সংসদে শোক প্রসত্মাব শ্রদ্ধা নিবেদন
সংসদ রিপোর্টার কিংবদনত্মি বাম রাজনীতিক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে রবিবার জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রসত্মাব পাস হয়েছে। শোক প্রসত্মাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রবীণ রাজনীতিক জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে ভারত হারিয়েছে একজন মহান রাজনীতিবিদ ও নেতাকে।
বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভাকাঙ্ৰীকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে হারিয়েছি একজন অভিভাবককে। জ্যোতি বসু উপমহাদেশ তথা দৰিণ এশিয়ার জন্য শুধু একটি নাম নন, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ভারতে গিয়ে জ্যোতি বসুর অনত্ম্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন বলে সংসদকে জানান।দিনের সম্পূরক কর্মসূচী অনুযায়ী স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে সংসদে শোক প্রসত্মাব উত্থাপন করেন এবং প্রয়াত এ মহান নেতার জীবনবৃৃত্তানত্ম সংসদে উপস্থাপন করেন। শোক প্রসত্মাবের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, এ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া, জাসদের হাসানুল হক ইনু, মঈনউদ্দিন খান বাদল, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া এবং চীফ হুইপ উপাধ্যৰ আবদুস শহীদ। আলোচনা শেষে প্রয়াত এ মহান নেতার আত্মার শানত্মি কামনা এবং শোকসনত্মপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সংসদ সদস্যরা এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। আলোচনা শেষে সংসদে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রসত্মাবটি গ্রহণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, উপমহাদেশের জন্য আজ শোকের দিন। জ্যোতি বসু এ উপমহাদেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদই নন, রাজনীতির ৰেত্রে একজন অভিভাবক ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকার সোনারগাঁওয়ে তাঁর পৈত্রিক বাড়িটিকে লাইব্রেরি নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ভারতে এত দীর্ঘ সময় কোন রাজ্যে কেউ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারেননি। সাধারণ মানুষের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। দলের প্রতিও ছিল তাঁর আনুগত্য। একজন বাঙালী হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েও তাঁর দলের সিদ্ধানত্মের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তিনি সে প্রসত্মাব ফিরিয়ে দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত এ নেতার অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত সরকারের পাশাপাশি জ্যোতি বসু মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণাথর্ীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখনই কোন সমস্যা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যখন কোন অনুরোধ করেছি, তিনি তা ফেলে দেননি। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা বিরোধিতা থাকলেও, নির্বাচনে তাঁর ভোট হারানোর আশঙ্কা থাকলেও তিনি বাংলাদেশের কথা ভেবে চুক্তির ৰেত্রে সহযোগিতা করেছেন। তাঁকে বলেছিলাম, এ চুক্তি না হলে বাংলাদেশ মরম্নভূমি হয়ে যাবে। জ্যোতি বসু তা মেনে নিয়ে এ ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদনে কঠোর অবস্থান নেন। তিনি বলেন, জ্যোতি বসুর সহযোগিতা ছাড়া গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন ছিল।
শানত্মি চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শানত্মি চুক্তির আগে দু'দশক ধরে বাংলাদেশের প্রায় ৬২ হাজার মানুষ ভারতে শরণাথর্ী হিসেবে ছিল। ওই সময়ের সরকারগুলো নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দাবি করলেও শরণাথর্ীদের ফিরিয়ে আনতে কখনও উদ্যোগ নেয়নি। ওই শরণাথর্ীদেরও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জ্যোতি বসু। শানত্মি চুক্তির মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে জ্যোতি বসু সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমি বন্দী ছিলাম, তখন অসুস্থাবস্থাতেও তিনি প্রতিনিয়ত আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। সে সময় তিনি যখন যেখানে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হয়েছে তা করেছেন। শেখ রেহানার কাছে ফোন করে আমার কথা জানতে চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকলেও তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সাদাসিধা। বিদেশে পড়াশুনা করেও তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। দরিদ্র সাধারণ মানুষের জন্য আজীবন কাজ করতেন বলেই তাঁর জীবনে কখনও জৌলুস বা বিলাসিতা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি মডেল তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর মৃতু্যতে ভারত হারিয়েছে একজন মহান রাজনীতিবিদ ও নেতাকে। বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভাকাঙ্ৰীকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে হারিয়েছি একজন অভিভাবককে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একজন এমন প্রবীণ রাজনীতিক বিশ্বে খুব কমই আছেন। এ মহামহাদেশ তথা দৰিণ এশিয়ার জন্য জ্যোতি বসু শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে মডেল তৈরি করেছেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জ্যোতি বসু ছিলেন উপমহাদেশের একজন মহান নেতা। দল ও মানুষের মঙ্গলের জন্য জ্যোতি বসু যে কোন পদৰেপ নিতে পিছুপা হতেন না। আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, জ্যোতি বসু এ উপমহাদেশের মহান নেতা। তাঁর নেতৃত্ব শুধু ভারতে নয়, এ উপমহাদেশে প্রভাব বিসত্মার করেছে। আঞ্চলিক শানত্মি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রয়াত মহান রাজনীতিক জ্যোতি বসু আপাদমসত্মক একজন বাঙালী ছিলেন। বাঙালীর প্রতিটি সঙ্কটে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসীম অবদান বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁদের মহাপ্রয়াণ দেশের ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। জ্যোতি বসুর মহাপ্রয়াণ একটি উজ্জ্বল নৰত্রের পতন। তিনি বলেন, এ শোক প্রসত্মাব ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও ভালবাসার প্রতীক।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে ভারতবর্ষ হারিয়েছে একজন অভিভাবককে আর আমরা হারিয়েছি একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে। উপমহাদেশের গণতন্ত্র, মানবতার জন্য যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা জ্যোতি বসুর কথা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়েও তিনি সেই মর্যাদা-সম্মান পেয়েছেন।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রয়াত জ্যোতি বসুকে 'কিংবদনত্মিতুল্য রাজনীতিক' উলেস্নখ করে বলেন, তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুই ছিলেন না, উপমহাদেশের একজন ছায়া ও রাজনীতির অভিভাবক ছিলেন। তাঁর মৃতু্যতে দেশ শুধু একজন অকৃত্রিম বন্ধুকেই হারাল না, বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ একজন মহান বিপস্নবীকে হারালেন।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, জ্যোতি বসু ভারতে আজীবন সমাজতান্ত্রিক ঝা-াকে উঁচু করে ধরে রেখেছিলেন। কমরেড জ্যোতি বসু বাংলাদেশের আজীবনের বন্ধুই ছিলেন না, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও শানত্মি চুক্তির সময় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব রম্নহুল আমিন হাওলাদার জ্যোতি বসুকে উপমহাদেশের একজন রাজনীতির প্রতিষ্ঠান হিসেবে উলেস্নখ করে বলেন, জ্যোতি বসু দৰিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তিনি চলে গেলেও বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যে সেতুবন্ধন রচনা করে গেছেন তা জাতি চিরকাল স্মরণ করবে।
জাসদের মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, শতাব্দীর একজন প্রাচীন মহীরম্নহের মহাপ্রয়াণ ঘটল। তিনি আপাদমসত্মক বাঙালী ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালীর প্রতীক ছিলেন। শতাব্দীর প্রাচীন মহীরম্নহ সভ্যতা ও অসত্মিত্বের ধারক এবং লোকালয়ের ঠিকানা জ্যোতি বসুকে জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
No comments