সাফের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে
প্রশ্ন : শেখ জামালের প্রথম আবির্ভাবে দল গঠনে আপনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। অথচ আপনিই এবার দল ছেড়ে চলে এলেন। মূল কারণ কী? আমিনুল : একটি দলেই যে আমি সব সময় খেলব, এমন তো কোন কথা নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে দল পরিবর্তন করলে আমার জন্য ভাল হবে।
সেই উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত আমার দল পরিবর্তন করা।
প্রশ্ন : ক্লাব সভাপতির (মনজুর কাদের) সঙ্গে আপনার বিরোধের কথা শোনা যাচ্ছিল?
আমিনুল : আসলে একটা জায়গায় খেলতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। উনার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটা উনি করেছেন, আর আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটা আমি করেছি। এটাকে বড় কোন বিষয় হিসেবে আমি মনে করি না। এমনটা হতেই পারে।
প্রশ্ন : বিজেএমসিতে আপনার লক্ষ্য কী?
আমিনুল : অবশ্যই ভাল করা। একটা লক্ষ্য এবং প্রত্যাশা নিয়েই আমি এই দলে এসেছি। গতবার বিজেএমসি যে ভাল করেছে তার চেয়ে ভাল কিছু করাই মূলত লক্ষ্য। আমাদের দলে ভাল মানের কিছু বিদেশী আনা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় তরুণরা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে আমি মনে করি শক্তিশালী দলই গঠন করা হয়েছে।
প্রশ্ন : আবাহনী-মোহামেডানের জার্সি গায়ে খেলা আর অন্য দলের জার্সি গায়ে খেলার মাঝে কি কোন পার্থক্য খুঁজে পান?
আমিনুল : স্বাধীনতা-উত্তর ফুটবলের কথা বললে অবশ্যই আমাদের দেশে আবাহনী-মোহামেডান এগিয়ে থাকবে। একমাত্র এই দুটি দলেরই বড় সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। অন্য দলের তুলনায় পার্থক্যটা এখানেই। তবে অন্য ক্লাবগুলো বর্তমানে যেভাবে শক্তিশালী দল গঠন করছে সেটা অবশ্যই ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক। এখন বাংলাদেশের ফুটবলের ছয়-সাতটি দল সমপর্যায়ে চলে এসেছে। যার কারণে ঘরোয়া ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও অনেক বেড়েছে। এটা আমাদের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক।
প্রশ্ন : গত দুই মৌসুম যাবত আবাহনী-মোহামেডানের সেই দ্বৈরথ নেই বললেই চলে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমিনুল : আমি এটাকে ভাল দিক হিসেবেই উল্লেখ করব। কারণ আবাহনী-মোহামেডানের মতো সমপর্যায়ের দল বেরিয়ে এসেছে বলেই শুধু এই দুই দলের দ্বৈরথটা কমে গেছে এবং নতুন শক্তিগুলো প্রমাণ করেছে যে তারা শিরোপার দাবিদার। আমি মনে করি আমাদের সার্বিক ফুটবলের জন্য এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।
প্রশ্ন : এখন ফুটবলের পরিবেশ কেমন মনে হচ্ছে? মানে আপনার শুরুর সময়ের সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলি?
আমিনুল : পরিবেশগত দিক বললে বলব, আমি যখন শুরু করেছিলাম তখনকার পরিবেশের প্লেয়ার, অফিসিয়ালসহ সবার মধ্যে আন্তরিকতা বা বোঝাপড়াটা অনেক ভাল ছিল। এখনও ভাল। কিন্তু বাংলাদেশে ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা বা আমাদের দেশের মানুষ ফুটবলকে যে জায়গায় দেখতে চায়, সেই জায়গাটিতে এখন পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারিনি। যার কারণে পরিবেশগত বা সামগ্রিক দিকটা আমি মনে করি আগের থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে আছে। তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমরা যদি ভাল করতে পারি বা ভাল লোকাল প্লেয়ার তৈরি করতে পারি তাহলে পরিবেশগত দিকটা আপনা-আপনি বদলে যাবে। এ জন্য বাফুফের নতুন কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে তাঁরা যেন ফুটবলে সুন্দর একটা অবস্থান তৈরি করে রেখে যান। যাতে পরবর্তীতে যাঁরা আসবেন তাঁরা সেখান থেকে ফুটবলে ধারাবাহিক উন্নয়ন দেখতে পায়।
প্রশ্ন : আপনার শুরুর সময়টা কেমন ছিল?
