পার্বত্য চট্টগ্রাম-শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প নেই

গত শনিবার ২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি সরকারি কলেজে পাহাড়ি ও বাঙালি দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে হাতাহাতির জের ধরে যেভাবে শহরজুড়ে হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছিল, তা অনভিপ্রেত। বিষয়টিকে নিছক 'তুচ্ছ' ঘটনার 'ব্যাপক' প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখার অবকাশ নেই।


ওই জনপদে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থাহীনতা কতটা গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে, শনিবারের অবাঞ্ছিত হানাহানি তার প্রমাণ। এটা আপাত স্বস্তিকর যে, প্রশাসনের বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বের উদ্যোগের কারণে বিপর্যয় অপেক্ষাকৃত সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, সোমবার ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং পরদিন শান্তি মিছিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাঙামাটিসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। প্রশাসন ছাড়াও এখন উভয় জনগোষ্ঠীর নেতাদের মনোযোগ দিতে হবে শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার দিকে। এটা নিশ্চিত যে ওই জনপদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শান্তির পক্ষে। সংবাদমাধ্যমের কাছে উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষই স্বীকার করেছে যে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক ও পর্যটন সম্ভাবনার সুফল ভোগ করতে চান। গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের কোটারি স্বার্থে হানাহানি উসকে দেয়। গত শনিবারের ঘটনায়ও সেই স্বার্থান্ধতার বিষয়টি আরেকবার স্পষ্ট হয়েছে। আমরা চাই, রক্তপাতের নেপথ্য নায়কদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। আইন-শৃঙ্খলা সুরক্ষার প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেওয়া চলবে না। এ ক্ষেত্রে সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দল নির্বিশেষ সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, দুষ্কৃতকারী ও দাঙ্গাবাজরা কারও বন্ধু হতে পারে না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা যেভাবে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও সম্পদ হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, স্বসম্প্রদায়ের লোকজনকেও সেভাবে বিপদে ফেলতে দ্বিধা করবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার বাস্তবতাও এখন অস্বীকার করা কঠিন। অতীতে যাই হোক না কেন, তা ভুলে গিয়ে সেখানকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প নেই। স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু বাঙালিদেরই বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। গত কয়েক দশক ধরেই সেখানে যে ভূসামাজিক পরিবর্তন চলছে, ওই জনপদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য সেটা স্বস্তিকর না হওয়াই স্বাভাবিক। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষে বন্ধুত্বের বাতাবরণ তৈরি সেই অসন্তোষ প্রশমনে ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে শান্তি ভঙ্গের কারণ অনুসন্ধানেও সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেব আমরা। অস্বীকার করা যাবে না যে, পারস্পরিক অবিশ্বাসের মূলে রয়েছে অমীমাংসিত কিছু সমস্যা। দেড় দশক আগে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র অংশ শান্তিচুক্তির ওপর আস্থা রেখে অস্ত্র পরিত্যাগ করেছিল যে ধরনের সমাধানের প্রত্যাশায় তা এখনও পূর্ণ হয়নি। তারা বারংবারই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে আসছে। আমরাও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সে ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারেরও বিকল্প নেই। পাহাড়ি জনপদে সমতলের নানা উপাদান যুক্ত হওয়ায় যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, আমরা জানি তা রাতারাতি নিরসন সম্ভব নয়। কিন্তু সে ব্যাপারে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পাহাড়িদের রয়েছে। ভূমি কমিশনের বিরুদ্ধেও উভয় পক্ষ থেকে রয়েছে নানা অভিযোগ। এই সন্দেহ নিরসন করতে হবে সরকারকেই। অন্যথায় গত ২২ সেপ্টেম্বরের হানাহানির মতো উদ্বেগ ও বিপর্যয় আমাদের পিছু ছাড়বে না।
 

No comments

Powered by Blogger.