মোস্তফা কামালশেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমা প্রসঙ্গে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
বর্তমানে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা হলো মোট আমানতের ১০
শতাংশ। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমিটি নাকি সুপারিশ করেছে ৪০ শতাংশ, আর আইএমএফ
মিশনপ্রধান বলেছেন যে এটি ২৫ শতাংশে সীমিত থাকা উচিত। সরকারি কমিটি কিসের ভিত্তিতে ৪০ শতাংশ বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে? কমিটির সদস্যরা কি তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন? তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন যে জাতীয় অর্থনীতিতে শেয়ারবাজার তথা পুঁজিবাজার কী ভূমিকা রাখতে পারে। আওয়ামী লীগের কপালে স্থায়ীভাবে শেয়ার কেলেঙ্কারির তিলক লেপন করা হয়েছে। লোকে মনে করে যে আওয়ামী লীগ ও শেয়ার কেলেঙ্কারি এক এবং অভিন্ন সত্তা।
এ জন্য মূলত দায়ী স্টক এক্সচেঞ্জের আওয়ামীপন্থী সদস্যরা। কেননা তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ভুল বুঝিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাতে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া শেয়ারবাজার সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও তাঁরা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ম্যান্ডারিনের মাথায়। যেমন- শেয়ারবাজার থেকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ উঠিয়ে দেওয়া হবে। শেয়ারবাজার বেকার সমস্যার সমাধান করবে ইত্যাদি। এখন তো সরকার প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থসংস্থানে দিশাহারা। কোথায় সেই শেয়ারবাজারের নেতারা, যাঁদের মুখ থেকে শেয়ারবাজারের অজস্র গুণকীর্তন শোনা গিয়েছিল? অবশ্য অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে তাঁকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। শেয়ারবাজারে দুই পক্ষ থাকে- ক্রেতা ও বিক্রেতা। ঠিক অন্য মার্কেটে যেমনটি হয়। এখানে উন্নয়নের নিমিত্তে অর্থসংস্থান হবে কিভাবে? প্রাইমারি মার্কেট থেকে এখানে শেয়ার আসতে হবে। প্রাইমারি মার্কেট মানে আইপিও বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং। বাংলায় প্রাথমিক গণ-আহ্বান বলা যেতে পারে। জনগণের কাছ থেকে শিল্পায়ন, ব্যবসা বা পরিষেবার জন্য যদি অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, সেটা তো সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। যেমন- তারা উদ্যোক্তাদের বোঝাতে পারে যে ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার না করে জনগণের কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ। এ টাকা তো আর ফেরত দিতে হবে না। এখানে আর একটি কথা বলা যেতে পারে, কম্পানি প্রত্যক্ষভাবে তালিকাভুক্ত হয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করতে পারে। এটির উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট কাটা। প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করা। এই শেয়ার উদ্যোক্তাদের। অতএব এই টাকা কোথায়-কিভাবে ব্যয় হবে, তার জন্য কাউকে জবাবদিহি হতে হয় না। আইপিওর টাকা প্রসপেকটাসে দেখাতে হয় কিভাবে ব্যয় হবে। অতএব প্রত্যক্ষ তালিকা বাঞ্ছনীয় নয়। এতে কম্পানির কোনো লাভ হয় না। ব্যক্তিবিশেষের অর্থ উপার্জন হয়। প্রাইমারি মার্কেটে আর শেয়ার প্রবাহ বাড়তে পারে সরকারের উদ্যোগে। যেমন- সরকার মালিকানাধীন কিছু কিছু শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে ছাড়তে পারে। ভারতে বাজেটের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সংশ্লিষ্ট কম্পানির শেয়ার বিক্রি করে কত টাকা সংগ্রহ করা হবে।
সরকার বিভিন্ন রকম বন্ডও ছাড়তে পারে। তাহলে আমরা নিশ্চিত এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে একমাত্র আইপিওর টাকা ও সরকারের বিক্রয়লব্ধ বন্ডের অর্থ জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারে, যাকে বিনিয়োগ বলা যেতে পারে। এখন আমরা দেখব যে মোট বিনিয়োগে এই অর্থের পরিমাণ কত? ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দুই লাখ ৩৭৮ কোটি টাকা। এর ভেতর সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। বাকি এক লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বেসরকারি। মোট বিনিয়োগে একই সময় আইপিওর অবদান এক হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর অবদান ১ শতাংশেরও কম।
