ভেজাল ও নিম্নমানের রাসায়নিক সার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা by এ এম এম শওকত আলী
ভেজাল ও নিম্নমানের সার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে নব্বই দশকের পূর্বে সচেতনতা খুব একটা ছিল না। ঐ দশকের পূর্বে সার বিপণন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণের পরিধি বিভিন্ন প্রকার সারের পুষ্টিগত উপাদানের গেজেটে প্রজ্ঞাপিত একটি নির্দেশ ছিল।
সার আমদানী ও প্রস্তুতকারকদের এ বিষয়টি নিশ্চিত করার বিধান ছিল। অন্যথায় সার বিপণন করার অনুমতি প্রদান করা হতোনা। ঐ সময় সার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কোন পৃথক আইন ছিলনা। অন্যান্য প্রচলিত আইন যথা ফৌজদারী আইনের মাধ্যমেই কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অপরাধী সাব্যসত্ম হলে উপযুক্ত শাসত্মি প্রদান করা হতো। নব্বই দশকের প্রথমার্ধেই সার ব্যবসাকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার আওতাধীন নীতি তৎকালীন সরকার গ্রহণ ও বাসত্মবায়ন করে। এ প্রক্রিয়ার প্রধান ও অন্যতম অঙ্গ হিসাবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থাকে সার বিপণনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। যুক্তি ছিল বিএডিসি এ দায়িত্ব পালন করতে থাকলে বেসরকারি বিপণন ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত ও সুসংহত করা সম্ভব হবেনা। প্রশ্ন উঠলো তাহলে বিসিআইসি'র তথা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে ইউরিয়া ও টিএসপি সার বিপণন করবে। উত্থাপিত এ প্রশ্নের কারণ ছিল ইতিপূর্বে গৃহীত ব্যবস্থাপনায় বিএডিসিরই একচেটিয়া অধিকার ছিল সার বিপণন করা। এর মাধমে বিসিআইসির কারখানার সম্সত উৎপাদিত ইউরিয়া ও টিএসপি সার বিএডিসির নিয়ন্ত্রণাধীন তৎকালীন থানা বিক্রয় কেন্দ্র থেকে বিপণন করা হতো।সার বিপণন ব্যবস্থার উপর্যুক্ত কাঠামোর একমাত্র যুক্তি ছিল এর মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই সরকার কতৃক নির্ধারিত মূল্যে সহজে ও ন্যায্যমূল্যে সার ক্রয় করে ব্যবহারে সৰম হবে। এ ব্যবস্থার অন্য একটি প্রধান অঙ্গ ছিল গ্রামে গঞ্জের খুচরা সার বিক্রয়কারি জীবিকা অর্জনের একটি সুযোগ। অন্যদিকে, যে সমসত্ম ৰেত্রে অনেক কৃষক থানা সার বিক্রয় কেন্দ্র থেকে সার ক্রয়ে অনিচ্ছুক ছিল, তারা সহজেই খুচরা বিক্রেতাদেও দোকান থেকে সার ক্রয় করতে সৰম ছিল। পূর্বের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এ প্রক্রিয়ায় সারাদেশে প্রায় লৰাধিক খুচরা সার বিক্রেতার উদ্ভব হয়।
এ বিপণন ব্যবস্থা যে একেবারেই ত্রম্নটিমুক্ত ছিল তা নয়। অপচয়সহ বিক্রয় প্রক্রিয়ায় কিছু অনিয়মও ছিল। তবে মান সম্পন্ন সার সম্পর্কে কোন অভিযোগ ছিলনা। টিএসপির অধিকাংশ চাহিদা বিএডিসিই আমদানীর মাধ্যমে মেটাতে সৰম ছিল। আমদানী ব্যয়ের সিংহভাগ বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদানসহ ঋণের ব্যবস্থাও চিল। পটাশ সার দেশে উৎপাদিত হতোনা। ফলে এ জাতীয় সারের সম্পূর্ণ চাহিদা বিএডিসি আমদানী ও বিপণনে লিপ্ত ছিল।
নব্বই দশকে বেসকারিকরণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উৎস হতে ঐ খাতের আমদানী কারকরা সার আমদানী (টিএসপি ও পটাশ) শুরম্ন করে। তখনই কিছু নিম্নমান ও ভেজার সারের অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৫ সালে সরকার প্রথম বারের মতো কৃষকদের স্বার্থে ভেজাল সার নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়ে সার নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৯৫ জারী করে। পরবর্তী পর্যায়ে এ আইনী আদেশকে অধিকতর সুসংহত ও কার্যকরী করার লৰ্যে ১৯৯৯ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতায় সার নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৯৯ জারী করে। এছাড়া নিম্নমানের সার নিয়ন্ত্রণের লৰ্যে এসএসপি সার প্রথমে রং মিশ্রিত আমদানী এবং পরবর্তী পর্যাযে এ জাতীয় সারের আমদানী এবং আরও পরে বিসিআইসির টিএসপি সার কারখানায় এসএমপি সার উৎপাদন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধানত্ম গ্রহণ ও বাসত্মবায়ন করে। প্রকৃত পৰে এসএসপি সম্পূর্ণ নতুন জাতীয় সার। তবে আমদানী কৃত ও রংমিশ্রিত এ জাতীয় সার টিএসপি সার হিসাবে অধিক মূল্যে কিছু ব্যবসায়ী বিপণনে লিপ্ত হয় যদিও এর রাসায়নিক উপাদান টিএসপির এক তৃতীয়াংশ মাত্র।
ইতিমধ্যে কিছু ব্যবসায়ী এ জাতীয় সার উৎপাদনের লৰ্যে এ দেশে কারখানা স্থাপনের অনুমতিও সরকারের নিকট থেকে গ্রহণে সৰম হয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময়ে এ জাতীয় সার বিপণন নিষিদ্ধ করার ফলে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্কে সংৰুব্ধ কিছু উদ্যোক্তা প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি সিদ্ধানত্মের বিরম্নদ্ধে আদালতের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আদেশও গ্রহণে সৰম হয়। জানা যায় কিছু মামলা এখনও আদালতে অনিষ্পন্ন রয়েছে। এ থেকে যে বিষয়টি প্রমানিত হয় তা হলো নতুন প্রযুক্তির সাথে আইন সবসময় সমতালে চলতে পারেনা।
২০০৬ সালে তৃতীয় বারের মতো সরকার একটি নতুন সার সংক্রানত্ম আদেশ জারী করে যার শিরোনাম হলো সার ব্যবস্থাপনা আদেশ (২০০৬)। মূলতঃ পূর্ববর্তী অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে জারীকৃত আদেশের মৌলিক ধারা গুলোই এ নতুন আইনে স্থান লাভ করে। ইতিমধ্যে মিশ্র সার উৎপাদন ও ব্যবহারের ধারা প্রবর্তিত হয় সংৰেপে যার রাসায়নিক নাম এনপিকেএস (ঘচকঝ)। এন এর অর্থ ইউরিয়া, পি এর অর্থ ফসফরাস বা ফসফেট, কে হলো পটাশ এবং এস হলো সালফার। একটি সমীৰায় দেখা যায় যে এ ধরণের সার উৎপাদনের কারখানার সংখ্যা শতাধিক হলেও প্রকৃতপৰে প্রায় ২৪টি কারখানা এ জাতীয় সার কমবেশী উৎপাদান করে থাকে। কারও কারও মতে এ সংখ্যা আরও কম।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের সার ব্যবহার নির্দেশিকা ধানসহ কয়েকটি ফসলের জন্য কি মাত্রায় এ জাতীয় সারে বিভিন্ন সার মিশ্রণ করা হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। একই সাথে রয়েছে কয়েকটি সরকারি ও আধাসরকারি সংস্থার সারের নমুনা বিশেস্নষনের দায়িত্ব। ১৯৯৮ সালে বিএডিসির পুনর্গঠনের প্রসত্মাব কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমোদন করার পর, বিএডিসিকেও ছয়টি সার পরীৰাগারের মাধ্যমে সারর নুমুনা বিশেস্নষনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ পরবর্তী সময়ে সরার এ সিদ্ধানত্মের পরিবর্তন করে যন্ত্রপাতিসহ এ সমসত্ম পরীৰাগার মৃত্তিকা গবেষণা ইনিষ্টিটিউটকে দিয়ে বিএডিসির দায়িত্ব বিলুপ্ত করে। বতর্মানে দেশে কয়টি সংস্থার কয়টি পরীৰাগার এ দায়িত্ব পালন করছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা দুস্কর। কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থাকে এ দায়িত্ব খন্ড খন্ডভাবে প্রদান করা হয়। ধারণা করা যায় যে মোট দশটি সংস্থা এ কাজে জড়িত। এ প্রসংগে সার ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ হলো অনেক ৰেত্রে দেখা যায় যে, একাধিক সংস্থা একই নমুনা বিশেস্নষনের ফলাফল পরষ্পর বিরোধী। এর একটি বাসত্মব অভিজ্ঞতার বিষয় উলেস্নখ করা যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল নব্বই দশকে। তখন একটি বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিংক নামীয় অনুসার আমদানী করা হয়েছিল। সরকারের পৰে আমদানীকারক ছিল বিএডিসি। একটি স্বীকৃত পরীৰাগারের মাধ্যমে অনুসার দেশে পৌছার পর নমুনা বিশেস্নষনের ভিত্তিতে বিএডিসি আপত্তি জানায় ও রপ্তানীকারকদের সমসত্ম অনুসার ফেরৎ নিয়ে যাওযার অনুরোধ জানায়। কারণ এ অনুসার জমির উর্বরতার জন্য বিশেষ করে সার্বিক পরিবেশের জন্য ৰতিকারক হিসাবে চিহ্নিত হয়।
