তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলন এবং আপিল বিভাগের রায় by কাজী সিরাজ

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ নিয়ে সর্বত্র তুমুল আলোচনা চলছে। যেহেতু বিষয়টি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট, তাই এ রায়ের পর দেশে কী হবে তা নিয়েই চলছে নানা বিশ্লেষণ। রায় ঘোষণার দিন সব কিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।


তিনি বলেছিলেন, আপিল বিভাগের এই রায় ঘোষণার পর এখন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে ১৬ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকারিতা ছিল। কিন্তু আসলে কি তা-ই? নিশ্চয়ই না। ২০১০ সালের ১০ মে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছিলেন, যাতে বলা ছিল একটি শর্তে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটি আমলে না নিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। জাতীয় সংসদে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর (পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে) এর কার্যকারিতা তখনই নিঃশেষ হয়ে যায়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি নেই। তাতেই উৎফুল্ল অ্যাটর্নি জেনারেল আবেগ সামলাতে না পেরে কথাটি বলে ফেলেছেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর জানা গেল, অ্যাটর্নি জেনারেল সঠিক কথা বলেননি। পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে জটিল বিষয়টির ওপর এমন মন্তব্য করা তাঁর উচিত হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায়ের আদেশাংশে না থাকলেও রায় অনুযায়ী আরো দুটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে কোনো বাধাই নেই। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ৪৫ দফায় আদেশ শিরোনামে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে 'ইহা ছাড়াও উপরে ৪৪ দফায় বর্ণিত নিদের্শাবলী প্রদান করা হইল।' ৪৪ দফার ১৩ দফায় বলা হয়েছে, 'ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ও অবৈধ' হলেও সংসদের বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে ওপরে বর্ণিত বিধানাবলিসাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালে প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। বিচারপতি খায়রুল হক যে রায় লিখেছেন, আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে চারজনই তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করে রায়ে সই করেছেন। বাকি তিনজনের দুজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ না বলে ব্যবস্থাটি বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। অপরজন বিষয়টি জাতীয় সংসদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে বলেছেন। অর্থাৎ তিনি বিচারপতি খায়রুল হকসহ অপর তিনজনের (মোট চারজন) সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ না করলেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের বিষয়টি আইনসভার ওপর অর্পণের কথা বলেছেন।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ চারজন বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্পর্কিত ১৩ দফার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। পুরো রায় পর্যালোচনা করে একজন সাধারণ মানুষেরও এটা বোঝার কথা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরো দুই টার্ম বহাল রাখার দরজা ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে উন্মুক্তই ছিল ও আছেই। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে আইনি বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়। তাঁর বক্তব্যটি ছিল বিভ্রান্তিকর। এত দিনে সে বিভ্রান্তি অবশ্য কেটে গেছে। তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার উচিত ছিল নিজে থেকে বক্তব্য সংশোধন করে বিভ্রান্তি নিরসন করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। স্মরণ করা যেতে পারে যে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত মামলার রায় দেওয়ার আগে ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মতামত নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে যে আটজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম তাঁদের অন্যতম।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণে যাঁরা সংক্ষুব্ধ, এই রায়ের ব্যাপারে বক্তব্য-মন্তব্য দেওয়ার সময় তাঁদের সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। বিষয়টি সরকারেরও উপলব্ধি করা দরকার। রাজনীতিবিদদের একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস, সন্দেহই আমাদের দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ১৯৯৪ সাল থেকে যখন এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তুমুল আন্দোলন শুরু করে, তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক চেষ্টা করা হয় বিরোধী দলকে তা থেকে বিরত করে সমঝোতার মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকে একটা উপায় বের করার। এ ব্যাপারে দেশীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মধ্যস্থতা করার জন্য ১৯৯৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু ঢাকায় আসেন এবং তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দেশে ফিরে এমেকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে আলোচনা ও সংলাপ শুরুর জন্য একটা ফ্যাক্সবার্তা পাঠান ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর। দুই নেত্রী সংলাপ শুরু করতে রাজি হয়ে এমেকাকে জানান ২৬ সেপ্টেম্বর পাঠানো ফিরতি ফ্যাক্সে। সংলাপের জন্য তিনটি বিষয় নির্ধারিত ছিল : এক. সৎবিশ্বাসের ভিত্তিতে সরকার ও বিরোধী- উভয় পক্ষের মুক্ত আলোচনার অঙ্গীকার; দুই. নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে উভয় পক্ষের ঐকমত্য এবং তিন. রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আচরণবিধি উত্থাপন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু। এই তিন দফাভিত্তিক সংলাপ শুরুর জন্য কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে ১৩ অক্টোবর ১৯৯৪ ঢাকায় আসেন স্যার নিনিয়ান স্টিফ্যান। সংলাপ শুরু হয় ২০ অক্টোবর। খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংলাপে অংশ নেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সে সংলাপ ব্যর্থ হয়। ২০ নভেম্বর স্যার নিনিয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, 'এমন কোনো এজেন্ডা ছিল না, যা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য।' তিনি দেশে ফিরে যান ২১ নভেম্বর। যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলে যান যে 'সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন একটি প্রস্তাব আমি দিয়েছি। সরকার পক্ষ (তৎকালীন) তা গ্রহণ করার ইচ্ছা দেখিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল (তৎকালীন) তা মেনে নেয়নি। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার দুটো কারণ আছে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দল ছিল অনড়। এই দাবিতে আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে এবং রাজপথে রক্ত ঝরে। একের প্রতি অপরের মিসট্রাস্ট এতই প্রকট ছিল যে সংবিধানের আওতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে কোনো অবস্থায়ই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা রাজি ছিলেন না। শুধু তা-ই নয়, যারা ভোট দিতে যাবে তাদের নিজ দায়িত্বে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ভয় দেখানো হয়েছিল এবং দুই. এ ব্যাপারে সমঝোতার একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক উদ্যোগও তখন বিফল হয়েছিল। এখন আবার একই রকম উদ্যোগের আলামত দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। কথাবার্তাও তাঁরা বলছেন প্রকাশ্যে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একটা সমাধান তাঁরা চান। কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরেও দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি খুব গুরুত্ব পেয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন তাঁরা চান বাংলাদেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের সব উন্নয়ন সহযোগীর বার্তাও একই। আগের বিরোধী দল এখন সরকারে আর সরকার এখন বিরোধী দলে। দলের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরস্পর এখন মুখোমুখি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানে এতটুকু পরিবর্তনও লক্ষ করা যাচ্ছে না। রায়ে উভয় পক্ষের জন্যই একটা 'উইন উইন' অবস্থা রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কথা যেমন আছে, আগামী দুই টার্ম, সংসদ চাইলে, এই ব্যবস্থা চালু রাখতে পারার কথাও বলা আছে। আইনজ্ঞরা ইতিমধ্যেই মত ব্যক্ত করেছেন যে আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তাই রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। কেননা আন্দোলনটা চলছে ও চলবে সরকারের বিরুদ্ধে, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে নয়। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা রায়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর করাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, রায়কে নয়। এ ব্যাপারে অবশ্য প্রবীণ আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, এমন নজির অতীতেও আছে। তাঁর বক্তব্যটি একান্তই ব্যক্তিগত বলে ধরে নেওয়া যায় বিএনপির দলীয় অবস্থান থেকে। দলটি বলেছে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা রিভিউর জন্য আবেদন করবে না। এটা তাদের একটি বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত বলেই বিবেচনা করছেন অভিজ্ঞজনরা। কারণ এই রায় তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের পথে প্রতিবন্ধক নয়। তবে নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর 'গণতান্ত্রিক' ব্যবস্থা নস্যাতের চেষ্টা করলে কঠোর আইনি ব্যবস্থায় তা 'দমন' করা হবে বলে যে 'গর্জন' করেছেন, তা উদ্বেগের। 'দমন' শব্দটি পরিশীলিত গণতান্ত্রিক শব্দ নয়, এর মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও ফ্যাসিস্ট মানসিকতার ইঙ্গিত আছে। এখন সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের রায় এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বরাত দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা নস্যাতের কার্যক্রম বলে বিবেচনা করেন, তাহলে ভয়ের কথা। বর্তমান বিরোধী দলকে দুর্বল ভাবা ঠিক হবে না। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ এবং শুরুতেই বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে ধমকের সুরে কথা বলার অর্থ বোধ হয় এই যে সরকার কঠোর ও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের প্রতি কঠোর ও আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণের পরিণাম ভালো হয় না, অতীতে কোথাও ভালো হয়নি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
kazi.shiraz@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.