আমিনুল : আমি যখন ’৯৪ সালে মোহামেডানের জুনিয়র গোলকিপার হিসেবে যোগ দেই তখন কায়সার ভাই, সাব্বির ভাই, কানন ভাইয়ের মতো তারকাদের কাছে পেয়ে ছিলাম। এ জন্য আমার শুরুটা অনেক ভাল ছিল। যার ফলশ্রুতিতে আজ আমি এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
প্রশ্ন : ফুটবল মাঠে এখন দর্শক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এ সমস্যা আরও চরম হচ্ছে। এর মূল কারণ কী?
আমিনুল : এই জায়গাটায় আমি দ্বিমত পোষণ করছি। ফুটবল মাঠে দর্শক নেই কথাটা ঠিক নয়। ঢাকাকেন্দ্রিক ফুটবলের কথা বললে, আমি বলব দর্শকপ্রিয়তা কিছুটা কম। কিন্তু ঢাকার বাইরে সামগ্রিক ফুটবলের কথা যদি চিন্তা করেন তখন দেখবেন ফুটবলের দর্শকপ্রিয়তা কত বেশি। মাঠে দর্শকদের তিল পরিমাণ জায়গা দেয়ার মতো সুযোগ থাকে না। ফুটবল যে এখনও বাংলাদেশের মানুষের প্রথম পছন্দের খেলা সেটা আমরা দেখতে পাই ঢাকার বাইরে কোথাও খেলতে গেলে। সে তুলনায় ঢাকায় দর্শকপ্রিয়তা কিছুটা কম। এর কারণ হয়ত ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার যে মান, বিশেষ করে যাতায়াত ব্যবস্থার, সেই কারণেই হয়ত দর্শকপ্রিয়তা বা স্টেডিয়ামমুখী মানুষের সংখ্যা কম। প্রচারণাও হয়ত এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী। তবে ফেডারেশন যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয় এবং আমরা যদি ভাল ফুটবল উপহার দিতে পারি তবে অবশ্যই মাঠে দর্শক আসবে।
প্রশ্ন : দলগত নৈপুণ্যে পাশাপাশি দর্শকরা তারকা নৈপুণ্য দেখতে চায়। এখন তো বাংলাদেশের ফুটবলে তারকার বড় অভাব?
আমিনুল : আসলে ফুটবল এখন অনেক বেশি দলগত খেলায় বা টোটাল ফুটবলে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক কোচও সেই স্ট্র্যাটেজি নিয়েই দল গড়ে। এ জন্য হয়ত একক কোন আধিপত্য দেখা যায় না। তারপরও আমি মনে করি ফুটবলে তারকা নৈপুণ্যও জরুরী। আর আমাদের দেশের বেশ কিছু তারকা প্লেয়ারও রয়েছে। তারা যদি নিজেদের সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়, পাশাপাশি ক্লাব কিংবা ফেডারেশন সঠিক পদক্ষেপ নেয় তবে অবশ্যই তারকার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন : একসময় দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশ দাপট দেখাত। অথচ এখন ভুটান, নেপালের মতো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ হারে কিংবা ড্র করে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আমিনুল : আমি মনে করি আমরা এখনও শুধু সাফ নিয়েই পড়ে আছি। সাফের বাইরে কোন বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। আমরা যদি সাফের উপরের কোন লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করতাম তবে সাফটা আপনা আপনিই আমাদের জন্য সহজ হয়ে যেত। আমরা যত কিছু করছি, ঘুরেফিরে সব সাফের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। যার কারণে সাফ থেকে বের হওয়ার মতো কোন সুযোগ বা সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। অথচ আমাদের একসময়ে সমকক্ষীয় দল ভারত এখন এশিয়া কাপ নিয়ে চিন্তা করছে। তাই আমাদের এখন সাফের গ-ি থেকে বের হতে হবে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। নইলে সাফও একসময় আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : যে অবস্থায় ফুটবল চলছে তাতে বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত কী?
আমিনুল : এখনও বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত অনেক ভাল বলে আমি মনে করি। আসলে আমাদের সবকিছুই আছে কিন্তু এর সঠিক পরিচর্যা হচ্ছে না। সঠিক পরিচর্যা যদি আমরা করতে পারি তবে অবশ্যই বাংলাদেশের ফুটবলে ভবিষ্যত অনেক ভাল হবে। আর তরুণ প্রজন্মকে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট করতে ফেডারেশনের দায়িত্ব নিতে হবে।
প্রশ্ন : আগের চেয়ে ক্লাব ফুটবলে প্লেয়াররা অনেক পারিশ্রমিক পাচ্ছে। খেলার গুণগত মান কি বাড়ছে?
আমিনুল : অবশ্যই বেড়েছে। টোটাল ফুটবলের যুগে আমাদের ফুটবলাররা আগের থেকে টেকনিক্যালি এবং ট্যাকটিস দুই দিকেই অনেক এগিয়েছে। আর মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ফুটবলাররাও হয়ত আগের থেকে বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছে।
প্রশ্ন : জাতীয় দলের উন্নয়নের জন্য কী করা প্রয়োজন?
আমিনুল : প্রথমত আমাদের একজন দীর্ঘমেয়াদি কোচ থাকা প্রয়োজন। সেটা বিদেশী কিংবা দেশীও যে কেউ হতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে টিটো ভাই, মানিক ভাই, মারুফ ভাইয়ের মতো কোচ আছেন, তাই আমি মনে করি এদের যে কাউকে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। কারণ বিদেশী এলে আমাদের যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো, তার ফুটবল দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া। দেখা যায় তিনি একবছর কাজ করলেন পরে আবার আরেকজন এলেন। তখন আমাদের আবার একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তাই আমাদের দেশেই যেহেতু ভালমানের কোচ আছে সেজন্য বাফুফে বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। আর আমাদের ঘন ঘন কোচ পরিবর্তনের রীতিটা ত্যাগ করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার জাতীয় দলে ফেরার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল?
আমিনুল : না, আসলে সে রকম কিছু আমি ভাবিনি। তবে ফেডারেশন থেকে একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিল, তোমাকে আমরা ফেরাতে চাই, তুমি রাজি কি না? আমি বলেছি, এই মুহূর্তে আমার সেরকম কোন চিন্তাভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে যদি এ রকম কিছু মনে আসে তাহলে জানাব। এখন সে ধরনের কোন চিন্তাভাবনা করছি না।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে সেই চিন্তা আসবে বলে মনে হয়?
আমিনুল : না (হেসে), এখন পর্যন্ত বলা মুশকিল।
প্রশ্ন : জাতীয় দল থেকে অবসর নেয়ার পর ঘরোয়া ফুটবলে কত দিন খেলাবেন? এ রকম কিছু ভেবেছেন?
আমিনুল : না, সেরকম নির্দিষ্ট করে কিছু ভাবিনি। তবে শরীর যত দিন সায় দেয় এবং যতদিন নিজের সেরা খেলাটা ধরে রাখতে পারি, ঠিক ততদিন খেলব। আমি মনে করি এখনও দেশকে আমার অনেক কিছুই দেয়ার আছে।
প্রশ্ন : ফুটবল জীবনকে কতটুকু সার্থক মনে করেন?
আমিনুল : অবশ্যই শতভাগ সার্থক মনে করি। আজকে ফুটবলের জন্যই আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি এবং আমার জীবনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি আমি ফুটবল থেকেই পেয়েছি।
প্রশ্ন : আপনাকে এশীয় মানের গোলকিপার বলা হয়। নিজের সম্পর্কে নিজের অভিমত কী?
আমিনুল : আসলে আমি চেষ্টা করি আমার দলকে বা দেশকে কিছু দেয়ার। তারপর আমার মান নির্বাচনের দায়িত্ব আমি আমার দর্শকদের ওপরই দিতে চাই। আমি শুধু চেষ্টা করি নিজের সেরাটা দেয়ার।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের দু’জন কোচ আপনাকে ইউরোপে খেলানোর কথা বলেছিলেন। বিষয়টি কতদূর এগিয়ে ছিল বা বাস্তবায়ন হয়নি কেন?
আমিনুল : আমার দু’বার বাইরে খেলার সুযোগ হয়েছিল। একবার সৌদি আরবে আরেকবার ডেনমার্কে কোচ ডিডোর (জাতীয় দলের সাবেক ব্রাজিলিয়ান কোচ) মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের মতো এজেন্ট নেই বলে প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও বাইরে খেলার সুযোগ হয় না। আমারও সে কারণেই হয়নি।
প্রশ্ন : আপনি জাতীয় দল থেকে অবসরে গেলেন। বিপ্লবও দলে নেই। হয়ত বেশি দিন খেলবেনও না। কিন্তু আপনাদের মানের গোলকিপার কি দেখছেন?
আমিনুল : তরুণ যারা আছে, বিশেষ করে হিমেল, জিয়া, মামুন খান, টিটো ওরা কিন্তু খুব ভাল করছে। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যে জায়গাটা আমি পেলাম সেটা যেন ধরে রাখতে পারি। যদি ওরা সেই চিন্তা নিয়ে খেলে তবে অবশ্যই ওরা ভাল করবে।
প্রশ্ন : ফুটবল জীবনে আপনার তৃপ্তি-অতৃপ্তির কথা বলুন?
আমিনুল : আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার সবই ফুটবল থেকে। তাই আমি আমার ফুটবল জীবন নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত। আর আমার ফুটবল জীবনে অতৃপ্তি বলে কিছু নেই। তবে সব ফুটবলারের মনের সুপ্ত ইচ্ছা থাকে সেটা হলো ভাল খেলার শেষ নেই। আমি আমার ক্যারিয়ারের শেষপর্যন্ত সেরাটা ধরে রাখতে চাই।
প্রশ্ন : ফুটবল নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমিনুল : যেহেতু ফুটবলই আমার জীবনের সব তাই চেষ্টা করব ফুটবল নিয়েই কিছু করতে। ইতোমধ্যে আমরা কয়েক প্লেয়ার মিলে একটা ফুটবল স্কুল গড়ে তুলেছি। চেষ্টা করব এটাকে বড় আকারে করার।
প্রশ্ন : ফুটবল নিয়ে আজও যে স্বপ্ন দেখেন?
আমিনুল : আমি এর আগেও অনেকবার বলেছি যে, ফুটবল নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের যে স্বপ্ন বা প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশা আমরা পূরণ করতে পারিনি। আমি চাই আমাদের দেশের মানুষের সেই স্বপ্ন যেন খুব তাড়াতাড়িই পূরণ হয়।
প্রশ্ন : ক্লাব সভাপতির (মনজুর কাদের) সঙ্গে আপনার বিরোধের কথা শোনা যাচ্ছিল?
আমিনুল : আসলে একটা জায়গায় খেলতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। উনার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটা উনি করেছেন, আর আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটা আমি করেছি। এটাকে বড় কোন বিষয় হিসেবে আমি মনে করি না। এমনটা হতেই পারে।
প্রশ্ন : বিজেএমসিতে আপনার লক্ষ্য কী?
আমিনুল : অবশ্যই ভাল করা। একটা লক্ষ্য এবং প্রত্যাশা নিয়েই আমি এই দলে এসেছি। গতবার বিজেএমসি যে ভাল করেছে তার চেয়ে ভাল কিছু করাই মূলত লক্ষ্য। আমাদের দলে ভাল মানের কিছু বিদেশী আনা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় তরুণরা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে আমি মনে করি শক্তিশালী দলই গঠন করা হয়েছে।
প্রশ্ন : আবাহনী-মোহামেডানের জার্সি গায়ে খেলা আর অন্য দলের জার্সি গায়ে খেলার মাঝে কি কোন পার্থক্য খুঁজে পান?
আমিনুল : স্বাধীনতা-উত্তর ফুটবলের কথা বললে অবশ্যই আমাদের দেশে আবাহনী-মোহামেডান এগিয়ে থাকবে। একমাত্র এই দুটি দলেরই বড় সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। অন্য দলের তুলনায় পার্থক্যটা এখানেই। তবে অন্য ক্লাবগুলো বর্তমানে যেভাবে শক্তিশালী দল গঠন করছে সেটা অবশ্যই ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক। এখন বাংলাদেশের ফুটবলের ছয়-সাতটি দল সমপর্যায়ে চলে এসেছে। যার কারণে ঘরোয়া ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও অনেক বেড়েছে। এটা আমাদের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক।
প্রশ্ন : গত দুই মৌসুম যাবত আবাহনী-মোহামেডানের সেই দ্বৈরথ নেই বললেই চলে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমিনুল : আমি এটাকে ভাল দিক হিসেবেই উল্লেখ করব। কারণ আবাহনী-মোহামেডানের মতো সমপর্যায়ের দল বেরিয়ে এসেছে বলেই শুধু এই দুই দলের দ্বৈরথটা কমে গেছে এবং নতুন শক্তিগুলো প্রমাণ করেছে যে তারা শিরোপার দাবিদার। আমি মনে করি আমাদের সার্বিক ফুটবলের জন্য এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।
প্রশ্ন : এখন ফুটবলের পরিবেশ কেমন মনে হচ্ছে? মানে আপনার শুরুর সময়ের সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলি?
আমিনুল : পরিবেশগত দিক বললে বলব, আমি যখন শুরু করেছিলাম তখনকার পরিবেশের প্লেয়ার, অফিসিয়ালসহ সবার মধ্যে আন্তরিকতা বা বোঝাপড়াটা অনেক ভাল ছিল। এখনও ভাল। কিন্তু বাংলাদেশে ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা বা আমাদের দেশের মানুষ ফুটবলকে যে জায়গায় দেখতে চায়, সেই জায়গাটিতে এখন পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারিনি। যার কারণে পরিবেশগত বা সামগ্রিক দিকটা আমি মনে করি আগের থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে আছে। তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমরা যদি ভাল করতে পারি বা ভাল লোকাল প্লেয়ার তৈরি করতে পারি তাহলে পরিবেশগত দিকটা আপনা-আপনি বদলে যাবে। এ জন্য বাফুফের নতুন কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে তাঁরা যেন ফুটবলে সুন্দর একটা অবস্থান তৈরি করে রেখে যান। যাতে পরবর্তীতে যাঁরা আসবেন তাঁরা সেখান থেকে ফুটবলে ধারাবাহিক উন্নয়ন দেখতে পায়।
প্রশ্ন : আপনার শুরুর সময়টা কেমন ছিল?
আমিনুল : আমি যখন ’৯৪ সালে মোহামেডানের জুনিয়র গোলকিপার হিসেবে যোগ দেই তখন কায়সার ভাই, সাব্বির ভাই, কানন ভাইয়ের মতো তারকাদের কাছে পেয়ে ছিলাম। এ জন্য আমার শুরুটা অনেক ভাল ছিল। যার ফলশ্রুতিতে আজ আমি এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
প্রশ্ন : ফুটবল মাঠে এখন দর্শক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এ সমস্যা আরও চরম হচ্ছে। এর মূল কারণ কী?
আমিনুল : এই জায়গাটায় আমি দ্বিমত পোষণ করছি। ফুটবল মাঠে দর্শক নেই কথাটা ঠিক নয়। ঢাকাকেন্দ্রিক ফুটবলের কথা বললে, আমি বলব দর্শকপ্রিয়তা কিছুটা কম। কিন্তু ঢাকার বাইরে সামগ্রিক ফুটবলের কথা যদি চিন্তা করেন তখন দেখবেন ফুটবলের দর্শকপ্রিয়তা কত বেশি। মাঠে দর্শকদের তিল পরিমাণ জায়গা দেয়ার মতো সুযোগ থাকে না। ফুটবল যে এখনও বাংলাদেশের মানুষের প্রথম পছন্দের খেলা সেটা আমরা দেখতে পাই ঢাকার বাইরে কোথাও খেলতে গেলে। সে তুলনায় ঢাকায় দর্শকপ্রিয়তা কিছুটা কম। এর কারণ হয়ত ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার যে মান, বিশেষ করে যাতায়াত ব্যবস্থার, সেই কারণেই হয়ত দর্শকপ্রিয়তা বা স্টেডিয়ামমুখী মানুষের সংখ্যা কম। প্রচারণাও হয়ত এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী। তবে ফেডারেশন যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয় এবং আমরা যদি ভাল ফুটবল উপহার দিতে পারি তবে অবশ্যই মাঠে দর্শক আসবে।
প্রশ্ন : দলগত নৈপুণ্যে পাশাপাশি দর্শকরা তারকা নৈপুণ্য দেখতে চায়। এখন তো বাংলাদেশের ফুটবলে তারকার বড় অভাব?
আমিনুল : আসলে ফুটবল এখন অনেক বেশি দলগত খেলায় বা টোটাল ফুটবলে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক কোচও সেই স্ট্র্যাটেজি নিয়েই দল গড়ে। এ জন্য হয়ত একক কোন আধিপত্য দেখা যায় না। তারপরও আমি মনে করি ফুটবলে তারকা নৈপুণ্যও জরুরী। আর আমাদের দেশের বেশ কিছু তারকা প্লেয়ারও রয়েছে। তারা যদি নিজেদের সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়, পাশাপাশি ক্লাব কিংবা ফেডারেশন সঠিক পদক্ষেপ নেয় তবে অবশ্যই তারকার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন : একসময় দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশ দাপট দেখাত। অথচ এখন ভুটান, নেপালের মতো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ হারে কিংবা ড্র করে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আমিনুল : আমি মনে করি আমরা এখনও শুধু সাফ নিয়েই পড়ে আছি। সাফের বাইরে কোন বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। আমরা যদি সাফের উপরের কোন লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করতাম তবে সাফটা আপনা আপনিই আমাদের জন্য সহজ হয়ে যেত। আমরা যত কিছু করছি, ঘুরেফিরে সব সাফের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। যার কারণে সাফ থেকে বের হওয়ার মতো কোন সুযোগ বা সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। অথচ আমাদের একসময়ে সমকক্ষীয় দল ভারত এখন এশিয়া কাপ নিয়ে চিন্তা করছে। তাই আমাদের এখন সাফের গ-ি থেকে বের হতে হবে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। নইলে সাফও একসময় আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : যে অবস্থায় ফুটবল চলছে তাতে বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত কী?
আমিনুল : এখনও বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত অনেক ভাল বলে আমি মনে করি। আসলে আমাদের সবকিছুই আছে কিন্তু এর সঠিক পরিচর্যা হচ্ছে না। সঠিক পরিচর্যা যদি আমরা করতে পারি তবে অবশ্যই বাংলাদেশের ফুটবলে ভবিষ্যত অনেক ভাল হবে। আর তরুণ প্রজন্মকে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট করতে ফেডারেশনের দায়িত্ব নিতে হবে।
প্রশ্ন : আগের চেয়ে ক্লাব ফুটবলে প্লেয়াররা অনেক পারিশ্রমিক পাচ্ছে। খেলার গুণগত মান কি বাড়ছে?
আমিনুল : অবশ্যই বেড়েছে। টোটাল ফুটবলের যুগে আমাদের ফুটবলাররা আগের থেকে টেকনিক্যালি এবং ট্যাকটিস দুই দিকেই অনেক এগিয়েছে। আর মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ফুটবলাররাও হয়ত আগের থেকে বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছে।
প্রশ্ন : জাতীয় দলের উন্নয়নের জন্য কী করা প্রয়োজন?
আমিনুল : প্রথমত আমাদের একজন দীর্ঘমেয়াদি কোচ থাকা প্রয়োজন। সেটা বিদেশী কিংবা দেশীও যে কেউ হতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে টিটো ভাই, মানিক ভাই, মারুফ ভাইয়ের মতো কোচ আছেন, তাই আমি মনে করি এদের যে কাউকে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। কারণ বিদেশী এলে আমাদের যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো, তার ফুটবল দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া। দেখা যায় তিনি একবছর কাজ করলেন পরে আবার আরেকজন এলেন। তখন আমাদের আবার একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তাই আমাদের দেশেই যেহেতু ভালমানের কোচ আছে সেজন্য বাফুফে বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। আর আমাদের ঘন ঘন কোচ পরিবর্তনের রীতিটা ত্যাগ করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার জাতীয় দলে ফেরার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল?
আমিনুল : না, আসলে সে রকম কিছু আমি ভাবিনি। তবে ফেডারেশন থেকে একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিল, তোমাকে আমরা ফেরাতে চাই, তুমি রাজি কি না? আমি বলেছি, এই মুহূর্তে আমার সেরকম কোন চিন্তাভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে যদি এ রকম কিছু মনে আসে তাহলে জানাব। এখন সে ধরনের কোন চিন্তাভাবনা করছি না।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে সেই চিন্তা আসবে বলে মনে হয়?
আমিনুল : না (হেসে), এখন পর্যন্ত বলা মুশকিল।
প্রশ্ন : জাতীয় দল থেকে অবসর নেয়ার পর ঘরোয়া ফুটবলে কত দিন খেলাবেন? এ রকম কিছু ভেবেছেন?
আমিনুল : না, সেরকম নির্দিষ্ট করে কিছু ভাবিনি। তবে শরীর যত দিন সায় দেয় এবং যতদিন নিজের সেরা খেলাটা ধরে রাখতে পারি, ঠিক ততদিন খেলব। আমি মনে করি এখনও দেশকে আমার অনেক কিছুই দেয়ার আছে।
প্রশ্ন : ফুটবল জীবনকে কতটুকু সার্থক মনে করেন?
আমিনুল : অবশ্যই শতভাগ সার্থক মনে করি। আজকে ফুটবলের জন্যই আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি এবং আমার জীবনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি আমি ফুটবল থেকেই পেয়েছি।
প্রশ্ন : আপনাকে এশীয় মানের গোলকিপার বলা হয়। নিজের সম্পর্কে নিজের অভিমত কী?
আমিনুল : আসলে আমি চেষ্টা করি আমার দলকে বা দেশকে কিছু দেয়ার। তারপর আমার মান নির্বাচনের দায়িত্ব আমি আমার দর্শকদের ওপরই দিতে চাই। আমি শুধু চেষ্টা করি নিজের সেরাটা দেয়ার।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের দু’জন কোচ আপনাকে ইউরোপে খেলানোর কথা বলেছিলেন। বিষয়টি কতদূর এগিয়ে ছিল বা বাস্তবায়ন হয়নি কেন?
আমিনুল : আমার দু’বার বাইরে খেলার সুযোগ হয়েছিল। একবার সৌদি আরবে আরেকবার ডেনমার্কে কোচ ডিডোর (জাতীয় দলের সাবেক ব্রাজিলিয়ান কোচ) মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের মতো এজেন্ট নেই বলে প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও বাইরে খেলার সুযোগ হয় না। আমারও সে কারণেই হয়নি।
প্রশ্ন : আপনি জাতীয় দল থেকে অবসরে গেলেন। বিপ্লবও দলে নেই। হয়ত বেশি দিন খেলবেনও না। কিন্তু আপনাদের মানের গোলকিপার কি দেখছেন?
আমিনুল : তরুণ যারা আছে, বিশেষ করে হিমেল, জিয়া, মামুন খান, টিটো ওরা কিন্তু খুব ভাল করছে। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যে জায়গাটা আমি পেলাম সেটা যেন ধরে রাখতে পারি। যদি ওরা সেই চিন্তা নিয়ে খেলে তবে অবশ্যই ওরা ভাল করবে।
প্রশ্ন : ফুটবল জীবনে আপনার তৃপ্তি-অতৃপ্তির কথা বলুন?
আমিনুল : আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার সবই ফুটবল থেকে। তাই আমি আমার ফুটবল জীবন নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত। আর আমার ফুটবল জীবনে অতৃপ্তি বলে কিছু নেই। তবে সব ফুটবলারের মনের সুপ্ত ইচ্ছা থাকে সেটা হলো ভাল খেলার শেষ নেই। আমি আমার ক্যারিয়ারের শেষপর্যন্ত সেরাটা ধরে রাখতে চাই।
প্রশ্ন : ফুটবল নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমিনুল : যেহেতু ফুটবলই আমার জীবনের সব তাই চেষ্টা করব ফুটবল নিয়েই কিছু করতে। ইতোমধ্যে আমরা কয়েক প্লেয়ার মিলে একটা ফুটবল স্কুল গড়ে তুলেছি। চেষ্টা করব এটাকে বড় আকারে করার।
প্রশ্ন : ফুটবল নিয়ে আজও যে স্বপ্ন দেখেন?
আমিনুল : আমি এর আগেও অনেকবার বলেছি যে, ফুটবল নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের যে স্বপ্ন বা প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশা আমরা পূরণ করতে পারিনি। আমি চাই আমাদের দেশের মানুষের সেই স্বপ্ন যেন খুব তাড়াতাড়িই পূরণ হয়।
No comments