বহে কাল নিরবধি-'আজ আমি মন্ত্রী হলাম' by এম আবদুল হাফিজ
সেই পাকিস্তান আমলে জহির রায়হানের একটি ছোটগল্প পড়েছিলাম, যার শিরোনাম সম্ভবত ছিল, 'আজ আমি মন্ত্রী হলাম'। বলা বাহুল্য, প্রথম পুরুষে লেখা এই গল্পটিতে মন্ত্রী হওয়ার নানা অনুভূতি ও উচ্ছ্বাসের কথা উঠে এসেছিল। অনেক দেশে অনেক লোক আছেন,
যাঁরা 'রাজনীতি' নামক বনের মোষ তাড়িয়ে মন্ত্রী তো দূরের কথা, কোনো কিছুই হতে পারেননি। সেই মন্ত্রিত্ব যখন কারো পদচুম্বন করে উপেক্ষা-অবহেলায় প্রত্যাখ্যাত হয়, তা স্বাভাবিকভাবে খানিকটা সমালোচনার নয়- আলোচনার ঝড় তুলতেই পারে। তবে তা স্থায়িত্ব পায় না। পাওয়া উচিতও নয়।
আলোচনার ঝড়ও উঠেছে বিশেষ করে প্রবীণ ও একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যানকে ঘিরে। তোফায়েল আওয়ামী লীগে কোনো 'বসন্তের কোকিল' নন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক, গত মেয়াদে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ইত্যাদি অভিধায় বিভূষিত এই আওয়ামী লীগ নেতাকে যেনতেনভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই তাঁকে নিয়ে বা তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এত কৌতূহল। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে তাঁকে ঘিরে ইতি ও নেতিবাচক বিতর্ক। আবার দলের বিপদহরণ কাণ্ডারি রূপে সর্বত্রই তাঁর ত্রাতার ভূমিকায় উপস্থিতি। নিজ এলাকায় নন, কাপাসিয়ায়ও মর্যাদার লড়াইয়ে এতজনের মধ্যেও তাঁরই ডাক পড়ে।
আমি নিজে এই নেতাকে কমবেশি চিনি এবং তাঁর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় (Interaction) লিপ্ত হয়েছি। তাঁকে একজন নিশ্চয়াত্মক (assertive) রাজনীতিকই মনে হয়েছে, যদিও বিগত এক-এগারোর দুঃসময়ে তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর দলে সংস্কারের পক্ষে শনাক্ত করা হয়েছিল। অপর তিনজন সংস্কারবাদী আওয়ামী নেতার সঙ্গে কী সংস্কার তিনি তাঁর দলে চেয়েছিলেন, তা কখনো না বুঝলেও অপর অনেকের মতো প্রধান দুটি দলের নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, তহবিল ব্যবস্থাপনা ও দল পরিচালনার স্টাইল ইত্যাদিতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে মনে হতো।
তবে সংস্কারবাদী হয়েও তোফায়েলের রাজনৈতিক আচরণ ও উচ্চারণে যথেষ্টই সংযম ছিল এবং ওই সব দুর্দিনে দলকে এক খণ্ডে রাখতে অন্যদেরসহ তোফায়েলের অবদান ছিল। অথচ দলের বিগত কাউন্সিলে বা তার আগে এই মেয়াদের মন্ত্রিসভা গঠনে আমরা তাঁকে শুধু সাইডলাইনে দেখলাম। মন্ত্রী নির্বাচনে হয়তো প্রধান নির্বাহীর অনেক বিবেচনার বিষয় থাকে। কিন্তু দলেও তিনি কোনো সম্মানজনক আসন পেলেন না। দলের নীতিনির্ধারণী কোনো কমিটি বা সংস্থা নয়, তার স্থান হলো একেবারে গুরুত্বহীন উপদেষ্টা কাউন্সিলে।
তা সত্ত্বেও তোফায়েলের অপরিসীম ধৈর্য ও রাজনীতিতে পরিপক্বতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর বন্ধন অটুট রেখেছিল। যদিও এসব নিয়ে হয়তোবা তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অভিমান থেকে থাকবে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত যখন তাঁকে অধুনা মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় কী বা কোন ফ্যাক্টর কাজ করেছিল তা শুধু তাঁরই জানার কথা। বাকিদের জন্য তা শুধু অনুমানের ব্যাপার এবং সর্বতোভাবে পরিতাজ্য। লক্ষণীয় যে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতের একজন নেতাকে দেওয়া হলো শিল্প মন্ত্রণালয়, যার গুরুত্ব শিল্পায়নে বিনিয়োগের ভাটায় প্রায় বিলুপ্ত।
একইভাবে শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদেরও অযথা অনুসন্ধিৎসা থেকে অব্যাহতি পাওয়া উচিত। রাজনীতিকদেরও ব্যক্তিজীবন থাকে। আবার দৃশ্যপট পরিবর্তনে একজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়ও অভিনব কিছু ঘটতে পারে। আমার ধারণায় শেখ হাসিনার ক্ষমতার সঞ্চালনে মন্ত্রিসভার এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনই শেষ অনুঘটন নয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এতে কার হার বা জিত হলো, তাও বলার সময় এখনো আসেনি। দেশের সর্বোপরি দৃশ্যপটে কার কী অবস্থান হতে যাচ্ছে, তার বিচারে আগামী এক বছরই হবে অত্যন্ত ক্রুসিয়াল (crucial)।
তবে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভালো করতেন পুরনো মন্ত্রিসভাই জিইয়ে রেখে তাঁর মনোভাবে (attitude) পরিবর্তন এনে। যদি তাঁর পুরনো টিমে সাফল্য না এসে থাকে, এই কসমেটিক পরিবর্তনে কি তা আসতে পারবে? সব চেয়ে বড় কথা, দেশময় যে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের দানবের উত্থানের রব উঠেছে, তাকে স্বীকৃতি দিয়েই এই দানবের টুঁটি টিপে ধরতে হবে। এটাকে দিয়ে ওটাকে ঢাকা, একজনকে দিয়ে অন্যজনের কীর্তি-কাহিনী ভূলিয়ে দেওয়ার কৌশল এবং ছলচাতুরীর রাজনীতিতে সামান্য অর্জিত হবে। রাজনীতির বিশোধন আসবে না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
