বিশ্বব্যাংকের পদ্মায় ফেরা ॥ তৈরি হচ্ছে নতুন চুক্তির টার্ম অব রেফারেন্স- ০ দাতা প্রতিনিধি দল আসছে ১ অক্টোবর- ০ ফিরেছে জাইকা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে আশাবাদ by হামিদ-উজ-জামান মামুন

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে শর্ত মেনে নেয়ার আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার। শীঘ্রই চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি টার্ম অব রেফারেন্স তৈরির কাজ শুরু করেছে। সেখানে সংস্থাটির দেয়া সব শর্ত প্রতিপালন করা, যে কোন পরিস্থিতিতে দাতাদের সঙ্গে আলোচনা,


বাতিল হওয়া পুরনো চুক্তি পুনর্বহাল অথবা নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর এবং যে কোন মূল্যে এ প্রকল্পটিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা হবে বলে অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। এতে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করবেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন। তাছাড়া আগামী ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে বলেও জানা গেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে প্রকল্পটির অন্যতম দাতা জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। মঙ্গলবার পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ ধরনের আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
জাইকা তাদের বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফেরার ঘোষণা দেয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বলেছে একটি উল্লেখযোগ্য সময় নষ্ট হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সব অংশীদারের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়া যাবে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণায় আমরা আনন্দিত। একই সঙ্গে এই সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান এবং দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত সন্তোষজনকভাবে পূরণ করার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার প্রশংসা করছে জাইকা।
সংস্থাটি দাবি করেছে, বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ২০০৩ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে জাইকা যখন প্রথম পদক্ষেপ নেয়, তখন থেকেই অন্য সহযোগী দাতা সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সেতু, পাকশী সেতু, মেঘনা সেতু, গোমতী ও রূপসা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাইকার উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্বের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মানুষের বহু প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু নির্মাণেও জাইকার সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ চালিয়ে যাবে এবং পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে বিবৃতিতে।
এর আগে ঋণ চুক্তি বাড়ানোর বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) চিঠি দিয়েছে। সেখানে ঋণ চুক্তির মেয়াদ আরও নয় মাস বাড়ায় সংস্থাটি। ২৯৭ কোটি ডলারের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে জাইকা ঋণ দেবে ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার থেকে এই টার্ম অব রেফারেন্স তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। শীঘ্রই এটি তৈরির কাজ শেষ হবে।
প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার বিষয়ে এর আগে গত রবিবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির তদন্ত একই সঙ্গে চলবে। সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সহÑঅর্থায়নকারীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার প্রতিনিধিবৃন্দ ওয়াশিংটন, ম্যানিলা ও টোকিও থেকে অচিরেই ঢাকা আসবেন এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত ও প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তব কৌশল নির্ধারণ করবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা এখনও বিশ্বব্যাংকের চিঠি পাইনি। তাই পরিষ্কার করে কিছু বলতে না পারলেও ধারণা করা হচ্ছে অর্থায়নকারীদের মিশন দুরকমের হতে পারে। একটি হয়ত দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে কাজ করবে। অন্যটি কত দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সরকারকে চারটি শর্ত দিয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে, প্রথমত দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠনের প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত, একটি বিকল্প প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ থাকবে। তৃতীয়ত, দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়া এবং সবশেষে সরকার বাংলাদেশী আইনের আওতায় থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারী দায়িত্ব পালন থেকে সরকারী ব্যক্তিবর্গ (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দিতে হবে। এ চারটি ব্যবস্থার মধ্যে দু’টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন সেতুর জন্য ঋণ সহায়তা বাতিল করেছিল। অবশেষে তাদের চারটি শর্ত মেনে নেয়ায় গত ২১ সেপ্টেম্বর বাতিল ঋণ চুক্তি পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক।
সূত্র জানায়, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি মার্কিন ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, জাইকার ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং আইডিবির ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.