সরকারের ৪ বছর: প্রথম আলো জনমত জরিপ ২০১২- সরকারের জনপ্রিয়তা কমলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ে কীভাবে? by সাজ্জাদ শরিফ
১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এক সম্মিলনীতে গিয়ে দেখা হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে। একটি টেবিলে তাঁর পাশাপাশি আমরা আরও কয়েকজন বসেছিলাম। নানা বিষয় ছুঁয়ে হালকা চালেই এগিয়ে যাচ্ছিল ছিন্ন কথাবার্তা। হুট করেই সেখানে চলে এল প্রথম আলোর জনমত জরিপের প্রসঙ্গটি।
গত ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকারের মেয়াদ চার বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটি সামনে রেখে জরিপটি করা হয়েছিল। দীপু মনি কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের জরিপে দেখলাম, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বাড়লে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যায় কী করে?’ প্রশ্নটির জবাব দেওয়ার আগেই অন্যদের কথার তোড়ে আলোচনা প্রসঙ্গচ্যুত হয়ে পড়ল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নটির রেশ সেখানেই মিলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এ প্রশ্ন শুধু একা তাঁর মনেই জাগেনি। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে—দীপু মনির বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে—একই প্রশ্ন করেছেন অন্য এক পাঠক, ‘সরকারের জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় কমে থাকলে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।’ আরও কয়েকজন পাঠক সেখানে এ প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করেছেন।
সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার এই বিষম অবস্থা আদৌ যথার্থ হতে পারে কি না, সে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। জরিপে অংশ নেওয়া প্রত্যেক উত্তরদাতার মন্তব্যের দায় তাঁদের নিজের। আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে, জরিপের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত থেকে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মানুষের মন্তব্য আসলেই এভাবে উল্টে যেতে পারে কি না।
খুঁজে দেখা যাক সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার বিপরীতমুখী রেখার কারণ কী। ৬ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম ও দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল ‘সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে’ ও ‘শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, কমেছে খালেদা জিয়ার’। প্রথমত, পর পর মুদ্রিত এই দুই শিরোনামের পৃথক দুই বক্তব্য একসঙ্গে মিলিয়ে পড়তে গিয়েই সম্ভবত অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমে গেলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে কী করে?
দ্বিতীয়ত, অনেকে লক্ষ করেননি যে বর্তমান সরকার জনপ্রিয় কি না—এ ফলটি পাওয়া গেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনামূলক সমর্থনের বিচারে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ইত্যাদি রাজনৈতিক দলকে সামনে রেখে উত্তরদাতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এখন নির্বাচন হলে তাঁরা কোনটিকে ভোট দেবেন। সে হিসাবে ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থন পেয়েছে যথাক্রমে ৫৬, ৪৬, ৩৮ ও ৩৫ শতাংশ। এ রেখা ক্রমেই নিম্নমুখী। বিএনপির ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ২৫, ৩৯, ৪৩ ও ৪৪ শতাংশ। প্রথম দুই বছর এ রেখা ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রায় সমান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তার বিচার তাঁদের পাশাপাশি রেখে করা হয়নি। জাতীয় নেতৃত্বের নিরিখে তাঁরা কেমন, সেই ভিত্তিতে আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের জনপ্রিয়তা যাচাই হয়েছে। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা—সর্বশেষ জরিপে শেখ হাসিনার ৬৫ এবং খালেদা জিয়ার ৬৪ শতাংশ—সম্ভবত এই ছবিটিই তুলে ধরে যে এই দুজন ছাড়া বাংলাদেশে জাতীয় নেতৃত্বের নতুন কোনো বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি।
