নির্বাচনকালীন সরকার-আগডালে বসে গোড়া যেন না কাটি by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে বিদায়ী এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ চারজন বিচারক একমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দু'জন বিচারপতি তেমনটা মনে করেন না।
একজন বিচারপতি বিষয়টি সংসদে ফয়সালার কথা বলেছেন। এ ধরনের সূক্ষ্ম ও জটিল প্রশ্নে বিভক্ত রায় স্বাভাবিক। বিদেশেও বিভক্ত রায়ের নজির বেশ রয়েছে। অধিকসংখ্যক বিচারপতির মতই কোর্টের মতামত এবং আইনত গ্রহণযোগ্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাংলাদেশে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এটাই সুপ্রিম কোর্টের রায় হিসেবে বিবেচিত হবে। সাংঘর্ষিক বিধায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো আইনবহির্ভূত বিবেচিত হয়েছে এবং কোর্ট তা মার্জনা করেছে। সেই সঙ্গে কোর্ট ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা বাস্তবতাও বিবেচনায় রেখেছে। তদনুযায়ী পরবর্তী সর্বোচ্চ দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালনা করার ব্যবস্থাকে সংসদের অনুমোদনসাপেক্ষে কোর্ট সম্মতি দিয়েছে। অধিকাংশ এমিকাস কিউরি 'বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে' তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থন করেছিলেন। কোর্ট এমিকাস কিউরিদের মতামতের প্রতি সুবিবেচনা দিয়েছেন।
রায় প্রকাশের পর সুশীল সমাজের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে কীভাবে আইনসম্মত হবে? অর্থাৎ রায়ের এক অংশ অপর অংশের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক কি-না ? না, তা নয়। কারণ রায়ে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে সেটাও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই হবে অর্থাৎ আইনসঙ্গত হবে না। সে কারণে রায়ে আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য আগাম মার্জনা প্রদান করা হয়েছে।
এমিকাস কিউরিদের মতামতে যে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে, তার বাস্তবতা অর্থাৎ ডকট্রিন অব নেসেসিটি কোর্ট আমলে নিয়েছেন এবং বাস্তবতার প্রয়োজনে বিচ্যুতি অগ্রিম মার্জনা করেছেন। তাই বর্তমান রায় আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এমনকি বিগত তিনটি নির্বাচন যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল, সে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সংসদ সম্মতি প্রদান করলে সেটাও হতে পারবে। রায় কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়ে রায়ে পটভূমিসহ বলা হয়েছে, "সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরিগণ কোন না কোন আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। যদিও তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ, তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন খধঃরহ গধীরস যেমন 'ঞযধঃ যিরপয ড়ঃযবৎরিংব রং হড়ঃ ষধভিঁষ, হবপবংংরঃু সধশবং ষধভিঁষ'; 'ঝধভবঃু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব রং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ষধ'ি এবং 'ঝধভবঃু ড়ভ ঃযব ংঃধঃব রং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ষধ'ি_ ইহার সহায়তা লইতে হইল। উপরোক্ত নীতিসমূহের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র দুইটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি থাকিবে না, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে। ... এইরূপ অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে উপরোক্ত সহস্র বৎসরের পুরাতন ল্যাটিন ম্যাক্সিম প্রয়োগকরতঃ তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬ অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও আগামী দশম ও একাদশ সর্বোচ্চ এই দুইটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।"
উপরোক্ত যুক্তি ও রায়ের প্রতি সঙ্গতি বজায় রেখে রায়ের ৪৪(১৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বৎসর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (পড়হফড়হব) করা হইল।'
রায়ের ভাষা ও যুক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করেছেন, ব্যবস্থাটি সংবিধানের আলোকে বাতিলযোগ্য মনে করেছেন এবং বাতিল করেছেন। তবে এমিকাস কিউরিদের উদ্বেগ ও বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে বিগত নির্বাচনগুলোকে যেমন মার্জনা প্রদান করেছেন, তেমনি আগামী সর্বাধিক দুটি নির্বাচনের জন্যও মার্জনা উন্মুক্ত রেখেছেন, যদি জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান অনুমোদন করে। রায়ের মধ্যে কোনো সংঘাত বা দ্বান্দ্বিকতা দৃষ্ট হচ্ছে না। সুবিবেচনাই ফুটে উঠেছে।
রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নটি আলোচনার টেবিলে যাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনার ভিত্তিতে যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতা সৃষ্টি হয়, সেই ব্যবস্থাটি সংসদে পাস করিয়ে নিলে, আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য তা মার্জনা পাবে এবং আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে। রায়টি তো বিরোধী দলের দাবির বিপক্ষে যাচ্ছে না।
বিরোধী দলের মাননীয় নেত্রী রায়টিকে 'খায়রুল হকের রায়' উল্লেখ করে তা 'প্রত্যাখ্যান' করেছেন। আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে রিভিউ আবেদন করা যায়। প্রত্যাখ্যান করার অবকাশ আছে কি? তাছাড়া এটাকে 'খায়রুল হকের রায়' বলে আখ্যায়িত করা কি যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত বা শালীন? খায়রুল হক একজন ব্যক্তি। কিন্তু রায়টি সুপ্রিম কোর্ট ফুল বেঞ্চের, যেখানে সাতজন বিচারপতি ছিলেন। জাস্টিস খায়রুল হক তাদের একজন। তিনিসহ চারজন বিচারপতি সরাসরি রায়ের পক্ষে। একজন সরাসরি না হলেও এ প্রশ্নে জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তের পক্ষে। মূল রায়েও জাতীয় সংসদের বিবেচনাসাপেক্ষে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অনুষ্ঠানের অনুমতি রয়েছে। অতএব, পাঁচজন বিচারপতির সিদ্ধান্ত কার্যত এক। বাকি দু'জন ভিন্নমত রেখেছেন। এ পরিস্থিতিতে একজন জাতীয় নেত্রীর বক্তব্যটিকে কি ব্যক্তি-আক্রোশমূলক এবং শালীনতাবর্জিত বলা যায় না? সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রের তিনটি মূল স্তম্ভের একটি। এটিকে আঘাত করার পরিণতি কী হতে পারে, তা রাষ্ট্রের মালিক নাগরিকরা ভেবে আতঙ্কিত হবেন।
রায়ের সমালোচনা করা যায়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করা যায়। কিন্তু যে তিনটি স্তম্ভ বা খুঁটির ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে, তার কোনোটিকে আঘাত করে দুর্বল করে ফেললে, রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে যায়। আক্রমণকারী দল ক্ষমতায় গেলে, তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের দুর্বল ক্ষমতাভোগী হবেন। গণতন্ত্র সংহত করতে হলে, রাষ্ট্রের ইনস্টিটিউশনগুলো সংহত ও শক্তিশালী করা হয়। আঘাত নয়, পরিচর্যা করা প্রয়োজন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ২০ সেপ্টেম্বর আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, 'বিচার বিভাগ স্বাধীন। বাহবা পাওয়ার জন্য নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দেয়া হয়েছে' (সমকাল, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২)। তার বক্তব্য থেকে সুপ্রিম কোর্টের সার্বিক অবস্থান ফুটে উঠেছে। এটি কোনো ব্যক্তির রায় নয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়। আমরা যেন গাছের আগডালে বসে ডালটির গোড়ায় কুঠারাঘাত না করি।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
রায় প্রকাশের পর সুশীল সমাজের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে কীভাবে আইনসম্মত হবে? অর্থাৎ রায়ের এক অংশ অপর অংশের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক কি-না ? না, তা নয়। কারণ রায়ে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে সেটাও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই হবে অর্থাৎ আইনসঙ্গত হবে না। সে কারণে রায়ে আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য আগাম মার্জনা প্রদান করা হয়েছে।
এমিকাস কিউরিদের মতামতে যে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে, তার বাস্তবতা অর্থাৎ ডকট্রিন অব নেসেসিটি কোর্ট আমলে নিয়েছেন এবং বাস্তবতার প্রয়োজনে বিচ্যুতি অগ্রিম মার্জনা করেছেন। তাই বর্তমান রায় আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এমনকি বিগত তিনটি নির্বাচন যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল, সে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সংসদ সম্মতি প্রদান করলে সেটাও হতে পারবে। রায় কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়ে রায়ে পটভূমিসহ বলা হয়েছে, "সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরিগণ কোন না কোন আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। যদিও তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ, তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন খধঃরহ গধীরস যেমন 'ঞযধঃ যিরপয ড়ঃযবৎরিংব রং হড়ঃ ষধভিঁষ, হবপবংংরঃু সধশবং ষধভিঁষ'; 'ঝধভবঃু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব রং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ষধ'ি এবং 'ঝধভবঃু ড়ভ ঃযব ংঃধঃব রং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ষধ'ি_ ইহার সহায়তা লইতে হইল। উপরোক্ত নীতিসমূহের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র দুইটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি থাকিবে না, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে। ... এইরূপ অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে উপরোক্ত সহস্র বৎসরের পুরাতন ল্যাটিন ম্যাক্সিম প্রয়োগকরতঃ তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬ অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও আগামী দশম ও একাদশ সর্বোচ্চ এই দুইটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।"
উপরোক্ত যুক্তি ও রায়ের প্রতি সঙ্গতি বজায় রেখে রায়ের ৪৪(১৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বৎসর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (পড়হফড়হব) করা হইল।'
রায়ের ভাষা ও যুক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করেছেন, ব্যবস্থাটি সংবিধানের আলোকে বাতিলযোগ্য মনে করেছেন এবং বাতিল করেছেন। তবে এমিকাস কিউরিদের উদ্বেগ ও বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে বিগত নির্বাচনগুলোকে যেমন মার্জনা প্রদান করেছেন, তেমনি আগামী সর্বাধিক দুটি নির্বাচনের জন্যও মার্জনা উন্মুক্ত রেখেছেন, যদি জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান অনুমোদন করে। রায়ের মধ্যে কোনো সংঘাত বা দ্বান্দ্বিকতা দৃষ্ট হচ্ছে না। সুবিবেচনাই ফুটে উঠেছে।
রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নটি আলোচনার টেবিলে যাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনার ভিত্তিতে যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতা সৃষ্টি হয়, সেই ব্যবস্থাটি সংসদে পাস করিয়ে নিলে, আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য তা মার্জনা পাবে এবং আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে। রায়টি তো বিরোধী দলের দাবির বিপক্ষে যাচ্ছে না।
বিরোধী দলের মাননীয় নেত্রী রায়টিকে 'খায়রুল হকের রায়' উল্লেখ করে তা 'প্রত্যাখ্যান' করেছেন। আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে রিভিউ আবেদন করা যায়। প্রত্যাখ্যান করার অবকাশ আছে কি? তাছাড়া এটাকে 'খায়রুল হকের রায়' বলে আখ্যায়িত করা কি যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত বা শালীন? খায়রুল হক একজন ব্যক্তি। কিন্তু রায়টি সুপ্রিম কোর্ট ফুল বেঞ্চের, যেখানে সাতজন বিচারপতি ছিলেন। জাস্টিস খায়রুল হক তাদের একজন। তিনিসহ চারজন বিচারপতি সরাসরি রায়ের পক্ষে। একজন সরাসরি না হলেও এ প্রশ্নে জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তের পক্ষে। মূল রায়েও জাতীয় সংসদের বিবেচনাসাপেক্ষে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অনুষ্ঠানের অনুমতি রয়েছে। অতএব, পাঁচজন বিচারপতির সিদ্ধান্ত কার্যত এক। বাকি দু'জন ভিন্নমত রেখেছেন। এ পরিস্থিতিতে একজন জাতীয় নেত্রীর বক্তব্যটিকে কি ব্যক্তি-আক্রোশমূলক এবং শালীনতাবর্জিত বলা যায় না? সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রের তিনটি মূল স্তম্ভের একটি। এটিকে আঘাত করার পরিণতি কী হতে পারে, তা রাষ্ট্রের মালিক নাগরিকরা ভেবে আতঙ্কিত হবেন।
রায়ের সমালোচনা করা যায়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করা যায়। কিন্তু যে তিনটি স্তম্ভ বা খুঁটির ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে, তার কোনোটিকে আঘাত করে দুর্বল করে ফেললে, রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে যায়। আক্রমণকারী দল ক্ষমতায় গেলে, তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের দুর্বল ক্ষমতাভোগী হবেন। গণতন্ত্র সংহত করতে হলে, রাষ্ট্রের ইনস্টিটিউশনগুলো সংহত ও শক্তিশালী করা হয়। আঘাত নয়, পরিচর্যা করা প্রয়োজন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ২০ সেপ্টেম্বর আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, 'বিচার বিভাগ স্বাধীন। বাহবা পাওয়ার জন্য নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দেয়া হয়েছে' (সমকাল, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২)। তার বক্তব্য থেকে সুপ্রিম কোর্টের সার্বিক অবস্থান ফুটে উঠেছে। এটি কোনো ব্যক্তির রায় নয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়। আমরা যেন গাছের আগডালে বসে ডালটির গোড়ায় কুঠারাঘাত না করি।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
No comments