আলোচনার ঝড়ও উঠেছে বিশেষ করে প্রবীণ ও একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যানকে ঘিরে। তোফায়েল আওয়ামী লীগে কোনো 'বসন্তের কোকিল' নন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক, গত মেয়াদে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ইত্যাদি অভিধায় বিভূষিত এই আওয়ামী লীগ নেতাকে যেনতেনভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই তাঁকে নিয়ে বা তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এত কৌতূহল। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে তাঁকে ঘিরে ইতি ও নেতিবাচক বিতর্ক। আবার দলের বিপদহরণ কাণ্ডারি রূপে সর্বত্রই তাঁর ত্রাতার ভূমিকায় উপস্থিতি। নিজ এলাকায় নন, কাপাসিয়ায়ও মর্যাদার লড়াইয়ে এতজনের মধ্যেও তাঁরই ডাক পড়ে।
আমি নিজে এই নেতাকে কমবেশি চিনি এবং তাঁর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় (Interaction) লিপ্ত হয়েছি। তাঁকে একজন নিশ্চয়াত্মক (assertive) রাজনীতিকই মনে হয়েছে, যদিও বিগত এক-এগারোর দুঃসময়ে তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর দলে সংস্কারের পক্ষে শনাক্ত করা হয়েছিল। অপর তিনজন সংস্কারবাদী আওয়ামী নেতার সঙ্গে কী সংস্কার তিনি তাঁর দলে চেয়েছিলেন, তা কখনো না বুঝলেও অপর অনেকের মতো প্রধান দুটি দলের নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, তহবিল ব্যবস্থাপনা ও দল পরিচালনার স্টাইল ইত্যাদিতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে মনে হতো।
তবে সংস্কারবাদী হয়েও তোফায়েলের রাজনৈতিক আচরণ ও উচ্চারণে যথেষ্টই সংযম ছিল এবং ওই সব দুর্দিনে দলকে এক খণ্ডে রাখতে অন্যদেরসহ তোফায়েলের অবদান ছিল। অথচ দলের বিগত কাউন্সিলে বা তার আগে এই মেয়াদের মন্ত্রিসভা গঠনে আমরা তাঁকে শুধু সাইডলাইনে দেখলাম। মন্ত্রী নির্বাচনে হয়তো প্রধান নির্বাহীর অনেক বিবেচনার বিষয় থাকে। কিন্তু দলেও তিনি কোনো সম্মানজনক আসন পেলেন না। দলের নীতিনির্ধারণী কোনো কমিটি বা সংস্থা নয়, তার স্থান হলো একেবারে গুরুত্বহীন উপদেষ্টা কাউন্সিলে।
তা সত্ত্বেও তোফায়েলের অপরিসীম ধৈর্য ও রাজনীতিতে পরিপক্বতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর বন্ধন অটুট রেখেছিল। যদিও এসব নিয়ে হয়তোবা তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অভিমান থেকে থাকবে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত যখন তাঁকে অধুনা মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় কী বা কোন ফ্যাক্টর কাজ করেছিল তা শুধু তাঁরই জানার কথা। বাকিদের জন্য তা শুধু অনুমানের ব্যাপার এবং সর্বতোভাবে পরিতাজ্য। লক্ষণীয় যে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতের একজন নেতাকে দেওয়া হলো শিল্প মন্ত্রণালয়, যার গুরুত্ব শিল্পায়নে বিনিয়োগের ভাটায় প্রায় বিলুপ্ত।
একইভাবে শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদেরও অযথা অনুসন্ধিৎসা থেকে অব্যাহতি পাওয়া উচিত। রাজনীতিকদেরও ব্যক্তিজীবন থাকে। আবার দৃশ্যপট পরিবর্তনে একজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়ও অভিনব কিছু ঘটতে পারে। আমার ধারণায় শেখ হাসিনার ক্ষমতার সঞ্চালনে মন্ত্রিসভার এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনই শেষ অনুঘটন নয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এতে কার হার বা জিত হলো, তাও বলার সময় এখনো আসেনি। দেশের সর্বোপরি দৃশ্যপটে কার কী অবস্থান হতে যাচ্ছে, তার বিচারে আগামী এক বছরই হবে অত্যন্ত ক্রুসিয়াল (crucial)।
তবে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভালো করতেন পুরনো মন্ত্রিসভাই জিইয়ে রেখে তাঁর মনোভাবে (attitude) পরিবর্তন এনে। যদি তাঁর পুরনো টিমে সাফল্য না এসে থাকে, এই কসমেটিক পরিবর্তনে কি তা আসতে পারবে? সব চেয়ে বড় কথা, দেশময় যে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের দানবের উত্থানের রব উঠেছে, তাকে স্বীকৃতি দিয়েই এই দানবের টুঁটি টিপে ধরতে হবে। এটাকে দিয়ে ওটাকে ঢাকা, একজনকে দিয়ে অন্যজনের কীর্তি-কাহিনী ভূলিয়ে দেওয়ার কৌশল এবং ছলচাতুরীর রাজনীতিতে সামান্য অর্জিত হবে। রাজনীতির বিশোধন আসবে না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments