় চাহিদা নিয়ে সরকার এখন থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশেও ভোগ্যপণ্যের দর নতুন করে বেড়ে যেতে পারে। ভারত ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে বাজার মনিটরিংয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ সুযোগে আবারও গজিয়ে উঠছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের নানা নেটওয়ার্ক। এসব সিন্ডিকেট ভোগ্যপণ্য নিয়ে বর্তমান বাসত্মব পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের সর্বস্বানত্ম করতে পারে।
No comments