কথাটা শুনতে রূঢ় মনে হবে; কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো যে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শেয়ারবাজারের ভূমিকা সামান্য। মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এ জিনিসটি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি শেষ দফায় ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হলো। এরপর যখন বিএনপি ক্ষমতায় এলো এবং সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন শেয়ারবাজার খুব চাঙ্গা হবে। এই একটা জিনিস অনেক শিক্ষিত, এমনকি অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে চান না যে এত ছোট বাজারকে কতটা ফোলানো যেতে পারে। একপর্যায়ে গিয়ে ফেটে যাবে। সাইফুর রহমানের সময় শেয়ার মার্কেটের আকার কী ছিল, তার নমুনা তুলে ধরছি। ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর ইনডেঙ্ ছিল ৯৬৭.৮৮ এবং লেনদেন হয়েছিল ৯৯ কোটি টাকা। ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর সূচক ছিল এক হাজার ৯৭১ ও লেনদেনের পরিমাণ ৩৭ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে সূচক এক হাজার ৬৭৭ এবং লেনদেন ২৯ কোটি টাকা। সাইফুর রহমান জানতেন যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটের আকার অনুযায়ী এ রকমই হবে শেয়ারের সূচক ও ব্যবসা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বিএনপিরও অনেক প্রভাবশালী নেতা আছেন, এমনকি অনেকে মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর ধারণা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল, তাই তিনি শত প্রশংসা সত্ত্বেও বিভ্রান্ত হননি; যেটি ঘটেছিল আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রীদের বেলায়। মরহুম কিবরিয়া সাহেব পরে বুঝেছিলেন এবং নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। সাইফুর রহমানের সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত সন্তোষজনক ছিল। ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৯৬ ও ৬.৫৩ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যখন শেয়ারবাজার কথিত উচ্চমার্গে ছিল, সেবার প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.১ শতাংশ। ২০১০-১২তে এই হার ৬.৭ শতাংশ। ২০১১-১২তে সরকারের প্রাক্কলিত হার ৭ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর চেয়ে কিছু কম হবে। তবে লক্ষ করা যাচ্ছে যে এর সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কারণ সেকেন্ডারি মার্কেটের কেনাবেচার অর্থের সঙ্গে জাতীয় উৎপাদনের কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ বেশ কিছু ব্যক্তি, এমনকি অর্থনীতিতে জ্ঞান রয়েছে তাঁরাও মনে করেন, শেয়ারবাজার অত্যন্ত চাঙ্গা হওয়া মানে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। সরকারের যে কমিটি ৪০ শতাংশ বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে, তারা ওপরে আলোচিত বিষয়গুলো মাথায় রেখেছিল কি না সেটাই বিবেচ্য। এমনিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কেউ কেউ অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন, আর এ রকম সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। শেয়ারবাজারে ব্যাপক টাকা আসতে শুরু করলে সব শেয়ারের দাম বাড়তে থাকবে, অমনি নিরীহ সরলপ্রাণ মানুষ শেয়ারবাজারে আসবে। অর্থাৎ তৃতীয় শেয়ার কেলেঙ্কারির আয়োজন করতে চলেছে সরকারের কমিটি। আইএমএফ মিশনপ্রধান ২৫ শতাংশ বললেন কোন হিসাবে, তা তিনি জানেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংককে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। যেন প্রাইমারি মার্কেটে জোর দেওয়া হয়, যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা হিসেবে ব্যাংক আবেদন করতে পারে। সরকারি বন্ড ক্রয় করতে পারে। সেকেন্ডারি মার্কেটে মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে মার্জিন লোন ছাড়া আর কোনোরকম আর্থিক সাহায্য দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না।
দাতারা সুযোগ পেলেই আমাদের উপদেশ-পরামর্শ দেয়। তারা বলেছিল, অনেক বেশি বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধাদি প্রদান করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে ব্যাংক অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে চলবে। সে উদ্যোগ মেনে মুখ্য নির্বাহী দেওয়া হলো, যাঁদের বেতন-ভাতা আগের এমডির চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি। বিনিময়ে আমরা পেলাম হলমার্ক কেলেঙ্কারি। আরো কত লুক্কায়িত আছে কে জানে! এ প্রশ্নটি কিন্তু কেউ তুলছে না যে কেন আমরা মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেওয়ার জন্য এত টাকা গুনলাম, এর ব্যাপারে যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের বক্তব্য কী?