এ সময় এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীণ পিস নামধারী একটি পরিবেশ সুরৰা সংক্রানত্ম সংস্থাও ঐ দেশের গণমাধ্যমের সহায়তায় এ সার ব্যবহারের অযোগ্য মর্মে ব্যপক সংবাদ পরিবেশন করে। সরকার তথা বিএডিসির জন্য একমাত্র পথ ছিল ঐ দেশের আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা। আদালতের রায় ছিল এ সার ফেরৎ আনতে হবে এবং বিএডিসিকে ৰতিপূরণও দিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপরা আইনের প্রচলনের পর ২০০৬ অর্থ বছর থেকে মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনিষ্টিটিউট প্রতি বছর যে বার্ষিক প্রতিবেদন নিম্নমান সারের বিষয়ে প্রকাশ করে তার পরিসংখ্যান থেকে প্রমানিত হয় যে, এ ধরণের সার বিপণনের ব্যবহার আশংকাজনক। ২০০৬-২০০৭ বছওে মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনিষ্টিটিউট সর্বমোট ৩৯৪৬টি নমুনার ফলাফল বিশেস্নষণ করে। এর ভিত্তিতে দেখা যায় যে, শতকরা ৫২ভাগ হলো ভেজাল বা নিম্নমানের সার এবং বাকী ৪৮ ভাগ সঠিক মানের। পরবর্তী বছওে ৩৪৭১ নমুনার বিশেস্নষনের ফলাফল ছিল কিছুটা ভাল। শতকরা ৫৮ ভাগ নমুনা ছিল মান সম্মত এবং ৪২ ভাগ ছিল নিম্নমানের। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক সমীৰায় দেখা যায় যে, নিম্নমানের সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাবে এবং এটা অসম সার ব্যবহারের জন্যও হতে পারে।
পরিতাপের বিষয় হলো এ বিষয়ে প্রতি বছর সরকারের কাছে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে ঐ সংস্থাটি তার বার্ষিক প্রতিবেদনে সুপারিশ প্রেরণ করা সত্ত্বেও আজ পর্যনত্ম এ বিষয়ে কাঠামোগত দুর্বলতা নিরসনে তেমন কোন সুফল দৃশমান নয়। অন্যদিকে সরকারসহ সরকারের বাইরে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত, তা হলো সরকারি মালিকানাধীন কারখানায় উৎপাদিত টিএসপি সার নিম্নমানের এবং বিদেশ থেকে বেসরকারি আমাদানীকারকদের আমদানীকৃত টিএসপি সারও নিম্নমানের।
শেষোক্ত ৰেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ১৯৯৯ সাল থেকেই আমদানীকৃত টিএসপি সার নির্ধারিত বন্দরে পৌছার পর নমুনা পরীৰার ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও আজ পর্যনত্ম কোন পরীৰার ফলাফলে কোন নিম্নমানের সার সম্পর্কে প্রমান পাওয়া যায়নি। অথচ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের বার্ষিক প্রতিবেদন হচ্ছে বিপরীত ধর্মী। অন্যদিকে যে সমসত্ম সার/অনুসার ফলাফল বিশেস্নষণের পর সার ব্যবস্থাপনা আইনের বিধান অনুযায়ী শাসত্মিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা, তার কোন তথ্যই পাওয়া যায়না। এ আইনে পরিদর্শক হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠ কর্মীদের। সুচারম্নরূপে এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য এ কর্মীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবকেই চিহ্নিত করে থাকেন। অর্থাৎ পেশী শক্তির প্রভাব। অন্যান্য কাঠামোগত দুর্বলতা যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে তা কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। অর্থাৎ ভেজাল বা নিম্নমানের সার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ফলপ্রসু হয়নি। ফলশ্রম্নতিতে মাটির উর্বরতাশক্তি হ্রাস পাওয়ার আশংকাজনক দৃশ্য ও বাসত্মবতা নিয়েই চলতে হচ্ছে। কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছেনা।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকরী কাঠামো প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। এ অপূর্ণতা দূর করার জন্য বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন (বিএফএ) এবং সরকারকেই যৌথভাবে সক্রিয় হতে হবে। যে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের নীতি সরকার বারবার উচ্চারণ করছে, এ নীতির আওতায় নতুন কাঠামোর আশ্রয় গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৩১ জানুয়ারি'২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments