জঙ্গীবাদের আধুনিক ধারা চালু করতেই হিযবুত তাহ্্রীর গঠিত হয়েছিল- গোলাম মাওলা ৫ দিনের রিমান্ডে

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের আধুনিক ধারা চালু করতেই হিযবুত তাহ্রীর গঠন করা হয়েছিল। দলটি গঠনের মূল রূপকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। জঙ্গীবাদের আধুনিক ধারা অটুট রাখতেই দলে সম্পৃক্ত করা হয় আধুনিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের।


দলটি গঠনের পেছনে মদদ যুগিয়েছে বিশেষ একটি ইসলামী দলের কয়েক শীর্ষ নেতা। রাজধানীর কূটনীতিক পাড়ায় বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে এক সহযোগীসহ গোলাম মাওলাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে আমেরিকায় হযরত মুহম্মদ (স) কে কটাক্ষ করে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ফ্রান্সে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করার প্রতিবাদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতীকী কফিন এবং আমেরিকা ও ফ্রান্সের পতাকা পোড়ায় হিযবুত তাহ্রীরসহ কতিপয় ইসলামী ও সমমনা দল। সেই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে একের পর সংঘর্ষসহ নানা ধরনের কর্মকা- চলছে। সর্বশেষ সোমবার রাজধানীর গুলশানে বাংলাদেশে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকালে মাকসুদুর রহমান নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। মাকসুদ নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য বলে স্বীকার করে। মাকসুদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জানায়, কূটনীতিক পাড়ায় বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা রয়েছে। এমন পরিকল্পনার সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীর গঠনের রূপকার গোলাম মাওলা জড়িত।
আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের আগেই দুপুরে গোলাম মাওলার আইনজীবী মনসুর হাবীবের হাইকোর্ট চেম্বারে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন গোলাম মাওলার স্ত্রী শাহীদা আহমেদ। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে গুম করা হয়েছে। এমন অভিযোগের পর সোমবার রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান অধ্যাপক গোলাম মাওলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানান। তিনি আরও জানান, সোমবার বাংলাদেশে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকালে এক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই বিক্ষোভকারী জানায়, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর ওই বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভের মূল মদদদাতা অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই গোলাম মাওলাকে সোমবার বিকেলে গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, গোলাম মাওলাকে কূটনীতিক পাড়ায় নাশকতার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাঁর সহযোগীসহ ঢাকার সিএমএম আদালতে সোর্পদ করা হয়। আদালতে সোর্পদ করে প্রত্যেককে ১০ দিনের করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। বিচারক মোঃ মুনিরুজ্জামান দুজনকে ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নব্বই দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। পরে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেন। ব্রিটেনে থাকাকালে তিনি হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িত হন। জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গোলাম মাওলার ওপর অস্বাভাবিক নজরদারি শুরু করে। এতে বিপাকে পড়েন তিনি। শেষপর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে তিনি দেশে ফিরে পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক হিসেবেই আবার যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি হিযবুত তাহ্রীরের বাংলাদেশ শাখা চালুর উদ্যোগ নেন। তার এমন উদ্যোগে মদদ যোগায় এদেশের বিশেষ একটি বির্তকিত ইসলামী দল। দলটির কয়েক শীর্ষ নেতার মদদে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক এ জঙ্গী সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখা গঠনে রীতিমতো তোড়জোড় শুরু হয়। গোলাম মাওলার ডাকে সাড়া দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-এর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রভাবশালী এনজিওর সিস্টেম এনালিস্ট শেখ তৌফিক। (পরবর্তীতে তিনি বিদেশ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে বাংলাদেশের বনানীস্থ বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান দেন)।
২০০২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ওই এনজিওটির উত্তরা কার্যালয়ে অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র, কাজী মোরশেদুল হককে যুগ্ম সমন্বয়কারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলাকে জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ তৌফিককে রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদকে গণসংযোগ সচিব, অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজকে মিডিয়া ও প্রচার সচিব এবং সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনসারী, আহাম্মদ জামান, ডা. সাঈদ, মনির হোসেন, ডা. গোলাম মোস্তফা ও শাহজালাল মিয়াকে কার্যকরী সদস্য করে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোল টেবিল বৈঠকে বাংলাদেশে হিযবুত তাহ্রীরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। একমাস পর মার্চ থেকেই হিযবুত তাহ্রীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রবিরোধী এবং জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার দায়ে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১০ সালের ২ মার্চ রাজধানীর উত্তরা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোক্তারুজ্জামান সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯-এ গোলাম মাওলাসহ হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর ২০১০ সালের ১৯ মার্চ হিযবুত তাহ্রীরের প্রধান সমন্বরয়কারী ও মুখপাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর একই বছর ৮ জুন দলটির বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৩ সালে পূর্ব জেরুজালেমের সাবেক বিচারক তাকিউদ্দিন আল-নাবানী হিযবুত তাহ্রীর গঠন করেন। একপর্যায়ে জেরুজালেমের শেখ হাজী আমিন আল হোসাইনীর উগ্র মতবাদ দ্বারা সংগঠনটি প্রভাবিত হয়ে পড়ে। মুফতী হোসাইনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের সহযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে হিযবুত তাহ্রীর বিশ্বে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ২০০২ সালে ডেনমার্কে ইহুদি দেখামাত্র হত্যার ঘোষণা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করে সংগঠনটি। ২০০৩ সালে তেলআবিবে এক মদের দোকানে বোমা হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানের মার্কিন ও ইসরায়েলী দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৪ সালে তাজিকিস্তানের তাসখন্দ এলাকায় বোমা হামলা করে ৪৭ জনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার জন্য হিযবুত তাহ্রীরকে দায়ী করা হয়। এমনকি আল কায়দা, তালেবান ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য কর্মী সংগ্রহের কাজের সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীর জড়িত বলে আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোগ ওঠে। রাষ্ট্রবিরোধী এবং জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার দায়ে ২০০৮ সালে পাকিস্তানে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধশতকের বেশি দেশে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.