উইপোকা ধ্বংস করার এখনই সময় by আবদুল মান্নান
হলমার্কের এমডি হাওয়া ভবনের সৃষ্টি। ঋণ প্রদানকারী সোনালী ব্যাংকের এমডি জিয়া পরিষদের নেতা।’ কথা ক’টি জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী গত ১৯ সেপ্টেম্বর বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের শাস্তি পেতে হবে।
আমার এই লেখা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য নয় বরং গত চার বছরে এমন হাওয়া ভবনের সুবিধাভোগীরা বর্তমান সরকারের আমলেও কতভাবে রং পরিবর্তন করে ঠিকই জোট সরকারের আমলের মতোই কিছু আওয়ামী লীগ নামধারীর সহায়তায় কিভাবে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন সে সম্পর্কে যথাসামান্য আলোচনা করা। এই যে হলমার্কের তানভীর আহম্মদকে নিয়ে এত তোলপাড় সে কী রাতারাতি হাওয়া ভবনের সৃষ্টি হিসাবে আবিষ্কার হলো? নাকি তাকে যারা ভুয়া দলিলপত্রের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ঋণ পেতে সহায়তা করেছেন তাঁরা আগে থেকে তা জানতেন এবং জেনে নিজের সুবিধার জন্য তা গোপন করেছেন? সোনালী ব্যাংকের এমডি, যাঁকে প্রধানমন্ত্রী জিয়া পরিষদের নেতা হিসাবে এতদিন পর চিহ্নিত করলেন সেটিইবা কেমন করে হলো? একজন ব্যক্তি জিয়া পরিষদের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অর্থ এই নয় যে, তাঁকে তাঁর পদ হতে সরিয়ে দিতে হবে। তিনি যদি তাঁর পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বশীল হন তাঁকে ওই পদে রাখতে কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে তিনি যদি তাঁর পদের অমর্যাদা করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন দেশ ও সরকারের ক্ষতি করেন তাহলে তো তিনি ওই পদে থাকতে পারেন না। এই ধরনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে যদি চার বছর লেগে যায় তাহলে বুঝতে হবে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। এখন তো এটি পরিষ্কার সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বেশ কিছু উইপোকা ঢুকেছে। তারা ভিতর থেকে সব কিছুকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সময়মতো সেই সব উইপোকাকে ধ্বংস না করলে বিপদ অনিবার্য। সময়ও তো আর বেশি নেই।
হলমার্ক জালিয়াতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার নাম জড়িত হয়ে পড়েছে । তিনি কিভাবে তা থেকে বের হবেন? তিনি যে সকল অজুহাত বা বক্তব্য খাড়া করেছেন তা দেশের কোন মানুষ বিশ্বাস করে না তা নিশ্চয় তিনি জানেন। তারপরও তার মতো অনেকেই সাধারণ জনগণকে বোকা ভাবেন। এর ফলে গত চার বছরে বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক বড় অর্জনকে ধূলিসাত করতে এই ধরনের ব্যক্তিরাই সহায়তা করেছেন। যে বিরোধী দলের হাতে সরকারের বিরুদ্ধে বলার তেমন কিছুই ছিল না তাদের হাতে একটার পর একটা ইস্যু তুলে দিয়েছেন এই সব অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরাই। আগেও বলেছি, অনেকে বলেছেন, আবারও বলি আওয়ামী লীগের ভিতরে এবং বাইরে অনেক সৎ, যোগ্য এবং নিষ্ঠাবান লোক আছেন যাঁদের কদাচিৎ কাজে লাগানো হয়। এতে ক্ষতি হয় দলের অন্য কারও নয়। দলের নীতি নির্ধারকরা এই সত্যটি যে উপলব্ধি করেন না তা বা বলি কী করে কিন্তু অবাক কা- হচ্ছে উপলব্ধি করেও অনেক সময় সঠিক মানুষটিকে সব সময় কাজে লাগাতে পারেন না। আবার যাদের সঠিক মানুষ মনে করা হয় তাদের অনেকেই সব সময়ে সঠিক কাজ করেন না। তদ্বিরের উদাহরণ দিতে হয়। তদ্বির আমাদের দেশ তো বটেই উন্নত বিশ্বেও তার বহুবিধ প্রচলন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তো এটি একটি স্বীকৃত পেশা। ওয়াশিংটন ডিসিতে এই তদ্বিরকারীদের বলা হয় ‘লবিস্ট।’ যেমন বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে তা বন্ধ বা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য জামায়াত কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশ একাধিক তদ্বিরবাজ ফার্মকে নিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে এটি এখনও পেশা হিসাবে গণ্য হয়নি ঠিক তবে তদ্বির আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সচিবালয় কেন্দ্রিক একটি বেশ বড় তদ্বিরবাজ সিন্ডিকেট সব সময় সক্রিয় থাকে। তবে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াতের তদ্বিরের মাঝে একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ আগপিছ না ভেবে কোন খোঁজ খবর না নিয়ে তদ্বির করে আর বিএনপি-জামায়াত কখনও কারও জন্য তদ্বির করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হচ্ছে যার জন্য তদ্বির করা হচ্ছে সে লোকটি একশত ভাগ তাদের আপন মানুষ। উদাহরণ দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষক নিয়োগ হবে। প্রার্থী দশজন। আওয়ামী লীগের পাঁচজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের পাঁচজন প্রার্থীর জন্য উপাচার্য অথবা নির্বাচনী বোর্ডের সদস্যদের কাছে তদ্বির করলেন। কেউ বললেন প্রার্থী আমার এলাকার, তার বাবা বাল্যকালের বন্ধু অন্য আরেকজনের, বড়মাপের নেতা জানালেন ছেলেটি সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হয় ইত্যাদি। কেউ কিন্তু এই সত্যটি জানেন না অথবা জানলেও বলেন না যে প্রার্থীর বাবা স্থানীয় জামায়াতের আমির অথবা বিএনপি’র মাঝারি পর্যায়ের নেতা। পরিবারে যুদ্ধাপরাধীও আছে। তার যোগ্যতাবলে চাকরি হলে তাতে কারও আপত্তি থাকবে না কিন্তু এই তদ্বিরকারীদের তদ্বিরের কারণে তার চাকরি হলে তার পুরো ব্যাপারটার জন্য দায়ী হন উপাচার্য অথবা নির্বাচন কমিটি। আর কোন কারণে একজনের যদি চাকরি না হয় সে যার তদ্বিরের পাত্র তিনি উপাচার্যকে একহাত দেখে নেয়ার হুমকি দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হবেন না। দু’টি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। আওয়ামী লীগের পূর্বের আমলের ঘটনা। জেলা পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা একবার এক প্রার্থীকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। সেই নেতা প্রতি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান কিন্তু কখনও বিজয়ী হতে পারেন না। তদ্বিরের জন্য যে প্রার্থীকে নিয়ে এসেছিলেন তাকে দেখে আমি অনেকটা স্তম্ভিত। সে রগকাটা শিল্পের একজন স্বীকৃত এবং নিখুঁত বিশেষজ্ঞ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভাড়া খাটে বলে সকলে জানে। ফলাফলও নিচের দিকে। তাকে নাকি চাকরি দিতে হবে। প্রার্থীকে কোন মতে দু’কথা বলে বিদায় করে সেই নেতার কাছে প্রশ্ন করি আপনি কী ছেলেটাকে চেনেন? সহজ সরল উত্তর, আমার এলাকার ছেলে। ওর বাবা খুব ভাল মানুষ। অন্য একজন মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়। তার জন্য সকলের জোর তদ্বির। তার যোগ্যতার ঘাটতি ছিল না। চাকরি হলো। কিছুদিন না যেতেই যারা দায়িত্বপালনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হঠিয়ে উপাচার্য হওয়ার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তারা তাকে ব্যবহার করে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা দায়ের করিয়ে দিল। সেই বান্দা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-বিএনপি ঘরানার একজন বড় বরকান্দাজ। এমন ঘটনা এখনো সমানতালে চলছে, পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। এখন তো কোন কোন ক্ষেত্রে দলে এবং সরকারে অযোগ্য লোকের সমাগম কয়েকগুণ বেড়েছে। অনেককে বলতে শুনেছি সরকার যাদের বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়েছে তাদের তো অনেকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টই ছিল না। একটি ব্যাংক কিভাবে পরিচালিত হয় সে সম্পর্কে তাদের কোন সম্যক ধারণাই নেই। সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারী ব্যাংকে বর্তমানে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তাতে পরিচালনা পর্ষদ কী তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে? দলীয় সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় লোক নিয়োগ দেবেন তা প্রত্যাশিত কিন্তু যা কখনও প্রত্যাশিত নয় তা হচ্ছে অযোগ্য অপদার্থদের নিয়োগ দেয়া। ব্যাংকিং খাতে তো নয়ই। ব্যাংকিং খাত কোন কারণে দুর্বল হলে