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) অনেক কথা বলছে, নানা রকম ফরমান জারি করছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে শেয়ার কেলেঙ্কারির, তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কাজটি করলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ আকারে শেয়ার কেলেঙ্কারি আর হতো না। সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া। সত্যি যদি গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা দলের চেয়ে দেশকে বড় মনে করা হয়, তাহলে সরকারের অবশ্য কর্তব্য এ বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করা। তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ত। অবশ্য রাজনৈতিক কাম ব্যবসায়িক চাপ সামলানো কঠিন। মরহুম কিবরিয়া সাহেব তদন্ত করিয়ে আইনগত ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সাইফুর রহমান এসে শেয়ারবাজার সম্পর্কে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অর্থাৎ ওকে একলা চলতে দেওয়া। এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তিনি চাপের মুখে বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে খুব একটা মনোযোগ দেননি।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
এ জন্য মূলত দায়ী স্টক এক্সচেঞ্জের আওয়ামীপন্থী সদস্যরা। কেননা তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ভুল বুঝিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাতে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া শেয়ারবাজার সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও তাঁরা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ম্যান্ডারিনের মাথায়। যেমন- শেয়ারবাজার থেকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ উঠিয়ে দেওয়া হবে। শেয়ারবাজার বেকার সমস্যার সমাধান করবে ইত্যাদি। এখন তো সরকার প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থসংস্থানে দিশাহারা। কোথায় সেই শেয়ারবাজারের নেতারা, যাঁদের মুখ থেকে শেয়ারবাজারের অজস্র গুণকীর্তন শোনা গিয়েছিল? অবশ্য অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে তাঁকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। শেয়ারবাজারে দুই পক্ষ থাকে- ক্রেতা ও বিক্রেতা। ঠিক অন্য মার্কেটে যেমনটি হয়। এখানে উন্নয়নের নিমিত্তে অর্থসংস্থান হবে কিভাবে? প্রাইমারি মার্কেট থেকে এখানে শেয়ার আসতে হবে। প্রাইমারি মার্কেট মানে আইপিও বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং। বাংলায় প্রাথমিক গণ-আহ্বান বলা যেতে পারে। জনগণের কাছ থেকে শিল্পায়ন, ব্যবসা বা পরিষেবার জন্য যদি অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, সেটা তো সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। যেমন- তারা উদ্যোক্তাদের বোঝাতে পারে যে ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার না করে জনগণের কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ। এ টাকা তো আর ফেরত দিতে হবে না। এখানে আর একটি কথা বলা যেতে পারে, কম্পানি প্রত্যক্ষভাবে তালিকাভুক্ত হয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করতে পারে। এটির উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট কাটা। প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করা। এই শেয়ার উদ্যোক্তাদের। অতএব এই টাকা কোথায়-কিভাবে ব্যয় হবে, তার জন্য কাউকে জবাবদিহি হতে হয় না। আইপিওর টাকা প্রসপেকটাসে দেখাতে হয় কিভাবে ব্যয় হবে। অতএব প্রত্যক্ষ তালিকা বাঞ্ছনীয় নয়। এতে কম্পানির কোনো লাভ হয় না। ব্যক্তিবিশেষের অর্থ উপার্জন হয়। প্রাইমারি মার্কেটে আর শেয়ার প্রবাহ বাড়তে পারে সরকারের উদ্যোগে। যেমন- সরকার মালিকানাধীন কিছু কিছু শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে ছাড়তে পারে। ভারতে বাজেটের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সংশ্লিষ্ট কম্পানির শেয়ার বিক্রি করে কত টাকা সংগ্রহ করা হবে।
সরকার বিভিন্ন রকম বন্ডও ছাড়তে পারে। তাহলে আমরা নিশ্চিত এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে একমাত্র আইপিওর টাকা ও সরকারের বিক্রয়লব্ধ বন্ডের অর্থ জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারে, যাকে বিনিয়োগ বলা যেতে পারে। এখন আমরা দেখব যে মোট বিনিয়োগে এই অর্থের পরিমাণ কত? ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দুই লাখ ৩৭৮ কোটি টাকা। এর ভেতর সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। বাকি এক লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বেসরকারি। মোট বিনিয়োগে একই সময় আইপিওর অবদান এক হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর অবদান ১ শতাংশেরও কম।
