চালচিত্র-রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্য বনাম বাংলাদেশ by শুভ রহমান
আরব মধ্যপ্রাচ্য এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির মধ্যে একটি দিক থেকে তুলনামূলক আলোচনা এখন এ মুহূর্তে রাজনীতিতে আগ্রহীদের কাছে চিত্তাকর্ষক মনে হতে পারে। বস্তুত, আরব মধ্যপ্রাচ্যের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে।
লক্ষণীয় যে, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, মিসর_এ রকম কয়েকটি দেশে যেখানে অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তি ফুঁসে উঠেছে, সেখানে বাংলাদেশে এর অবস্থাটা ঠিক বিপরীত। এখানে জনগণের এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবেই গণধিকৃত ও দীর্ঘকালের দুঃশাসনের সিল-ছাপ্পড় মারা অগণতান্ত্রিক শক্তিই বার বার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। ইতিহাসে সচরাচর এ রকম অবস্থা খুব একটা ঘটে না। ষাটের দশকে কৃষ্ণ আফ্রিকার অনেক দেশেই একের পর এক দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অচলায়তন ভেঙে পড়তে থাকে।
আলজেরিয়ায় দীর্ঘ আট বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ শাসন একরকম উৎখাত হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া (দ. প. আফ্রিকা) থেকে। ইতিহাসের ধারার গতিপথটা এ রকমই। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লবের অভিঘাতে তো বিশ্বজুড়েই জাতীয় ও জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং তৃতীয় বিশ্বের অভ্যুদয়ে যখন একটি বিরাট ভূখণ্ডজুড়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে, তার অভিঘাতে অন্যায়ের শাসন-কর্তৃত্ব বহুদূর পর্যন্ত অপসারিত হতে থাকে। আরব মধ্যপ্রাচ্যে এখন অবস্থাটা সে রকমই। আজকের গণজাগরণের ঢেউ শেষ পর্যন্ত যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কি পরিশেষে কোনো কোনো রাজতন্ত্রের ভিতকেই নাড়িয়ে দেয় কি না, বিশ্বরাজনীতির আগ্রহী পর্যবেক্ষকরা সেদিকেও তাকিয়ে আছেন।
বাংলাদেশে কী হচ্ছে? বাংলাদেশে তো স্বাধীনতার চার দশকে অন্যায় শাসন-শোষণের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে জনগণ এখন একটা দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক শাসনই কামনা করছে। যে কাজ করে, সে ভুলও করে। অগণতান্ত্রিক শাসকরা শুধু যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে, তা-ই নয়, তারা গণতান্ত্রিক শাসকদের মতো পদে পদে ভুল করে এবং ভুলের চূড়ান্ত মাসুলও দেয়। কিন্তু তার পরও জনগণের কল্যাণ সাধনে তারা পুরোপুরি ব্যর্থই হয়। তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সমালোচিত হওয়ার সুযোগও করে দেয় নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই। এখনকার গণতান্ত্রিক মহাজোট শাসকদের অবস্থাটাও হয়েছে অনেকটা একই রকম। তারাও সমালোচিত হচ্ছে পদে পদে। তারা জনগণের জন্য বেশি বেশি কাজ করতে চাইছে বলেই ভুলও করছে আগের অনেক অগণতান্ত্রিক শাসকদের চেয়ে বেশি। সমালোচিতও হচ্ছে বেশি। সুশাসকদের এটাই নিয়তি। সুশাসন বলতে একেবারে নির্ভেজাল গণমুখী শাসন নয়। জনগণের জন্য ভালো-মন্দ মিলিয়েই সুশাসন। তবে সচেতন মানুষের নির্মোহ বিচারে নিশ্চয়ই তার ভেতর মন্দের চেয়ে ভালোর পাল্লাই ভারী হবে।