তাতে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজে আর সেক্টরটি দেশে এবং দেশের বাইরে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। নেপালে আর মধ্যপ্রাচের কোন কোন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে রসালো আলোচনা অনেক দিনের। এদের একজনের একটি বক্তৃতা আবার ইউটিউবের বদৌলতে বহুদিন দেশের মানুষ দেখেছে। নেপালে বা মধ্যপ্রাচ্যে যোগ্য কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত করার মতো পাওয়া যাচ্ছে না তা বললে মানুষ শুনবে কেন? তবে মানুষ এখনও উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছে সেই রাষ্ট্রদূতের এখনও স্বপদে বহাল থাকার রহস্য।
বর্তমানে সরকার অনেকটা নিজের সৃষ্ট কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই সব সমস্যা সামাল দিতে হলে দ্রুত দলের ভিতরের এবং বাইরে যে সকল যোগ্য লোক আছেন তাঁদের আর কোন সময়ক্ষেপণ না করে কাজে লাগাতে হবে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নত হবে বলে বিশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু অর্থায়নের বিষয়টি বর্তমান সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সঙ্কটের সমাধান হওয়াতে সরকারবিরোধীদের হতাশ করলেও সরকারের জন্য অন্যান্য সঙ্কটগুলো সমাধান করে সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। শুধু মন্ত্রিসভায় রদবদল আনলেই পরিস্থিতি উন্নত হবে তা কিন্তু নয়। দক্ষ এবং যোগ্য মানুষদের দ্রুততম সময়ে কাজে লাগাতে হবে। ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। সে সম্মেলনের মাধ্যমে দলের যে কমিটিগুলো গঠন করা হবে সেই কমিটিগুলোই সামনের নির্বাচন মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের কোন সংসদ নির্বাচনই আওয়ামী লীগের জন্য সহজ ছিল না। অনেকটা আওয়ামী লীগ বনাম অন্য সব দল। যে দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকে তাদের তেমন কোন সাংগঠনিক শক্তি থাকে না। নির্বাচন আওয়ামী লীগকে একাই লড়তে হয়। দলকে আরো গতিশীল, দক্ষ আর কার্যকর করতে না পারলে আগামী দিনে যে চ্যালেঞ্জ আসছে তা মোকাবিলা করা সহজ হবে না। তা যদি করতে হয় তাহলে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তেমন দক্ষ আর অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। সঠিকভাবে দল গোছানোর কোন বিকল্প আওয়ামী লীগের সামনে নেই। দলের ভিতরের উইপোকাগুলোকে ধ্বংস করার এখনই সময়। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন আওয়ামী লীগকে নিয়ে কেন এত মাতামাতি করি। তাদের বলি আওয়ামী লীগের অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয় দেখতে চায় তাদের সামনে আওয়ামী লীগই একমাত্র ভরসা। বাম দলগুলো তার বিকল্প হতে পারত কিন্তু তাদের দুর্বল আর বাস্তবতা বর্জিত নেতৃত্বের কারণে তা হয়নি। এত নিশ্চিতভাবে দেশের রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। অনেকে তৃতীয় শক্তির কথা বলেন। এটি অনেকটা স্বপ্নে বিরিয়ানি খাওয়ার মতো অবস্থা আর কী।
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১২
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক
হলমার্ক জালিয়াতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার নাম জড়িত হয়ে পড়েছে । তিনি কিভাবে তা থেকে বের হবেন? তিনি যে সকল অজুহাত বা বক্তব্য খাড়া করেছেন তা দেশের কোন মানুষ বিশ্বাস করে না তা নিশ্চয় তিনি জানেন। তারপরও তার মতো অনেকেই সাধারণ জনগণকে বোকা ভাবেন। এর ফলে গত চার বছরে বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক বড় অর্জনকে ধূলিসাত করতে এই ধরনের ব্যক্তিরাই সহায়তা করেছেন। যে বিরোধী দলের হাতে সরকারের বিরুদ্ধে বলার তেমন কিছুই ছিল না তাদের হাতে একটার পর একটা ইস্যু তুলে দিয়েছেন এই সব অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরাই। আগেও বলেছি, অনেকে বলেছেন, আবারও বলি আওয়ামী লীগের ভিতরে এবং বাইরে অনেক সৎ, যোগ্য এবং নিষ্ঠাবান লোক আছেন যাঁদের কদাচিৎ কাজে লাগানো হয়। এতে ক্ষতি হয় দলের অন্য কারও নয়। দলের নীতি নির্ধারকরা এই সত্যটি যে উপলব্ধি করেন না তা বা বলি কী করে কিন্তু অবাক কা- হচ্ছে উপলব্ধি করেও অনেক সময় সঠিক মানুষটিকে সব সময় কাজে লাগাতে পারেন না। আবার যাদের সঠিক মানুষ মনে করা হয় তাদের অনেকেই সব সময়ে সঠিক কাজ করেন না। তদ্বিরের উদাহরণ দিতে হয়। তদ্বির আমাদের দেশ তো বটেই উন্নত বিশ্বেও তার বহুবিধ প্রচলন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তো এটি একটি স্বীকৃত পেশা। ওয়াশিংটন ডিসিতে এই তদ্বিরকারীদের বলা হয় ‘লবিস্ট।’ যেমন বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে তা বন্ধ বা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য জামায়াত কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশ একাধিক তদ্বিরবাজ ফার্মকে নিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে এটি এখনও পেশা হিসাবে গণ্য হয়নি ঠিক তবে তদ্বির আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সচিবালয় কেন্দ্রিক একটি বেশ বড় তদ্বিরবাজ সিন্ডিকেট সব সময় সক্রিয় থাকে। তবে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াতের তদ্বিরের মাঝে একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ আগপিছ না ভেবে কোন খোঁজ খবর না নিয়ে তদ্বির করে আর বিএনপি-জামায়াত কখনও কারও জন্য তদ্বির করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হচ্ছে যার জন্য তদ্বির করা হচ্ছে সে লোকটি একশত ভাগ তাদের আপন মানুষ। উদাহরণ দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষক নিয়োগ হবে। প্রার্থী দশজন। আওয়ামী লীগের পাঁচজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের পাঁচজন প্রার্থীর জন্য উপাচার্য অথবা নির্বাচনী বোর্ডের সদস্যদের কাছে তদ্বির করলেন। কেউ বললেন প্রার্থী আমার এলাকার, তার বাবা বাল্যকালের বন্ধু অন্য আরেকজনের, বড়মাপের নেতা জানালেন ছেলেটি সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হয় ইত্যাদি। কেউ কিন্তু এই সত্যটি জানেন না অথবা জানলেও বলেন না যে প্রার্থীর বাবা স্থানীয় জামায়াতের আমির অথবা বিএনপি’র মাঝারি পর্যায়ের নেতা। পরিবারে যুদ্ধাপরাধীও আছে। তার যোগ্যতাবলে চাকরি হলে তাতে কারও আপত্তি থাকবে না কিন্তু এই তদ্বিরকারীদের তদ্বিরের কারণে তার চাকরি হলে তার পুরো ব্যাপারটার জন্য দায়ী হন উপাচার্য অথবা নির্বাচন কমিটি। আর কোন কারণে একজনের যদি চাকরি না হয় সে যার তদ্বিরের পাত্র তিনি উপাচার্যকে একহাত দেখে নেয়ার হুমকি দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হবেন না। দু’টি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। আওয়ামী লীগের পূর্বের আমলের ঘটনা। জেলা পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা একবার এক প্রার্থীকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। সেই নেতা প্রতি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান কিন্তু কখনও বিজয়ী হতে পারেন না। তদ্বিরের জন্য যে প্রার্থীকে নিয়ে এসেছিলেন তাকে দেখে আমি অনেকটা স্তম্ভিত। সে রগকাটা শিল্পের একজন স্বীকৃত এবং নিখুঁত বিশেষজ্ঞ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভাড়া খাটে বলে সকলে জানে। ফলাফলও নিচের দিকে। তাকে নাকি চাকরি দিতে হবে। প্রার্থীকে কোন মতে দু’কথা বলে বিদায় করে সেই নেতার কাছে প্রশ্ন করি আপনি কী ছেলেটাকে চেনেন? সহজ সরল উত্তর, আমার এলাকার ছেলে। ওর বাবা খুব ভাল মানুষ। অন্য একজন মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়। তার জন্য সকলের জোর তদ্বির। তার যোগ্যতার ঘাটতি ছিল না। চাকরি হলো। কিছুদিন না যেতেই যারা দায়িত্বপালনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হঠিয়ে উপাচার্য হওয়ার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তারা তাকে ব্যবহার করে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা দায়ের করিয়ে দিল। সেই বান্দা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-বিএনপি ঘরানার একজন বড় বরকান্দাজ। এমন ঘটনা এখনো সমানতালে চলছে, পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। এখন