জীবন কথন- চোখবাঁধা বিদেশীর ‘ঢাকাবিষ্কার’ by রণজিৎ বিশ্বাস

মনে করুন একজন বিদেশী ঢাকায় এসে নামলেন। প্রথমবারের মত। চোখ বেঁধে তাকে ঢাকায় নামিয়ে দেয়া হলো। তাকে কিছু বলা হলো না, কোন শহরে তাকে নামানো হয়েছে।: বিশ্বাস করি না।


এই জমানায় এমনও হয় নাকি?!
: আমি আপনাকে মনে করতে বলেছি এবং আপনি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছেন, এবং দিয়েছেন বলেই আমি দীর্ঘদিন ধরে ডিজাইন করা একটি প্রশ্ন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। এখন আধাআধি অবস্থায় আপনি আমাকে গাছে তুলে মইও কাড়তে পারবেন না, সংক্ষিপ্ততম বস্ত্রে জলে নামিয়ে বস্ত্রহরণও করতে পারবেন না। কোন প্রকার ‘না’ বা ‘নো’ না করে জবাব দিয়ে যান। তাতে আপনারও ভালো, আমারও ভালো। নইলে কী হয়ে যায় আমি বলতে পারি না।
: কিন্তু আপনি তো আমাকে বলেন নি যে উদ্ভট একটা পরিস্থিতির দিকে আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন। এ ধরনের অবস্থার জন্য আমি প্রস্তুত নই।
: তা না হতে পারেন। আমার পরিকল্পনার পুরোটা
যে বলিনি, তারও কারণ আছে।
: কী কারণ?!
: এক, খুলে বললে আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি হতেন না।
দুই, আমি ঠিক করেছি, বিষয়টি আমি সবার পরে জানাব এবং সেটি জানিয়ে আমি ইন্টারভিউ শেষ করবো। প্রত্যেকের তো কাজের একটা ডিজাইন থাকে, না কি?!
: ঠিক আছে, থাকে। আপনি এখন প্রশ্ন পুরো করুন, গৌড়চন্দ্রিকা কম।
: প্রশ্নের বাকিটা খুব সিম্পল। লোকটি কী করে বুঝবে, যে শহরে তাকে নামানো হেয়েছে, তার নাম ঢাকা।
: চোখ বাঁধা অবস্থাতেই তাকে বলতে হবে?!
: না, অত কঠিন পরীক্ষায় তাকে ফেলা হবে না।
তাকে ফুটপাথে ও ওভারব্রিজে হাঁটতে দেয়া হবে, রিক্সায় অটোরিক্সায় চড়তে বলা হবে এবং নগরীর সবচেয়ে বড় পার্ক রমনা র্পাক-এ ভ্রমণ করতে দেয়া হবে, মাছের বাজারে নামানো হবে এবং টাউন-এরিয়ার বাসের যাত্রী করা হবে। এই প্রশ্ন করার পরে কাউকে এত ক্লু আমি দিই না। ইন ফ্যাক্ট, আমাকে দিতে হয়নি।
: দেননি, না দিতে হয় নি?
: দিতে হয় নি। কারণ, এর আগে প্রশ্নটি আমি কারও কাছে পুরো করার সুযোগ পাই নি। কেউ আমাকে পাগল ডেকেছে, কেউ শিশু ডেকেছে, কেউ ডেকেছে উন্মাদ। তারপর দাবড়েদুবড়ে আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে। আপিন কি জবাব দেবেন আমার প্রশ্নের?
