নদী দিবস-সভ্যতার জন্মদাত্রী by খন্দকার মাহমুদুল হাসান
নদীর সঙ্গে বাঙালির যুগ-যুগান্তরের সখ্যের পরিচয় মেলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- আমার যেতে ইচ্ছে করে/নদীটির ঐ পারে-/যেথায় ধারে ধারে/বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো/বাঁধা সারে সারে। তবে শুধু বাংলাদেশের নয়, নদী বিশ্বসভ্যতারও জন্মদাত্রী।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো দুই নগরসভ্যতা অর্থাৎ পুণ্ড্রনগর (বগুড়ার মহাস্থান) ও উয়ারী-বটেশ্বর (নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলায়) যথাক্রমে করতোয়া ও ব্রহ্মপুত্রকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল। তবে সেই করতোয়া এবং সেই ব্রহ্মপুত্র আর নেই। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের বর্ষণসৃষ্ট প্রলয়ংকরী ঢলের তোড়ে তিস্তার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলে নতুন মস্ত নদী যমুনা সৃষ্টির পর তিস্তা থেকে উৎসারিত আত্রাই-করতোয়া-যমুনেশ্বরী পরিণত হয়েছে মরা নদীতে। ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা এরপর তার পুরনো গতিপথের বদলে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ধারা যমুনায় প্রবাহিত হয়েছে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বতন যে গতিপথের ধারে উয়ারী-বটেশ্বর গড়ে উঠেছিল, সেটিও আজ জৌলুশহীন। তবে ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর শীর্ষ দীর্ঘ নদীগুলোর একটি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার। অবশ্য আফ্রিকার নীলনদ (ছয় হাজার ৬৮৮ কিলোমিটার) ও দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের (ছয় হাজার ৪৪৭ কিলোমিটার) তুলনায় তা কম। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির জল ধারণকারী একটি নদী হলো আমাদের মেঘনা। আমাজন ছাড়া এত বৃষ্টির জল আর তেমন কোনো নদী ধারণ করে না। ৬৬৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেঘনা হলো দেশের দীর্ঘতম নদী।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, কপোতাক্ষ, ডাকাতিয়া, বুড়িগঙ্গা, আড়িয়াল খাঁ, তিস্তা, ফেনী নদী, কুশিয়ারা, সুরমা, মাতামুহুরী, মাথাভাঙা, করতোয়া, ভৈরব, ভদ্রা, ঘাঘট, সাঙ্গু, দুধকুমার, গড়াই, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, রায়মঙ্গল প্রভৃতি নদীর জাল বাংলাদেশের মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো, আড়িয়াল খাঁ ও দাউদখালীর মতো হাতেগোনা কিছু নদ-নদী ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নদীর নাম ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, যমুনার মতো দেব-দেবীর নাম অথবা সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংশ্লিষ্ট। লোক-ঐতিহ্যের বিশেষ প্রভাবশালী ধর্মমতের গুরুত্ব এতে বোঝা যায়।
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গা নদীকে অবলম্বন করে। গোটা বাংলাদেশে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই শহরটি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, তবে এর প্রকৃত খ্যাতির সূচনা হয়েছিল বাংলার রাজধানী হওয়ার (১৬০৮-১৬১০ খ্রিস্টাব্দ) পর। অবশ্য ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের বর্ণনাসমৃদ্ধ মির্জা নাথনের লেখা আকরগ্রন্থ 'বাহারিস্থান-ই-গায়বি'-তে বুড়িগঙ্গার নাম নেই, বরং দুলাই নদীর নাম আছে। ড. আহমদ হাসান দানি অনুমান করেছেন, বুড়িগঙ্গার সাবেক নাম দুলাই। যমুনা নদী সৃষ্টি হওয়ার আগে তৈরি করা রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী পাবনা জেলার দক্ষিণ প্রান্তস্পর্শী পদ্মা থেকে জাফরগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরী নামে যে শাখাটি বেরিয়েছিল, তা থেকে পথপরিক্রমায় বুড়িগঙ্গার সৃষ্টি। যে নদী আমাদের সভ্যতা উপহার দিয়েছে, আমরা সেই নদীকে উপহার দিচ্ছি মৃত্যু!
খন্দকার মাহমুদুল হাসান
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, কপোতাক্ষ, ডাকাতিয়া, বুড়িগঙ্গা, আড়িয়াল খাঁ, তিস্তা, ফেনী নদী, কুশিয়ারা, সুরমা, মাতামুহুরী, মাথাভাঙা, করতোয়া, ভৈরব, ভদ্রা, ঘাঘট, সাঙ্গু, দুধকুমার, গড়াই, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, রায়মঙ্গল প্রভৃতি নদীর জাল বাংলাদেশের মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো, আড়িয়াল খাঁ ও দাউদখালীর মতো হাতেগোনা কিছু নদ-নদী ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নদীর নাম ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, যমুনার মতো দেব-দেবীর নাম অথবা সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংশ্লিষ্ট। লোক-ঐতিহ্যের বিশেষ প্রভাবশালী ধর্মমতের গুরুত্ব এতে বোঝা যায়।
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গা নদীকে অবলম্বন করে। গোটা বাংলাদেশে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই শহরটি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, তবে এর প্রকৃত খ্যাতির সূচনা হয়েছিল বাংলার রাজধানী হওয়ার (১৬০৮-১৬১০ খ্রিস্টাব্দ) পর। অবশ্য ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের বর্ণনাসমৃদ্ধ মির্জা নাথনের লেখা আকরগ্রন্থ 'বাহারিস্থান-ই-গায়বি'-তে বুড়িগঙ্গার নাম নেই, বরং দুলাই নদীর নাম আছে। ড. আহমদ হাসান দানি অনুমান করেছেন, বুড়িগঙ্গার সাবেক নাম দুলাই। যমুনা নদী সৃষ্টি হওয়ার আগে তৈরি করা রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী পাবনা জেলার দক্ষিণ প্রান্তস্পর্শী পদ্মা থেকে জাফরগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরী নামে যে শাখাটি বেরিয়েছিল, তা থেকে পথপরিক্রমায় বুড়িগঙ্গার সৃষ্টি। যে নদী আমাদের সভ্যতা উপহার দিয়েছে, আমরা সেই নদীকে উপহার দিচ্ছি মৃত্যু!
খন্দকার মাহমুদুল হাসান
No comments