তো কোন কোন ক্ষেত্রে দলে এবং সরকারে অযোগ্য লোকের সমাগম কয়েকগুণ বেড়েছে। অনেককে বলতে শুনেছি সরকার যাদের বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়েছে তাদের তো অনেকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টই ছিল না। একটি ব্যাংক কিভাবে পরিচালিত হয় সে সম্পর্কে তাদের কোন সম্যক ধারণাই নেই। সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারী ব্যাংকে বর্তমানে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তাতে পরিচালনা পর্ষদ কী তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে? দলীয় সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় লোক নিয়োগ দেবেন তা প্রত্যাশিত কিন্তু যা কখনও প্রত্যাশিত নয় তা হচ্ছে অযোগ্য অপদার্থদের নিয়োগ দেয়া। ব্যাংকিং খাতে তো নয়ই। ব্যাংকিং খাত কোন কারণে দুর্বল হলে তাতে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজে আর সেক্টরটি দেশে এবং দেশের বাইরে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। নেপালে আর মধ্যপ্রাচের কোন কোন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে রসালো আলোচনা অনেক দিনের। এদের একজনের একটি বক্তৃতা আবার ইউটিউবের বদৌলতে বহুদিন দেশের মানুষ দেখেছে। নেপালে বা মধ্যপ্রাচ্যে যোগ্য কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত করার মতো পাওয়া যাচ্ছে না তা বললে মানুষ শুনবে কেন? তবে মানুষ এখনও উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছে সেই রাষ্ট্রদূতের এখনও স্বপদে বহাল থাকার রহস্য।
বর্তমানে সরকার অনেকটা নিজের সৃষ্ট কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই সব সমস্যা সামাল দিতে হলে দ্রুত দলের ভিতরের এবং বাইরে যে সকল যোগ্য লোক আছেন তাঁদের আর কোন সময়ক্ষেপণ না করে কাজে লাগাতে হবে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নত হবে বলে বিশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু অর্থায়নের বিষয়টি বর্তমান সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সঙ্কটের সমাধান হওয়াতে সরকারবিরোধীদের হতাশ করলেও সরকারের জন্য অন্যান্য সঙ্কটগুলো সমাধান করে সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। শুধু মন্ত্রিসভায় রদবদল আনলেই পরিস্থিতি উন্নত হবে তা কিন্তু নয়। দক্ষ এবং যোগ্য মানুষদের দ্রুততম সময়ে কাজে লাগাতে হবে। ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। সে সম্মেলনের মাধ্যমে দলের যে কমিটিগুলো গঠন করা হবে সেই কমিটিগুলোই সামনের নির্বাচন মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের কোন সংসদ নির্বাচনই আওয়ামী লীগের জন্য সহজ ছিল না। অনেকটা আওয়ামী লীগ বনাম অন্য সব দল। যে দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকে তাদের তেমন কোন সাংগঠনিক শক্তি থাকে না। নির্বাচন আওয়ামী লীগকে একাই লড়তে হয়। দলকে আরো গতিশীল, দক্ষ আর কার্যকর করতে না পারলে আগামী দিনে যে চ্যালেঞ্জ আসছে তা মোকাবিলা করা সহজ হবে না। তা যদি করতে হয় তাহলে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তেমন দক্ষ আর অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। সঠিকভাবে দল গোছানোর কোন বিকল্প আওয়ামী লীগের সামনে নেই। দলের ভিতরের উইপোকাগুলোকে ধ্বংস করার এখনই সময়। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন আওয়ামী লীগকে নিয়ে কেন এত মাতামাতি করি। তাদের বলি আওয়ামী লীগের অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয় দেখতে চায় তাদের সামনে আওয়ামী লীগই একমাত্র ভরসা। বাম দলগুলো তার বিকল্প হতে পারত কিন্তু তাদের দুর্বল আর বাস্তবতা বর্জিত নেতৃত্বের কারণে তা হয়নি। এত নিশ্চিতভাবে দেশের রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। অনেকে তৃতীয় শক্তির কথা বলেন। এটি অনেকটা স্বপ্নে বিরিয়ানি খাওয়ার মতো অবস্থা আর কী।
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১২
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক
No comments