ক্ষোভের অনলে...- এক নজরে জন টেরি by ফারজানা আক্তার সাথী

বয়স খুব বেশি তাও নয়, ৩১। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৭৮ ম্যাচ। সময়ের ব্যবধান মাত্র ৯ বছর। ইচ্ছা করলে আর কয়েক বছর অনায়াসে খেলতে পারতেন। ফর্ম বা ইনজুরি কোনটাই সমস্যা করছিল না। তারপরও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন জন টেরি।


ঘোষণা দিয়েছেন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের জার্সিতে আর দেখা যাবে না তাঁকে। ইংল্যান্ড দলের সমসাময়িক সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে বিবেচিত টেরির এমন নাটকীয় অবসরের ঘোষণায় হতবাক অনেকেই। ব্রিটিশ গণমাধ্যম রীতিমতো বিস্মিত। সাবেক অনেক ফুটবলারদের মতে, টেরির চলে যাওয়া ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
আকস্মিক আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে চলে যাওয়ার পেছনে কারণ থাকে অনেকই। টেরিরও আছে। বলতে গেলে তা কিছুটা ইঙ্গিতও দিয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, টেরির এই ঘোষণা চাপা অভিমান থেকেই। দুই দফায় ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা টেরি অবশ্য ক্লাব ফুটবলে খেলা চালিয়ে যাবেন। চেলসির হয়ে দীর্ঘদিন খেলার আশা প্রকাশ করেছেন। এখানেও অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড রয়েছে টেরির বাহুতে। প্রশ্ন উঠছে অভিমানটা কোথায়? সেটা বেশ পরিষ্কার। আলোচিত বর্ণবাদ বৈষম্য নিয়েই। যেটা ঘটেছিল গত বছরের শেষের দিকে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের এক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল চেলসি ও কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স। ওই ম্যাচে টেরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি বর্ণবাদী গালি দিয়েছেন কিউপিআরের ডিফেন্ডার এ্যান্টোনিও ফার্দিনান্দকে। যিনি আবার টেরির জাতীয় দলের সতীর্থ রিও ফার্ডিনান্ডোর আপন ছোট ভাই। তবে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। মামলা উঠেছে আদালতেও। পুলিশ তদন্তে নামে, কাঠগড়ায় পর্যন্ত গিয়েছিলেন জন টেরি। তবে কিছুদিন আগে আদালত তাঁকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেয়। এখানেই সব থেমে গেলে ভালই হতো। তবে হয়নি। পরের অধ্যায় বিব্রত করেছে জন টেরিকে। এখন সেই ঘটনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ইংল্যান্ড ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) হাত পড়ায়। কিছুদিনের মধ্যেই আবার শুনানির জন্য ডাকা হবে টেরিকে। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতেই কি টেরির প্রস্থান?
৩১ বছর বয়স্ক জন টেরি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৭৮টি ম্যাচ। ২০০৩ সালে অভিষেক হওয়ার পর বিশ্বকাপ খেলেছেন দুটি (২০০৬ ও ২০১০)। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। পরশু তিনি জানিয়েছেন, ইংল্যান্ড জাতীয় দলে তাঁর অবস্থান ক্রমশ কঠিন হয়ে যাওয়ায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘুরেফিরে এসেছে বর্ণবাদ বৈষম্য প্রসঙ্গ। জন টেরির মতে, ইংলিশ ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন এই মামলা দিয়ে তাঁকে খুব কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যেখানে আদালত আমাকে এই অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে, সেখানে এফএ এ ব্যাপারে নতুন করে অভিযোগ আনায় আমি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি।’ টেরি বলেন, ‘আমি জাতীয় দলের হয়ে যতগুলো ম্যাচে মাঠে নেমেছি, প্রতিটিতেই নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত অবসরের সিদ্ধান্ত আমার জন্য খুব কষ্টকর।’
২০০৩ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয় জন টেরির। এরপর খেলেছেন টানা ৯টি বছর। সেন্টার ব্যাক পজিশনে মোট ৭৮ ম্যাচ খেলেও গোল করেছেন ৬টি। শেষ ম্যাচটি ছিল চলতি মাসের শুরুর দিকে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে মলডোভার বিরুদ্ধে জিতেছিল ইংল্যান্ড। কে জানত ওই ম্যাচটিই জন টেরির শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। টেরির ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু আরও আগে থেকে। ১৯৯৮ সাল থেকে আছেন চেলসি শিবিরে। সব ধরনের প্রতিযোগিতায় চেলসির হয়ে খেলেছেন মোট ৫৪৭ ম্যাচ। গোল করেছেন ৪৯টি। ক্লাব ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত চেলসির হয়ে অনেক শিরোপা জিতেছেন টেরি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি প্রিমিয়ার লীগ, পাঁচটি এফএ কাপ ও একটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা। ব্যক্তিগত অর্জনের ভা-ারও কম নয়। পিএফএ কর্তৃক বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন ২০০৪-০৫ মৌসুমে। ২০০৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপের সেরা টিমের সদস্য ছিলেন। ফিপ্রো বিশ্ব একাদশে ছিলেন ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল, টানা ৫ বছর।
সামর্থ্য ছিল আরও কিছু দেয়ার। তবে তার আগেই নিজেকে সরিয়ে নিলেন টেরি। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিস্মিত, সঙ্গে ক্ষিপ্তও। দ্য টাইমসের ফুটবল সম্পাদক বলেছেন, ‘খেলা এখন কলঙ্কিতর দিকে’। টেরির সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এরচেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি তিনি মোকাবেলা করেছেন। এটা তেমন কোন সমস্যাই ছিল না।’ দ্য সান শিরোনাম দিয়েছে, ‘জন টেরি বের হয়ে যাচ্ছেন ইংল্যান্ড থেকে।’ সাব হেডিংয়ে ভক্তদের সান্ত¡না দিয়েছে, ‘৭৮টি ম্যাচ, কিন্তু কোন অশ্রু নয়।’ ট্যাবলয়েড মিরর লিখেছে, ‘একতার কোন চিহ্ন নেই, শুধু আছে বিভক্তি।’ টেরিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছে দ্য সান। ‘একদিন টেরি ফিরে আসবে, ... একজন কোচ হিসেবে।’ অনদিকে টেরির চলে যাওয়াকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন চেলসির সাবেক সহকারী ম্যানেজার রে উইলকিন্স। যিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক মিডফিল্ডার ও চেলসির সাবেক অধিনায়ক। তাঁর মতে, ‘টেরির চলে যাওয়া বেশি সমস্যা সৃষ্টি করবে ইংল্যান্ডের বর্তমান কোচ রয় হডসনকে। টেরির অভাব সবাই বুঝবে আগামী ব্রাজিল বিশ্বকাপে। স্কাই স্পোর্টসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে উইলকিন্স বলেন, ‘সে অসাধারণ চরিত্রের একজন ফুটবলার ছিল। ড্রেসিংরুমে তো আরও মজাদার। আবার মাঠের রক্ষণভাগে সাহসী সৈনিক। নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত স্বীয় দায়িত্ব।’

No comments

Powered by Blogger.