সচেতন মানুষ নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে বলেই মহাজোট সরকারের গত দুই বছরের শাসনামলে এবারেরটা নিয়ে বিএনপির চতুর্থ দফা হরতালের ডাকেও তারা সাড়া দেয়নি। মানুষ এখন পর্যন্ত বিএনপির পেছনে দৌড়াতে চাইছে না। যদিও স্থানীয় ফ্যাক্টরের দরুন একটি উপনির্বাচন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ পৌরসভা নির্বাচনে তারা জিতেছে, কিন্তু সেটা জাতীয় বিজয়ের কোনো ইয়ার্ডস্টিক নয়। বিএনপির চতুর্থ হরতালেরও দাবিগুলোর পেছনে যুক্তি যেরকমই থাক, মানুষ তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে এখনই হরতালের মতো শেষ অস্ত্র তুলে নেওয়া সঙ্গত মনে করেনি। অন্যদিকে, চতুর্থবার ফ্লপ হরতালের পরও বিএনপি হাইকমান্ড সুস্থ রাজনীতির দিকে পা বাড়াচ্ছে না। সংসদেও যাচ্ছে না। এতে তাদের দলের ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে, বাড়ছে হতাশা এবং নৈরাজ্য। দলের ভেতর অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, এভাবে চললে বিএনপি কোনোদিনই আর ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এভাবেই একটি দলের অপমৃত্যু ঘটে, যেমন এ দেশে অতীতে মুসলিম লীগের ঘটেছিল।
একটি প্রধান জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হরতালের আগেই সঠিক ইস্যু নির্ধারণে ব্যর্থতার জন্য বিএনপির শীর্ষ ও মধ্যস্তরের নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য বিরাজ করছিল। প্রধানমন্ত্রী হরতালের আগেই জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে আড়িয়াল বিলে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। এতেই কার্যত বিএনপির মাঠ গরমের রাজনীতিতে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। এর পরও একরকম গোঁয়ার্তুমি করে দলের মহাসচিব পুরনো সব দাবি, যেমন_নিত্যপণ্যের মূল্য হ্রাস, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ ইত্যাদিকে ইস্যু করেই হরতালের কর্মসূচি আঁকড়ে ধরে থাকেন। দলের একটি অংশ এসব দাবির পরিবর্তে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আর ফেলানীর সীমান্তহত্যার প্রতিবাদেই মাত্র হরতাল ডাকার পক্ষে মত দিয়েছিল। দেখা গেছে, হরতাল ডাকা নিয়েই মতদ্বৈধের কারণে দলের আহ্বানের প্রতি যে নূ্যনতম জনসমর্থন থাকার কথা ছিল, তাও শেষে কর্পূরের মতো উবে যায়। হরতালের দিন ভোরবেলা থেকেই মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, শুধু রিকশা নয়, সব ধরনের যানবাহনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। দোকানপাট, ব্যাংক_সবই যথারীতি চালু হয়ে গেছে। ফ্লপ বলতে এমন মারাত্মক ফ্লপ এর আগে কখনো কোনো হরতালে হয়নি। বিএনপির এতেও চৈতন্যোদয় হচ্ছে না। সেই আগের সহিংসতার সংস্কৃতি দিয়ে হরতালকে গায়ের জোরে সফল করার বর্বর পন্থা গ্রহণ করতে গিয়ে রাজনীতির দিক দিয়ে বিএনপি আরো পিছিয়েই যাচ্ছে। গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে রাজনীতিতে ভ্রূক্ষেপহীনভাবে পিছিয়ে পড়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও শাসকরা ঘটিয়ে চলেছে। ইয়েমেনে একনায়ক সালেহ প্রবল গণদাবি অগ্রাহ্য করে এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। একইভাবে গত মাসে গণবিদ্রোহে তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জাইন এল আবিদিন বেন আলীর সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য পুলিশ অফিসারদের দায়ী করছে মানুষ। তিউনিসিয়াব্যাপী ব্যাপক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আর মিসরে তিন দশক ধরে একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। তাঁর প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার আপস পরিকল্পনা বাতিল করে এ মুহূর্তে ক্ষমতা ত্যাগের দাবিতেই অটল রয়েছেন। জনসমর্থন যখন থাকে না, তখন মিথ্যা আর গোঁয়ার্তুমিই যে রাজনীতির একমাত্র পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়, দুনিয়াভর সব স্বৈর শাসক আর স্বৈরাচারপন্থীর সেটাই একমাত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে টিকে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী শাসকদের মতো এখানকার নিকট-অতীতের দুঃশাসনের নায়কদের মধ্যেও সেই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট এম জে আকবরও মুবারক প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সেই কথাই লিখেছেন। তাঁর 'বাইলাইন' কলামে 'দ্য কলাপ্স অব এ লাই' শীর্ষক নিবন্ধে মুবারক প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন_'একনায়কত্ব হচ্ছে এলিটদের মধ্যকার একটি বন্দোবস্ত। তারা হোসনি মুবারক যা করছেন, একটি লটারির খেলা দিয়েই শুরু করেন। আনোয়ার সাদতকে যদি একটি প্যারেডে আততায়ীর হাতে নিহত হতে না হতো, তাহলে তাঁর পরিণতি হতো এক অখ্যাত জেনারেলের মতো বিস্মৃতির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া।
আনোয়ার সাদতের ওইভাবে নিহত হওয়ার পর থেকে কুচকাওয়াজে সৈন্যদের আর তাজা গোলাবারুদ নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। এতে কলম্বো সফরের সময় রাজীব গান্ধীর জীবন রক্ষা পায়। তবে তাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ইউনিফর্মধারী সবাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছিল। এম জে আকবর লিখেছেন : 'মুবারক মিথ্যা দিয়ে তাঁর শাসন শুরু করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি গণতন্ত্র দেবেন। আর পেছন থেকে তিনি এমনসব কলকাঠি নাড়েন এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার বদৌলতে তিন দশক ক্ষমতায় থেকে যান। সেপ্টেম্বরে নীরবে বিদায় নেবেন_এখন তিনি আবার এমন একটি মিথ্যাই তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন।'
আমাদের এখানে মিথ্যার বেসাতি করে জোট সরকার দুটি টার্ম ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পর স্বখাত সলিলে তথা সেনাসমর্থিত এক/এগারোর সরকারের রোষানলে পড়ে এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর গণরোষে ক্ষমতা হারায়। আজ আবার নিজেদের অতীত ভুলে মইনুল রোডের বাড়ির এপিসোডসহ অজস্র মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নিষ্ফল হরতাল, বিক্ষোভ ইত্যাকার কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাস এবং আজকের আরব মধ্যপ্রাচ্যের অগি্নগর্ভ পরিস্থিতি থেকে তাকে শিক্ষা নিতে হবে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে এবং জনগণের আস্থা পুনঃঅর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চাইলে এ ছাড়া তার সামনে কোনো বিকল্প নেই।
০৮.০২.২০১১
আলজেরিয়ায় দীর্ঘ আট বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ শাসন একরকম উৎখাত হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া (দ. প. আফ্রিকা) থেকে। ইতিহাসের ধারার গতিপথটা এ রকমই। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লবের অভিঘাতে তো বিশ্বজুড়েই জাতীয় ও জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং তৃতীয় বিশ্বের অভ্যুদয়ে যখন একটি বিরাট ভূখণ্ডজুড়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে, তার অভিঘাতে অন্যায়ের শাসন-কর্তৃত্ব বহুদূর পর্যন্ত অপসারিত হতে থাকে। আরব মধ্যপ্রাচ্যে এখন অবস্থাটা সে রকমই। আজকের গণজাগরণের ঢেউ শেষ পর্যন্ত যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কি পরিশেষে কোনো কোনো রাজতন্ত্রের ভিতকেই নাড়িয়ে দেয় কি না, বিশ্বরাজনীতির আগ্রহী পর্যবেক্ষকরা সেদিকেও তাকিয়ে আছেন।
বাংলাদেশে কী হচ্ছে? বাংলাদেশে তো স্বাধীনতার চার দশকে অন্যায় শাসন-শোষণের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে জনগণ এখন একটা দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক শাসনই কামনা করছে। যে কাজ করে, সে ভুলও করে। অগণতান্ত্রিক শাসকরা শুধু যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে, তা-ই নয়, তারা গণতান্ত্রিক শাসকদের মতো পদে পদে ভুল করে এবং ভুলের চূড়ান্ত মাসুলও দেয়। কিন্তু তার পরও জনগণের কল্যাণ সাধনে তারা পুরোপুরি ব্যর্থই হয়। তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সমালোচিত হওয়ার সুযোগও করে দেয় নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই। এখনকার গণতান্ত্রিক মহাজোট শাসকদের অবস্থাটাও হয়েছে অনেকটা একই রকম। তারাও সমালোচিত হচ্ছে পদে পদে। তারা জনগণের জন্য বেশি বেশি কাজ করতে চাইছে বলেই ভুলও করছে আগের অনেক অগণতান্ত্রিক শাসকদের চেয়ে বেশি। সমালোচিতও হচ্ছে বেশি। সুশাসকদের এটাই নিয়তি। সুশাসন বলতে একেবারে নির্ভেজাল গণমুখী শাসন নয়। জনগণের জন্য ভালো-মন্দ মিলিয়েই সুশাসন। তবে সচেতন মানুষের নির্মোহ বিচারে নিশ্চয়ই তার ভেতর মন্দের চেয়ে ভালোর পাল্লাই ভারী হবে।
সচেতন মানুষ নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে বলেই মহাজোট সরকারের গত দুই বছরের শাসনামলে এবারেরটা নিয়ে বিএনপির চতুর্থ দফা হরতালের ডাকেও তারা সাড়া দেয়নি। মানুষ এখন পর্যন্ত বিএনপির পেছনে দৌড়াতে চাইছে না। যদিও স্থানীয় ফ্যাক্টরের দরুন একটি উপনির্বাচন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ পৌরসভা নির্বাচনে তারা জিতেছে, কিন্তু সেটা জাতীয় বিজয়ের কোনো ইয়ার্ডস্টিক নয়। বিএনপির চতুর্থ হরতালেরও দাবিগুলোর পেছনে যুক্তি যেরকমই থাক, মানুষ তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে এখনই হরতালের মতো শেষ অস্ত্র তুলে নেওয়া সঙ্গত মনে করেনি। অন্যদিকে, চতুর্থবার ফ্লপ হরতালের পরও বিএনপি হাইকমান্ড সুস্থ রাজনীতির দিকে পা বাড়াচ্ছে না। সংসদেও যাচ্ছে না। এতে তাদের দলের ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে, বাড়ছে হতাশা এবং নৈরাজ্য। দলের ভেতর অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, এভাবে চললে বিএনপি কোনোদিনই আর ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এভাবেই একটি দলের অপমৃত্যু ঘটে, যেমন এ দেশে অতীতে মুসলিম লীগের ঘটেছিল।
একটি প্রধান জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হরতালের আগেই সঠিক ইস্যু নির্ধারণে ব্যর্থতার জন্য বিএনপির শীর্ষ ও মধ্যস্তরের নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য বিরাজ করছিল। প্রধানমন্ত্রী হরতালের আগেই জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে আড়িয়াল বিলে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। এতেই কার্যত বিএনপির মাঠ গরমের রাজনীতিতে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। এর পরও একরকম গোঁয়ার্তুমি করে দলের মহাসচিব পুরনো সব দাবি, যেমন_নিত্যপণ্যের মূল্য হ্রাস, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ ইত্যাদিকে ইস্যু করেই হরতালের কর্মসূচি আঁকড়ে ধরে থাকেন। দলের একটি অংশ এসব দাবির পরিবর্তে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আর ফেলানীর সীমান্তহত্যার প্রতিবাদেই মাত্র হরতাল ডাকার পক্ষে মত দিয়েছিল। দেখা গেছে, হরতাল ডাকা নিয়েই মতদ্বৈধের কারণে দলের আহ্বানের প্রতি যে নূ্যনতম জনসমর্থন থাকার কথা ছিল, তাও শেষে কর্পূরের মতো উবে যায়। হরতালের দিন ভোরবেলা থেকেই মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, শুধু রিকশা নয়, সব ধরনের যানবাহনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। দোকানপাট, ব্যাংক_সবই যথারীতি চালু হয়ে গেছে। ফ্লপ বলতে এমন মারাত্মক ফ্লপ এর আগে কখনো কোনো হরতালে হয়নি। বিএনপির এতেও চৈতন্যোদয় হচ্ছে না। সেই আগের সহিংসতার সংস্কৃতি দিয়ে হরতালকে গায়ের জোরে সফল করার বর্বর পন্থা গ্রহণ করতে গিয়ে রাজনীতির দিক দিয়ে বিএনপি আরো পিছিয়েই যাচ্ছে। গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে রাজনীতিতে ভ্রূক্ষেপহীনভাবে পিছিয়ে পড়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও শাসকরা ঘটিয়ে চলেছে। ইয়েমেনে একনায়ক সালেহ প্রবল গণদাবি অগ্রাহ্য করে এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। একইভাবে গত মাসে গণবিদ্রোহে তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জাইন এল আবিদিন বেন আলীর সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য পুলিশ অফিসারদের দায়ী করছে মানুষ। তিউনিসিয়াব্যাপী ব্যাপক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আর মিসরে তিন দশক ধরে একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। তাঁর প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার আপস পরিকল্পনা বাতিল করে এ মুহূর্তে ক্ষমতা ত্যাগের দাবিতেই অটল রয়েছেন। জনসমর্থন যখন থাকে না, তখন মিথ্যা আর গোঁয়ার্তুমিই যে রাজনীতির একমাত্র পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়, দুনিয়াভর সব স্বৈর শাসক আর স্বৈরাচারপন্থীর সেটাই একমাত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে টিকে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী শাসকদের মতো এখানকার নিকট-অতীতের দুঃশাসনের নায়কদের মধ্যেও সেই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট এম জে আকবরও মুবারক প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সেই কথাই লিখেছেন। তাঁর 'বাইলাইন' কলামে 'দ্য কলাপ্স অব এ লাই' শীর্ষক নিবন্ধে মুবারক প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন_'একনায়কত্ব হচ্ছে এলিটদের মধ্যকার একটি বন্দোবস্ত। তারা হোসনি মুবারক যা করছেন, একটি লটারির খেলা দিয়েই শুরু করেন। আনোয়ার সাদতকে যদি একটি প্যারেডে আততায়ীর হাতে নিহত হতে না হতো, তাহলে তাঁর পরিণতি হতো এক অখ্যাত জেনারেলের মতো বিস্মৃতির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া।
আনোয়ার সাদতের ওইভাবে নিহত হওয়ার পর থেকে কুচকাওয়াজে সৈন্যদের আর তাজা গোলাবারুদ নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। এতে কলম্বো সফরের সময় রাজীব গান্ধীর জীবন রক্ষা পায়। তবে তাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ইউনিফর্মধারী সবাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছিল। এম জে আকবর লিখেছেন : 'মুবারক মিথ্যা দিয়ে তাঁর শাসন শুরু করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি গণতন্ত্র দেবেন। আর পেছন থেকে তিনি এমনসব কলকাঠি নাড়েন এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার বদৌলতে তিন দশক ক্ষমতায় থেকে যান। সেপ্টেম্বরে নীরবে বিদায় নেবেন_এখন তিনি আবার এমন একটি মিথ্যাই তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন।'
আমাদের এখানে মিথ্যার বেসাতি করে জোট সরকার দুটি টার্ম ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পর স্বখাত সলিলে তথা সেনাসমর্থিত এক/এগারোর সরকারের রোষানলে পড়ে এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর গণরোষে ক্ষমতা হারায়। আজ আবার নিজেদের অতীত ভুলে মইনুল রোডের বাড়ির এপিসোডসহ অজস্র মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নিষ্ফল হরতাল, বিক্ষোভ ইত্যাকার কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাস এবং আজকের আরব মধ্যপ্রাচ্যের অগি্নগর্ভ পরিস্থিতি থেকে তাকে শিক্ষা নিতে হবে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে এবং জনগণের আস্থা পুনঃঅর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চাইলে এ ছাড়া তার সামনে কোনো বিকল্প নেই।
০৮.০২.২০১১
No comments