কথাটা শুনতে রূঢ় মনে হবে; কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো যে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শেয়ারবাজারের ভূমিকা সামান্য। মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এ জিনিসটি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি শেষ দফায় ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হলো। এরপর যখন বিএনপি ক্ষমতায় এলো এবং সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন শেয়ারবাজার খুব চাঙ্গা হবে। এই একটা জিনিস অনেক শিক্ষিত, এমনকি অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে চান না যে এত ছোট বাজারকে কতটা ফোলানো যেতে পারে। একপর্যায়ে গিয়ে ফেটে যাবে। সাইফুর রহমানের সময় শেয়ার মার্কেটের আকার কী ছিল, তার নমুনা তুলে ধরছি। ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর ইনডেঙ্ ছিল ৯৬৭.৮৮ এবং লেনদেন হয়েছিল ৯৯ কোটি টাকা। ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর সূচক ছিল এক হাজার ৯৭১ ও লেনদেনের পরিমাণ ৩৭ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে সূচক এক হাজার ৬৭৭ এবং লেনদেন ২৯ কোটি টাকা। সাইফুর রহমান জানতেন যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটের আকার অনুযায়ী এ রকমই হবে শেয়ারের সূচক ও ব্যবসা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বিএনপিরও অনেক প্রভাবশালী নেতা আছেন, এমনকি অনেকে মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর ধারণা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল, তাই তিনি শত প্রশংসা সত্ত্বেও বিভ্রান্ত হননি; যেটি ঘটেছিল আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রীদের বেলায়। মরহুম কিবরিয়া সাহেব পরে বুঝেছিলেন এবং নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। সাইফুর রহমানের সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত সন্তোষজনক ছিল। ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৯৬ ও ৬.৫৩ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যখন শেয়ারবাজার কথিত উচ্চমার্গে ছিল, সেবার প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.১ শতাংশ। ২০১০-১২তে এই হার ৬.৭ শতাংশ। ২০১১-১২তে সরকারের প্রাক্কলিত হার ৭ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর চেয়ে কিছু কম হবে। তবে লক্ষ করা যাচ্ছে যে এর সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কারণ সেকেন্ডারি মার্কেটের কেনাবেচার অর্থের সঙ্গে জাতীয় উৎপাদনের কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ বেশ কিছু ব্যক্তি, এমনকি অর্থনীতিতে জ্ঞান রয়েছে তাঁরাও মনে করেন, শেয়ারবাজার অত্যন্ত চাঙ্গা হওয়া মানে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। সরকারের যে কমিটি ৪০ শতাংশ বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে, তারা ওপরে আলোচিত বিষয়গুলো মাথায় রেখেছিল কি না সেটাই বিবেচ্য। এমনিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কেউ কেউ অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন, আর এ রকম সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। শেয়ারবাজারে ব্যাপক টাকা আসতে শুরু করলে সব শেয়ারের দাম বাড়তে থাকবে, অমনি নিরীহ সরলপ্রাণ মানুষ শেয়ারবাজারে আসবে। অর্থাৎ তৃতীয় শেয়ার কেলেঙ্কারির আয়োজন করতে চলেছে সরকারের কমিটি। আইএমএফ মিশনপ্রধান ২৫ শতাংশ বললেন কোন হিসাবে, তা তিনি জানেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংককে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। যেন প্রাইমারি মার্কেটে জোর দেওয়া হয়, যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা হিসেবে ব্যাংক আবেদন করতে পারে। সরকারি বন্ড ক্রয় করতে পারে। সেকেন্ডারি মার্কেটে মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে মার্জিন লোন ছাড়া আর কোনোরকম আর্থিক সাহায্য দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না।
দাতারা সুযোগ পেলেই আমাদের উপদেশ-পরামর্শ দেয়। তারা বলেছিল, অনেক বেশি বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধাদি প্রদান করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে ব্যাংক অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে চলবে। সে উদ্যোগ মেনে মুখ্য নির্বাহী দেওয়া হলো, যাঁদের বেতন-ভাতা আগের এমডির চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি। বিনিময়ে আমরা পেলাম হলমার্ক কেলেঙ্কারি। আরো কত লুক্কায়িত আছে কে জানে! এ প্রশ্নটি কিন্তু কেউ তুলছে না যে কেন আমরা মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেওয়ার জন্য এত টাকা গুনলাম, এর ব্যাপারে যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের বক্তব্য কী?
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) অনেক কথা বলছে, নানা রকম ফরমান জারি করছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে শেয়ার কেলেঙ্কারির, তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কাজটি করলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ আকারে শেয়ার কেলেঙ্কারি আর হতো না। সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া। সত্যি যদি গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা দলের চেয়ে দেশকে বড় মনে করা হয়, তাহলে সরকারের অবশ্য কর্তব্য এ বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করা। তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ত। অবশ্য রাজনৈতিক কাম ব্যবসায়িক চাপ সামলানো কঠিন। মরহুম কিবরিয়া সাহেব তদন্ত করিয়ে আইনগত ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সাইফুর রহমান এসে শেয়ারবাজার সম্পর্কে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অর্থাৎ ওকে একলা চলতে দেওয়া। এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তিনি চাপের মুখে বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে খুব একটা মনোযোগ দেননি।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments