জীবন বাজি রেখে তোলা ছবি, মুক্তি সংগ্রামের অমূল্য স্মারক- ঢাকা আর্ট সেন্টারে ‘রায়হানের ৭১’ by মোরসালিন মিজান
আশ্চর্য সময় ১৯৭১। চোখে ঘুম নেই। সিথানে মৃত্যু। বুকের ভেতর যন্ত্রণা। এর পরও যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ৭ মার্চ সে আহ্বান জানিয়ে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে অনুযায়ী চলছিল প্রস্তুতি। কিন্তু আবদুল হামিদ রায়হানের হাতে তখন একটি স্টিল ক্যামেরা।
না, ক্যামেরা হাতে যুদ্ধ হয় না। তবে যা হয় তারও মূল্য ইতিহাস জানে। হয়ত তাই নিজের মতো করে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। জীবন বাজি রেখে ছবি তুলেছেন। আবদুল হামিদ রায়হানের তোলা এসব ছবি বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্যবার ছাপা হয়েছে। ছাপা হচ্ছে এবং হবে। কারণ রায়হানের তোলা আলোকচিত্রগুলো আর শুধু আলোকচিত্র হয়ে নেই বরং বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের অমূল্য স্মারক। আর এসব স্মারক নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে রাজধানীর ঢাকা আর্ট সেন্টার। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে এখানে শুরু হয়েছে বিশেষ এ প্রদর্শনী। শিরোনাম রায়হানের ৭১। অসাধারণ এই আয়োজন দেখতে প্রতিদিনই গ্যালারিতে ভিড় করছেন কৌতূহলী মানুষ।
মঙ্গলবার আর্ট সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, একাত্তরে তোলা দুর্লভ ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে দু’ দুটো গ্যালারি। গ্যালারিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন বদলে যায় সব। বাইরে দুনিয়া মাথা থেকে ছিটকে পড়ে। নিঃশব্দ ঘরে কথা বলে ওঠে একাত্তর। হ্যাঁ, সবই সাদাকালো ছবি। কিন্তু একটিবারের জন্য মনে হয় না ছবিগুলোতে কোন কিছুর অভাব আছে! খ-চিত্র হলেও প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রথমেই চোখে পড়ে প্রস্তুতিপর্ব। রায়হানের ছবি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বটি কেমন ছিল তা বুঝতে দারুণ সাহায্য করে। একটি ছবি রানা তুলেছেন কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠ থেকে। একাত্তরের ২৫ মার্চ তোলা ছবিতে দেখা যায়, তীর ধনুক হাতে নিয়ে দেশকে পাকিস্তানীমুক্ত করার শপথ নিচ্ছে ছাত্র জনতা। সমাবেশের অগ্রভাগে খুঁজে পাওয়া যায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার নূরে আলম জিকুকে।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীরা। সে ইতিহাসটি খুঁজে পাওয়া যায় রায়হানের একাধিক আলোকচিত্রে। একটি ছবিতে দেখা যায়, যশোরের পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে বক্তৃতা করছেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ছবিতে তাজউদ্দীনের আশপাশে খুঁজে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’র পাঠক এম.