: জবাবতো আমার কাছে এখন খুব সহজ মনে হচ্ছে, দিলেই শেষ হয়ে যাবে। আপনি অধৈর্য্য হবেন না। অধৈর্য্য হওয়া মহা পাপ। ধীরে ধীরে শুনুন, মনের সঙ্গে যায় কিনা দেখুন। লোকটি ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে দেখবে, হাঁটা যাবে না। মূলত: তিনিটি কারণে। তিনি কোথাও দেখবেন স্তূপীকৃত নির্মাণ সামগ্রী, ইট-বালি-রড-খোয়া ও গলানো সিমেন্ট। কোথাও তিনি দেখবেন ‘ওপেন-এয়ার টয়লেট’। রাস্তার যানজট থেকে বাঁচার জন্য কোথাও তিনি দেখবেন মোটরসাইকেল এর দৌড়াদৌড়ি, বিশেষ করে রমনা পার্কের ভেতরে ও ধারে কাছে বিশেষ করে কাকরাইলের তাবলীগ মসজিদের কোণা থেকে ‘রূপসী বাংলা’ হোটেল পর্যন্ত। মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধের নামে, তাদের হাঁটা পথে বিরক্তিকর প্রতিবন্ধক সেজে ও ফুটপাথের ইট ভেঙ্গে ভেঙ্গে মোটরবাইক চলছে তো চলছেই। চলছে তাদের নাকের ডগা ডলে ডলে যাদের কাজ এসব রোখা বলে জগত বলে।
ওভারব্রিজের কাছে গিয়ে তিনি নজর করবেন, মানুষ ব্রিজের পরিবর্তে তার ছায়া ব্যবহার করছে, ব্রিজের তলা দিয়ে ঝুঁকির সঙ্গে খেলতে খেলতে তারা রাস্তা পার হচ্ছে। কখনও যদি সাহস করে ব্রিজের ওপর তিনি উঠেও যান, দেখবেন সেখানে জনমানব শুয়ে আছে, কোথাও কোথাও পণ্যবিক্রির পশরা চলছে, রাতের বেলা সে পণ্য মানবদেহও হতে পারে। কোথাও কোথাও তাকে পেতে হবে দেহনির্গত জলের শুকনো কিংবা তাজা তরতাজা অথবা আধাগুকনো ধারার অ্যামোনিয়া-সুবাস, কোথাও তাকে দেখতে হবে লাদালাদা ল্যাদাল্যাদা ও দলাদলা বিশেষ বস্তুর হলদেটে কিংবা কালচে অথবা সবজেসবজে স্তূপ।
হিলাহিলি ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কির জন্য বাসে উঠতে না পেরে সিএনজি অটোরিক্স বা রিক্সার কাছে গিয়ে তিনি যখন বলবেন ‘যাবেন ভাই’ ওরা গাড় ঘোরাবে। যাবে না। অথবা, এমন ভাড়া চাইবে, তার চোখের মনি হয়ে যাবে হংসডিম্বের সেদ্ধ কুসুমের মত।
রমনা পার্কের ভেতরে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি দেখবেন, জোড়াজোড়া মানবমানবী চারপাশটা অগ্রাহ্য করে বাহুতে বাহুতে বাঁধা পড়ে আছে। তিনি আরও নজর করবেন, মাঝখানে যে ছোপছোপা সবুজ চত্বর আছে, সেখানে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলে কিছু তরুণ পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী পার্কটির স্নিগ্ধ সবুজের দ্বাদশ ঘটিকা বাজিয়ে দিচ্ছে। কেউ তাদের বারণ করার সাহসও পাচ্ছে না অথবা গরজ কেউ বিপদেও। মাছের বাজারে গিয়ে তিনি দেখবেন, তার সেন্সিটিভ নাক হালকা হালকা গন্ধ পাচ্ছে যে বস্তুর, বা ফরমালিন- ফরমালিন মনে হয়। এই সবগুলো পরিস্থিতিতে যদি বিদেশী নাগরিক ‘পজেটিভ’ উত্তর খুঁজে পান, তিনি বুঝে নিতে পারবেন চোখবাঁধা অবস্থায় কোথায় তাকে নামানো হয়েছে। শহরটি মোগল আমলের জাহাঙ্গীর নগর।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.