তৃতীয়ত, এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে প্রথম আলোর দ্বিতীয় শিরোনামে অতি সরলতা দোষ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ছিল যথাক্রমে ৭৬, ৭৫, ৬৪ ও ৬৫ শতাংশ। ২০১০ সালে তিনি ২০০৯ সালের বিপুল আস্থাটি ধরে রেখেছিলেন। ২০১১ সালে সে আস্থা অনেকটা নেমে এলেও এবার তাতে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার ২০০৯ সালের ৬৮ শতাংশ জনপ্রিয়তা ২০১০ সালে উঠে গিয়েছিল ৭৬ শতাংশে। এরপর ২০১১ (৭৩ শতাংশ) ও ২০১২ সালে (৬৪ শতাংশ) তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমাগত নেমেছে। যদিও সবটা মিলিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এখনো জাতীয় নেত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন প্রায় একই পরিমাণ মানুষ, যথাক্রমে ৬৫ ও ৬৪ শতাংশ।
মানুষের এই মিশ্র অভিব্যক্তির কারণ কী, সেটি বোঝা যায় জরিপের অন্য সূচকগুলোতে মানুষের মতামত খুঁটিয়ে দেখলে। মহাজোট সরকার কোনো কোনো সূচকে গত চার বছরে ক্রমাগত খারাপ করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা। মানুষ মনে করেছে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগ বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। দেশ ভুল পথে চলেছে, এ ধারণা ক্রমেই বেড়েছে। মানুষের মনে এমন ধারণাও ধীরে ধীরে বেড়েছে যে দুর্নীতিরও আরও বিস্তার ঘটেছে। তারা মনে করেছে, আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠন বছরে বছরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পদ্মা সেতু ও মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে সরকার মানুষের সমর্থন পায়নি। তবে তাদের মতে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার গত এক বছরে সরকার কিছুটা ভালোও করেছে।
জনমত জরিপ দেখে মনে হচ্ছে, বিরোধী দলের কাছ থেকে মানুষ আর অতীত দিনের ভূমিকা কামনা করে না। সংসদে তাদের অনুপস্থিতিকে মানুষ কখনো সমর্থন দেয়নি। তাদের অনুপস্থিতির প্রতি সমর্থন ২০০৯ সালের ৮৮ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে একবারই ৫ শতাংশ কমেছিল। তার পরের তিন বছরে তা মোটের ওপর স্থির। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোতে বিরোধী দলের ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকা মানুষ প্রত্যাশা করে। সর্বশেষ জরিপে জাতীয় ইস্যুগুলোতে তাদের ভূমিকায় ভালোর দিকে সমর্থন বেড়েছে, কিন্তু খারাপের দিকে কমেনি। তার চেয়ে বড় কথা, সব মিলিয়ে ভালোর (২৮ শতাংশ) চেয়ে খারাপের (৩৮ শতাংশ) দিকে তাদের পাল্লা এখনো বেশি ঝুঁকে আছে।
সবকিছু মিলিয়ে সামনের দিনগুলো সম্পর্কে মানুষ সংশয়াপন্ন হয়ে আছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ (৭৬ শতাংশ) মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন মোটেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। কিন্তু এ নিয়ে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনাও মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। হরতাল ও সহিংসতাভরা পুরোনো রাজনৈতিক দুর্যোগ ফিরে আসার দুশ্চিন্তায় তারা শঙ্কিত।
এ জরিপের ফল প্রকাশের পরদিন খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও ফোন করেছিলেন এবং বেশ আন্তরিকভাবে এ জরিপের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বুঝে নিতে চাইছিলেন। তিনি এও জানতে চেয়েছিলেন, কেন মাত্র অল্প কয়েকজন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে এ জনমত যাচাইয়ের জন্য নেওয়া হয়েছে। তাঁকে আমাদের ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, আরও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়কে আমাদের এ জরিপে রাখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বহু মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন স্তরের অধিকাংশ মানুষের ধারণা যথেষ্ট স্পষ্ট নয় বলে তাদের মতামত একেবারে ভুল চিত্র তুলে ধরতে পারত। সে শঙ্কায় আমরা পিছিয়ে আসি।
এবার আসা যাক জনমত জরিপ নিয়ে প্রতিবছরই যে কথা নিয়মিত ওঠে, সে প্রসঙ্গে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির সময় থেকে প্রথম আলো প্রতিবছর, প্রায় অভিন্ন প্রশ্নমালা দিয়ে, নিয়মিত এ জরিপ পরিচালনা করে এসেছে। আর প্রতিবারই কেউ না কেউ জরিপের উত্তরদাতার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর ফলাফল সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রথম আলোর জনমত জরিপে উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল তিন হাজার করে। জরিপ আরও সুষ্ঠু করার জন্য ২০১১ ও ২০১২ সালে এ সংখ্যা বাড়িয়ে পাঁচ হাজার করা হয়। অনেকের সংশয় তবু কাটেনি। ১৫ কোটির ওপরে জনসংখ্যার এই দেশে এত অল্প মানুষের ওপর চালানো জরিপে আস্থা রাখা যাবে কীভাবে? প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘প্রথম আলো জনমত জরিপ চালিয়েছে ৫,০০০ জন মানুষের ওপর, যেখানে বাংলাদেশের পূর্ণবয়স্ক মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটিরও বেশি।...এই জরিপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য?’ অন্য বহু পাঠকেরও এই প্রশ্ন। আরেক পাঠক এক পা এগিয়ে এর সমাধানও বাতলে দিয়েছেন, ‘জরিপকারীরা নিশ্চয়ই পুরো দেশে তাদের জরিপ পরিচালনা করতে পারেননি। আপনি যদি বাস্তব অবস্থা জানতে চান, তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে ভোটের আয়োজন করতে হবে।’ প্রশ্ন গুরুতর। সমাধানও কম গুরুতর নয়।
জরিপ নিয়ে সংশয় কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ায়ই আছে। বিখ্যাত সেই প্রবচন তো সবাই জানেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার: মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।’ এমন প্রবচন গড়ে ওঠার পেছনে কারণও আছে—জরিপের মূল উপাত্তের ওপর হস্তক্ষেপ, নিজের পাতে ঝোল টানার জন্য তথ্য ও বিশ্লেষণে স্বেচ্ছাবিকৃতি ইত্যাদি। এসব তো তবু সজ্ঞান পাপ। খোদ জরিপই ভুল ফলাফল দিতে পারে যদি তার গবেষণা পদ্ধতি যথাযথ না হয়, উত্তরদাতা বাছাইয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার যথার্থ পথ অনুসরণ করা না হয় এবং প্রশ্নপত্র ও তার বিকল্প উত্তরগুলো যদি না হয় স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট। জরিপকে যথাযথ হতে হয় এসবের নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। আর সেটি করার মধ্য দিয়েই জনমত জরিপ বিশ্বব্যাপী চর্চিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত মত পাওয়া সম্ভব কেবল গণভোটেই, কিন্তু সব বিষয়ে ঘন ঘন গণভোট করা ব্যয়সাপেক্ষ ও অর্থহীন। কিন্তু গণভোটের আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে জরিপে। পিউ রিসার্চ ফোরাম ও গ্যালাপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক হয়ে উঠেছে কেবল জনমত জরিপ করেই।
প্রথম আলো এ জরিপের উদ্যোগ নিচ্ছে বটে, কিন্তু সেটি স্বাধীনভাবে পরিচালনা করছে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট লিমিটেড। জরিপে সারা দেশের মানুষের মতামতের সাধারণ ছবিটি পাওয়ার জন্য দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে বয়স, নরনারী এবং গ্রাম ও শহরবাসী অনুযায়ী তারা উত্তরদাতা বাছাই করেছে। উন্নত দেশগুলোয় জরিপের জন্য উত্তরদাতার পরিমাণ থাকে আরও কম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে জনসংখ্যা ৩০ কোটির বেশি হলেও ১,১০০ জন উত্তরদাতাকে তাঁরা যথেষ্ট বলে মনে করেন। (বিস্তারিত: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-06/news/318981 ও http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-06/news/318982)।
এটি বেশ ভালো একটি লক্ষণ যে বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সমাজ-রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে গবেষণা জরিপের একটি চর্চা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকের উত্তেজনাপর্ব পেরিয়ে এসে সরকার ও রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরা এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্তও হয়ে উঠছেন। পৃথিবীর নানা দেশে সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির নানা দিক, সমকালের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধারণা-পরিকল্পনা-উদ্যোগ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে জনমত জরিপ করা হয়। কর্তৃপক্ষ তাতে পরিমার্জন ও সংশোধনের সুযোগ পায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে নাগরিকের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে, জনমত গড়ে তোলার অবকাশ বাড়ে। ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে এ ধরনের জরিপের গুরুত্ব বাংলাদেশেও বাড়বে। তাই আমরা যারা জরিপ করি, জরিপ পরিচালনার প্রতিটি পর্যায় আরও সুষ্ঠু, বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিসংখ্যানসম্মত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের ওপর বেশি করে বর্তাবে। নইলে জরিপের সুফল তো আমরা পাবই না, উল্টো ভুল জরিপে বিভ্রান্ত মানুষ জরিপের ওপরই আস্থা হারাতে শুরু করবে।
সাজ্জাদ শরিফ: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নটির রেশ সেখানেই মিলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এ প্রশ্ন শুধু একা তাঁর মনেই জাগেনি। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে—দীপু মনির বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে—একই প্রশ্ন করেছেন অন্য এক পাঠক, ‘সরকারের জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় কমে থাকলে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।’ আরও কয়েকজন পাঠক সেখানে এ প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করেছেন।
সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার এই বিষম অবস্থা আদৌ যথার্থ হতে পারে কি না, সে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। জরিপে অংশ নেওয়া প্রত্যেক উত্তরদাতার মন্তব্যের দায় তাঁদের নিজের। আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে, জরিপের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত থেকে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মানুষের মন্তব্য আসলেই এভাবে উল্টে যেতে পারে কি না।
খুঁজে দেখা যাক সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার বিপরীতমুখী রেখার কারণ কী। ৬ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম ও দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল ‘সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে’ ও ‘শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, কমেছে খালেদা জিয়ার’। প্রথমত, পর পর মুদ্রিত এই দুই শিরোনামের পৃথক দুই বক্তব্য একসঙ্গে মিলিয়ে পড়তে গিয়েই সম্ভবত অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমে গেলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে কী করে?
দ্বিতীয়ত, অনেকে লক্ষ করেননি যে বর্তমান সরকার জনপ্রিয় কি না—এ ফলটি পাওয়া গেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনামূলক সমর্থনের বিচারে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ইত্যাদি রাজনৈতিক দলকে সামনে রেখে উত্তরদাতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এখন নির্বাচন হলে তাঁরা কোনটিকে ভোট দেবেন। সে হিসাবে ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থন পেয়েছে যথাক্রমে ৫৬, ৪৬, ৩৮ ও ৩৫ শতাংশ। এ রেখা ক্রমেই নিম্নমুখী। বিএনপির ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ২৫, ৩৯, ৪৩ ও ৪৪ শতাংশ। প্রথম দুই বছর এ রেখা ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রায় সমান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তার বিচার তাঁদের পাশাপাশি রেখে করা হয়নি। জাতীয় নেতৃত্বের নিরিখে তাঁরা কেমন, সেই ভিত্তিতে আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের জনপ্রিয়তা যাচাই হয়েছে। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা—সর্বশেষ জরিপে শেখ হাসিনার ৬৫ এবং খালেদা জিয়ার ৬৪ শতাংশ—সম্ভবত এই ছবিটিই তুলে ধরে যে এই দুজন ছাড়া বাংলাদেশে জাতীয় নেতৃত্বের নতুন কোনো বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি।
তৃতীয়ত, এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে প্রথম আলোর দ্বিতীয় শিরোনামে অতি সরলতা দোষ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ছিল যথাক্রমে ৭৬, ৭৫, ৬৪ ও ৬৫ শতাংশ। ২০১০ সালে তিনি ২০০৯ সালের বিপুল আস্থাটি ধরে রেখেছিলেন। ২০১১ সালে সে আস্থা অনেকটা নেমে এলেও এবার তাতে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার ২০০৯ সালের ৬৮ শতাংশ জনপ্রিয়তা ২০১০ সালে উঠে গিয়েছিল ৭৬ শতাংশে। এরপর ২০১১ (৭৩ শতাংশ) ও ২০১২ সালে (৬৪ শতাংশ) তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমাগত নেমেছে। যদিও সবটা মিলিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এখনো জাতীয় নেত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন প্রায় একই পরিমাণ মানুষ, যথাক্রমে ৬৫ ও ৬৪ শতাংশ।
মানুষের এই মিশ্র অভিব্যক্তির কারণ কী, সেটি বোঝা যায় জরিপের অন্য সূচকগুলোতে মানুষের মতামত খুঁটিয়ে দেখলে। মহাজোট সরকার কোনো কোনো সূচকে গত চার বছরে ক্রমাগত খারাপ করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা। মানুষ মনে করেছে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগ বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। দেশ ভুল পথে চলেছে, এ ধারণা ক্রমেই বেড়েছে। মানুষের মনে এমন ধারণাও ধীরে ধীরে বেড়েছে যে দুর্নীতিরও আরও বিস্তার ঘটেছে। তারা মনে করেছে, আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠন বছরে বছরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পদ্মা সেতু ও মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে সরকার মানুষের সমর্থন পায়নি। তবে তাদের মতে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার গত এক বছরে সরকার কিছুটা ভালোও করেছে।
জনমত জরিপ দেখে মনে হচ্ছে, বিরোধী দলের কাছ থেকে মানুষ আর অতীত দিনের ভূমিকা কামনা করে না। সংসদে তাদের অনুপস্থিতিকে মানুষ কখনো সমর্থন দেয়নি। তাদের অনুপস্থিতির প্রতি সমর্থন ২০০৯ সালের ৮৮ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে একবারই ৫ শতাংশ কমেছিল। তার পরের তিন বছরে তা মোটের ওপর স্থির। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোতে বিরোধী দলের ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকা মানুষ প্রত্যাশা করে। সর্বশেষ জরিপে জাতীয় ইস্যুগুলোতে তাদের ভূমিকায় ভালোর দিকে সমর্থন বেড়েছে, কিন্তু খারাপের দিকে কমেনি। তার চেয়ে বড় কথা, সব মিলিয়ে ভালোর (২৮ শতাংশ) চেয়ে খারাপের (৩৮ শতাংশ) দিকে তাদের পাল্লা এখনো বেশি ঝুঁকে আছে।
সবকিছু মিলিয়ে সামনের দিনগুলো সম্পর্কে মানুষ সংশয়াপন্ন হয়ে আছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ (৭৬ শতাংশ) মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন মোটেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। কিন্তু এ নিয়ে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনাও মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। হরতাল ও সহিংসতাভরা পুরোনো রাজনৈতিক দুর্যোগ ফিরে আসার দুশ্চিন্তায় তারা শঙ্কিত।
এ জরিপের ফল প্রকাশের পরদিন খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও ফোন করেছিলেন এবং বেশ আন্তরিকভাবে এ জরিপের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বুঝে নিতে চাইছিলেন। তিনি এও জানতে চেয়েছিলেন, কেন মাত্র অল্প কয়েকজন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে এ জনমত যাচাইয়ের জন্য নেওয়া হয়েছে। তাঁকে আমাদের ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, আরও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়কে আমাদের এ জরিপে রাখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বহু মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন স্তরের অধিকাংশ মানুষের ধারণা যথেষ্ট স্পষ্ট নয় বলে তাদের মতামত একেবারে ভুল চিত্র তুলে ধরতে পারত। সে শঙ্কায় আমরা পিছিয়ে আসি।
এবার আসা যাক জনমত জরিপ নিয়ে প্রতিবছরই যে কথা নিয়মিত ওঠে, সে প্রসঙ্গে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির সময় থেকে প্রথম আলো প্রতিবছর, প্রায় অভিন্ন প্রশ্নমালা দিয়ে, নিয়মিত এ জরিপ পরিচালনা করে এসেছে। আর প্রতিবারই কেউ না কেউ জরিপের উত্তরদাতার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর ফলাফল সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রথম আলোর জনমত জরিপে উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল তিন হাজার করে। জরিপ আরও সুষ্ঠু করার জন্য ২০১১ ও ২০১২ সালে এ সংখ্যা বাড়িয়ে পাঁচ হাজার করা হয়। অনেকের সংশয় তবু কাটেনি। ১৫ কোটির ওপরে জনসংখ্যার এই দেশে এত অল্প মানুষের ওপর চালানো জরিপে আস্থা রাখা যাবে কীভাবে? প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘প্রথম আলো জনমত জরিপ চালিয়েছে ৫,০০০ জন মানুষের ওপর, যেখানে বাংলাদেশের পূর্ণবয়স্ক মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটিরও বেশি।...এই জরিপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য?’ অন্য বহু পাঠকেরও এই প্রশ্ন। আরেক পাঠক এক পা এগিয়ে এর সমাধানও বাতলে দিয়েছেন, ‘জরিপকারীরা নিশ্চয়ই পুরো দেশে তাদের জরিপ পরিচালনা করতে পারেননি। আপনি যদি বাস্তব অবস্থা জানতে চান, তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে ভোটের আয়োজন করতে হবে।’ প্রশ্ন গুরুতর। সমাধানও কম গুরুতর নয়।