আর আখতার মুকুল, আকাশবাণীর প্রতিনিধি উপেন তরফদার এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার পথ-প্রান্তর ধরে অক্লান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন আরেক মন্ত্রী কামারুজ্জামানও। ১৯৭১ সালের ২৪ নবেম্বর তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, রানাঘাট যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা কামারুজ্জামান। গলায় লম্বা করে চাদর ঝোলানো নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাচ্ছেন। একই ফ্রেমে কামারুজ্জামানের সঙ্গে ধরা পড়েন খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এর কয়েক দিন পর ২ ডিসেম্বরে কামারুজ্জামান আবিষ্কৃত হন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ছবিতে দেখা যায় এক বাঙালী সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করছেন তিনি।
কোন কোন ছবিতে পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতিতদের একজন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার উত্তর মিরপুর গ্রামের গ্যাদন শেখ। পাকিস্তানী হায়েনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর ঘাড় ও পেট চিরে দিয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর সেই নির্যাতিত ব্যক্তির ছবিটি ক্যামেরাবন্দী করেন রায়হান। পাকিস্তানী বাহিনীর বিভিন্ন ধ্বংসলীলারও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় রায়হানের ছবিতে। তেমন একটি ছবি তিনি তোলেন কুষ্টিয়ার নিউমার্কেট এলাকা থেকে।
কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল ততই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল পাকিস্তানী বাহিনী। বিভিন্ন আলোকচিত্রে সে চিত্র ফুটে উঠেছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর ট্যাঙ্ক ফেলে পালিয়েছে পাকিস্তানীরা। জাতীয় দিনগুলোতে বার বার ব্যবহার করা ছবিটি তোলা হয় ১৪ ডিসেম্বর। এর আগে ১১ ডিসেম্বর তোলা ছবিতে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনীর হাতে যশোর জেলে আটক হয়েছে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর দুই সদস্য। হায়েনাদের চোখে মৃত্যু ভয় স্পষ্ট। ১৯ নবেম্বর তোলা অপর একটি বিখ্যাত ছবিতে দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ঘৃণ্য রাজাকারদের। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার মুন্সীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এদের আটক করেছিলেন।
যুদ্ধের শেষের দিকে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেন নিঃস্ব মানুষ। কুষ্টিয়া সীমান্ত থেকে সেইসব ঘরে ফেরা মানুষের ছবি তুলেছেন রায়হান। অদ্ভুত সুন্দর এক ছবিতে দেখা যায়, লম্বা সাঁকো পার হয়ে নিজের দেশে ঢুকছেন ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ।
তবে শুধু দেশে নয়, ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ছবি তুলেছেন রায়হান। ৬ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেয়ায় তুমুল আনন্দে ফেটে পড়েছে দুই দেশের মানুষ। খোলা ট্রাকে শেখ মুজিবুর রহমনের ছবি ও পোস্টার সেটে আনন্দ মিছিল করছেন তাঁরা। কলকাতার সল্টলেক শরণার্থী শিবির থেকেও অনবদ্য কিছু ছবি তুলেছেন আবদুল হামিদ রায়হান।
তবে বড় বেদনার যে, এ প্রদর্শনীর আগে থেকেই ছবিগুলো দেখছেন অধিকাংশ মানুষ। প্রশংসা করছেন আলোকচিত্রীর। কিন্তু যিনি জীবন বাজি রেখে ইতিহাসের স্মারকগুলো সংগ্রহ করেছেন সেই মানুষটিকে চেনেন ক’জন?