জরিপ নিয়ে সংশয় কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ায়ই আছে। বিখ্যাত সেই প্রবচন তো সবাই জানেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার: মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।’ এমন প্রবচন গড়ে ওঠার পেছনে কারণও আছে—জরিপের মূল উপাত্তের ওপর হস্তক্ষেপ, নিজের পাতে ঝোল টানার জন্য তথ্য ও বিশ্লেষণে স্বেচ্ছাবিকৃতি ইত্যাদি। এসব তো তবু সজ্ঞান পাপ। খোদ জরিপই ভুল ফলাফল দিতে পারে যদি তার গবেষণা পদ্ধতি যথাযথ না হয়, উত্তরদাতা বাছাইয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার যথার্থ পথ অনুসরণ করা না হয় এবং প্রশ্নপত্র ও তার বিকল্প উত্তরগুলো যদি না হয় স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট। জরিপকে যথাযথ হতে হয় এসবের নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। আর সেটি করার মধ্য দিয়েই জনমত জরিপ বিশ্বব্যাপী চর্চিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত মত পাওয়া সম্ভব কেবল গণভোটেই, কিন্তু সব বিষয়ে ঘন ঘন গণভোট করা ব্যয়সাপেক্ষ ও অর্থহীন। কিন্তু গণভোটের আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে জরিপে। পিউ রিসার্চ ফোরাম ও গ্যালাপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক হয়ে উঠেছে কেবল জনমত জরিপ করেই।
প্রথম আলো এ জরিপের উদ্যোগ নিচ্ছে বটে, কিন্তু সেটি স্বাধীনভাবে পরিচালনা করছে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট লিমিটেড। জরিপে সারা দেশের মানুষের মতামতের সাধারণ ছবিটি পাওয়ার জন্য দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে বয়স, নরনারী এবং গ্রাম ও শহরবাসী অনুযায়ী তারা উত্তরদাতা বাছাই করেছে। উন্নত দেশগুলোয় জরিপের জন্য উত্তরদাতার পরিমাণ থাকে আরও কম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে জনসংখ্যা ৩০ কোটির বেশি হলেও ১,১০০ জন উত্তরদাতাকে তাঁরা যথেষ্ট বলে মনে করেন। (বিস্তারিত: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-06/news/318981 ও http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-06/news/318982)।
এটি বেশ ভালো একটি লক্ষণ যে বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সমাজ-রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে গবেষণা জরিপের একটি চর্চা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকের উত্তেজনাপর্ব পেরিয়ে এসে সরকার ও রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরা এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্তও হয়ে উঠছেন। পৃথিবীর নানা দেশে সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির নানা দিক, সমকালের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধারণা-পরিকল্পনা-উদ্যোগ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে জনমত জরিপ করা হয়। কর্তৃপক্ষ তাতে পরিমার্জন ও সংশোধনের সুযোগ পায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে নাগরিকের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে, জনমত গড়ে তোলার অবকাশ বাড়ে। ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে এ ধরনের জরিপের গুরুত্ব বাংলাদেশেও বাড়বে। তাই আমরা যারা জরিপ করি, জরিপ পরিচালনার প্রতিটি পর্যায় আরও সুষ্ঠু, বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিসংখ্যানসম্মত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের ওপর বেশি করে বর্তাবে। নইলে জরিপের সুফল তো আমরা পাবই না, উল্টো ভুল জরিপে বিভ্রান্ত মানুষ জরিপের ওপরই আস্থা হারাতে শুরু করবে।
সাজ্জাদ শরিফ: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো।
No comments