মঙ্গলবার আর্ট সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, একাত্তরে তোলা দুর্লভ ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে দু’ দুটো গ্যালারি। গ্যালারিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন বদলে যায় সব। বাইরে দুনিয়া মাথা থেকে ছিটকে পড়ে। নিঃশব্দ ঘরে কথা বলে ওঠে একাত্তর। হ্যাঁ, সবই সাদাকালো ছবি। কিন্তু একটিবারের জন্য মনে হয় না ছবিগুলোতে কোন কিছুর অভাব আছে! খ-চিত্র হলেও প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রথমেই চোখে পড়ে প্রস্তুতিপর্ব। রায়হানের ছবি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বটি কেমন ছিল তা বুঝতে দারুণ সাহায্য করে। একটি ছবি রানা তুলেছেন কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠ থেকে। একাত্তরের ২৫ মার্চ তোলা ছবিতে দেখা যায়, তীর ধনুক হাতে নিয়ে দেশকে পাকিস্তানীমুক্ত করার শপথ নিচ্ছে ছাত্র জনতা। সমাবেশের অগ্রভাগে খুঁজে পাওয়া যায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার নূরে আলম জিকুকে।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীরা। সে ইতিহাসটি খুঁজে পাওয়া যায় রায়হানের একাধিক আলোকচিত্রে। একটি ছবিতে দেখা যায়, যশোরের পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে বক্তৃতা করছেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ছবিতে তাজউদ্দীনের আশপাশে খুঁজে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’র পাঠক এম.আর আখতার মুকুল, আকাশবাণীর প্রতিনিধি উপেন তরফদার এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার পথ-প্রান্তর ধরে অক্লান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন আরেক মন্ত্রী কামারুজ্জামানও। ১৯৭১ সালের ২৪ নবেম্বর তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, রানাঘাট যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা কামারুজ্জামান। গলায় লম্বা করে চাদর ঝোলানো নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাচ্ছেন। একই ফ্রেমে কামারুজ্জামানের সঙ্গে ধরা পড়েন খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এর কয়েক দিন পর ২ ডিসেম্বরে কামারুজ্জামান আবিষ্কৃত হন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ছবিতে দেখা যায় এক বাঙালী সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করছেন তিনি।
কোন কোন ছবিতে পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতিতদের একজন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার উত্তর মিরপুর গ্রামের গ্যাদন শেখ। পাকিস্তানী হায়েনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর ঘাড় ও পেট চিরে দিয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর সেই নির্যাতিত ব্যক্তির ছবিটি ক্যামেরাবন্দী করেন রায়হান। পাকিস্তানী বাহিনীর বিভিন্ন ধ্বংসলীলারও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় রায়হানের ছবিতে। তেমন একটি ছবি তিনি তোলেন কুষ্টিয়ার নিউমার্কেট এলাকা থেকে।
কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল ততই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল পাকিস্তানী বাহিনী। বিভিন্ন আলোকচিত্রে সে চিত্র ফুটে উঠেছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর ট্যাঙ্ক ফেলে পালিয়েছে পাকিস্তানীরা। জাতীয় দিনগুলোতে বার বার ব্যবহার করা ছবিটি তোলা হয় ১৪ ডিসেম্বর। এর আগে ১১ ডিসেম্বর তোলা ছবিতে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনীর হাতে যশোর জেলে আটক হয়েছে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর দুই সদস্য। হায়েনাদের চোখে মৃত্যু ভয় স্পষ্ট। ১৯ নবেম্বর তোলা অপর একটি বিখ্যাত ছবিতে দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ঘৃণ্য রাজাকারদের। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার মুন্সীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এদের আটক করেছিলেন।
যুদ্ধের শেষের দিকে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেন নিঃস্ব মানুষ। কুষ্টিয়া সীমান্ত থেকে সেইসব ঘরে ফেরা মানুষের ছবি তুলেছেন রায়হান। অদ্ভুত সুন্দর এক ছবিতে দেখা যায়, লম্বা সাঁকো পার হয়ে নিজের দেশে ঢুকছেন ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ।
তবে শুধু দেশে নয়, ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ছবি তুলেছেন রায়হান। ৬ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেয়ায় তুমুল আনন্দে ফেটে পড়েছে দুই দেশের মানুষ। খোলা ট্রাকে শেখ মুজিবুর রহমনের ছবি ও পোস্টার সেটে আনন্দ মিছিল করছেন তাঁরা। কলকাতার সল্টলেক শরণার্থী শিবির থেকেও অনবদ্য কিছু ছবি তুলেছেন আবদুল হামিদ রায়হান।
তবে বড় বেদনার যে, এ প্রদর্শনীর আগে থেকেই ছবিগুলো দেখছেন অধিকাংশ মানুষ। প্রশংসা করছেন আলোকচিত্রীর। কিন্তু যিনি জীবন বাজি রেখে ইতিহাসের স্মারকগুলো সংগ্রহ করেছেন সেই মানুষটিকে চেনেন ক’জন?
No comments