বাঙালির জাগরণ ও মুক্তির ইতিহাস এবং ফেব্রুয়ারির সংগ্রাম by শামসুল আরেফিন খান

ভাষা আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে শাসিত ও পদানত জাতিসত্তাকে বিলীন করে দিয়ে শোষণ-শাসন পাকাপোক্ত করার প্রাচীন তত্ত্বের আবিষ্কারক হচ্ছেন স্প্যানিশ ভাষা-তাত্তি্বক এলিও আস্তানিও ডি নেব্রিহা। ৫০০ বছর আগের কথা। স্পেনের রানি তখন ইসাবেলা। কথিত আছে, রানীকে তুষ্ট করার জন্য ভাষাবিদ নেব্রিহা 'কাস্তিলিয়' ভাষায় একটি ব্যাকরণ বই


লিখে তাঁকে উপহার দেন। সেই ব্যাকরণ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন, 'ভাষাই সেই হাতিয়ার, যা সব সময় সাম্রাজ্যের দোসর হয়ে থেকেছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। একযোগে তারা বিকশিত হয়, আর তাদের অবক্ষয়ও হয় একসঙ্গে।' 'ভাষাই হবে মানুষের মন আর মস্তিষ্কের ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের প্রধানতম হাতিয়ার'_নেব্রিহার এই অভিনব তত্ত্বই সম্ভবত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছিল। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ভারতশাসন বিধির ২৯ নং উপধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংশোধনী প্রস্তাবে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে উর্দু ভাষা যুক্ত করার সরকারি প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার কুমিল্লা জেলার সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঐতিহাসিক সংশোধনী আনেন। এতে তিনি পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ চার কোটি ৪০ লাখ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। কংগ্রেস সদস্য শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, হেমহরি বর্মা প্রমুখ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করেন। কিন্তু সরকার পক্ষের প্রবল বিরোধিতায় প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান বলেন, উপমহাদেশের ১০ কোটি মুসলমানের পৃথক আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। উর্দু মহাদেশের ১০ কোটি মুসলমানের ভাষা। "URDU CAN BE THE ONLY LANGUAGE, WHICH CAN KEEP THE PEOPLE OF EAST BENGAL OF THE EASTERN ZONE AND THE PEOPLE OF THE WESTERN ZONE TOGETHER. IT IS NECESSARY FOR THE NATION TO HAVE ONE LANGUAGE_'উর্দু ভাষাই কেবল পারে দেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলকে ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে।' ঐক্য ও সংহতির কথা বললেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারকে পদানত রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ভাষা আগ্রাসনই ছিল তাদের ঔপনিবেশিক শাসন বলবৎ রাখার প্রথম পদক্ষেপ।
পাকিস্তানের জন্মের আগেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করা সহজ হবে না_এ কথা বুঝতে পেরে বাংলাবিদ্বেষীরা ধর্মকে বর্ম করে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার জিগির তোলে। ড. শহীদুল্লাহ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজের পক্ষে কৌশলে এর জবাব দেন। 'মাতৃভাষার পরেই স্থান ধর্মভাষার...কিন্তু বর্তমানে আরবীকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি ধর্মীয় ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে।' এ বিতর্ক চলতে চলতে এক সময় 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র জোরদার হয়ে ওঠে। একটি বিশেষ মহল বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার উন্মেষ নস্যাতের লক্ষ্যে বাংলার প্রাণে আঘাত হানার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও ঘৃণ্য আগ্রাসন রুখতে বাঙালির অনন্য আ@ে@@@াৎসর্গ ও যুদ্ধ জয়ের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের মহান ভাষা সংগ্রামের আরেকটি ঐতিহাসিক বিজয়। বাঙালির ভাষা আন্দোলন জাতির হৃদয়ে হাজার তারে বেজে ওঠা এক রাগিণী, যা চেতনার মর্মমূলে বাঙ্ময় হয়ে চিরদিন স্পন্দন জাগাবে। বাঙালি প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণ করবে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ৮ ফাল্গুনকে আত্মজাগরণের লগ্ন হিসেবে। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?' সত্যি ভোলা যায় না বরকতের বুকের পিঞ্জর থেকে উথলে ওঠা থোকা থোকা লাল গোলাপ আর রক্তজবার গুচ্ছের কথা। দুপুরে গড়িয়ে সূর্যটা কেবল একটু পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে, যেখানে মায়ের বুকের আঁচল বিছিয়ে শহীদ মিনারটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানেই, তখন দাঁড়িয়েছিল বাংলার গর্ব, পৃথিবীর সব বাঙালির অহঙ্কার আবুল বরকত। হঠাৎ করেই ঘাতকের একঝাঁক বুলেট এসে তাঁর বুকটা ঝাঁজরা করে দিল। সাথীরা তাঁর রক্তস্নাত দীঘল দেহটা ধরাধরি করে নিয়ে গেল জরুরি চিকিৎসা বিভাগে। ডাক্তার বললেন, বেঁচে নেই, অনেক দেরি হয়ে গেছে। কি নাম, কোথায় ধাম, কোথায় স্বজন? নাম : আবুল বরকত, পিতা : শামসুদ্দিন, মাতা : হাসিনা বেগম। আদিনিবাস : ভরতপুর, মুর্শিদাবাদ। গর্জে উঠল ছাত্রসমাজ। 'খুন হয়েছে আমার ভাই_খুনি তোমার রক্ষা নাই।' পুলিশের লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র রাজপথে নেমে এল। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রাবাসে। গোটা শহরে, পাড়া-মহল্লায়। ছাত্র-আন্দোলন রূপ নিল গণ-আন্দোলনে। শুকনো পাতায় আগুনের ফুলকি পড়ে দাবানল সৃষ্টি হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে বরকতসহ শহীদ হন ২. রফিউদ্দিন আহমদ (পিতা : আব্দুল লতিফ, মানিকগঞ্জ), ৩. আব্দুল জব্বার (পিতা : আব্দুল কাদের, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ), ৪. আব্দুস সালাম (সরকারি কর্মচারী, পিতা : ফজিল মিয়া, লক্ষ্মণপুর, ফেনী); ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৪৫ দিন পর প্রাণত্যাগ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিকুর রহমান (হাইকোর্টের কর্মচারী ও আইন কলেজের ছাত্র, পিতা : মৌ. মাহবুবুর রহমান), অহিউল্লাহ (পিতা : হাবিবুর রহমান, রাজমিস্ত্রি)। হাইকোর্টের সামনে মিছিলে থাকাকালে সশস্ত্রবাহিনীর ট্রাক চাপায় নিহত হন আব্দুল আউয়াল (পিতা : মোহাম্মদ হাশিম); ১০ থেকে ১২ বছরের এক অজ্ঞাতপরিচয় বালকও সেদিন একই সময় প্রাণ হারায়। এ ছাড়া আরো অনেকে শহীদ হন।
একুশের ইতিহাস আত্মত্যাগের গৌরব ও আত্মাহুতির বেদনার ইতিহাস। সে ইতিহাস আমাদের চেতনার গভীরে হাত রাখে। মহান একুশে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে কিংবদন্তি হয়ে আছে। বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম '৪৭-এ ভারত বিভাগের মাত্র তিন মাসের মধ্যে শুরু হলেও বাংলাকে আমাদের জীবনের ভাষা, শিক্ষার ভাষা, সমাজের ভাষা করার সংগ্রাম শুরু হয় তারও আগে। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এবং মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করার অত্যাবশ্যকতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। মাতৃভাষা বাংলাকে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার বাহন করার কথা হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজের লেখক ও বিদ্বজ্জনের বহুজনই সেকালে বলেছেন ও এর ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। উনিশ শতকেই মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদান ও সংস্কৃতিচর্চার দাবি মুসলিম বিদ্বজ্জন থেকে উত্থাপন করা হয়। বিশের শতকে সে উপলব্ধি ক্রমেই সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯২৮ সালে এক ভাষণে বলেন, 'আমাদের কর্তব্য হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য যেমন চেষ্টা করা তেমনি শিক্ষার স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করা। এই পোড়া-ভারত ছাড়া আর কোথায় শিক্ষার এমন সৃষ্টিছাড়া প্রথা আছে যেখানে বিদেশি ভাষার ঘাড়ে চড়ে সমস্ত জ্ঞান কুড়াতে হয়? এতে ছেলেমেয়েদের মুখস্থ শক্তির ওপর এমন চাপ পড়ে যাতে তাদের বুদ্ধি এক রকম আড়ষ্ট হয়ে যায়।' এরও আগে মীর মশাররফ হোসেন 'আমাদের শিক্ষা' শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, 'মাতৃভাষায় যার আস্থা নেই সে মানুষ নহে।' 'হিতকরী' পত্রিকার ১০ পৌষ ১২৯৭ সংখ্যায় তাঁর এ লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, 'মাতৃভাষা অবহেলা করে অন্য ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হলেই তার প্রতিপত্তি নেই।' (সূত্র : উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা : ড. ওয়াকিল আহমদ, পৃ-১৪৩)। ১৭ নভেম্বর '৪৭ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি জানিয়ে পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক, আইনজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ও আলেম-ওলামা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।
করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পাসের প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর '৪৭ ঢাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক বিরাট সভায় ডাকসু ভিপি ফরিদ আহমদ নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেন : (ক) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহন করা হোক; (খ) রাষ্ট্রভাষা ও লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের রাষ্ট্রভাষা সাবকমিটি ১১ মার্চ ধর্মঘট ও ছাত্রবিক্ষোভের আহ্বান জানায়। বাম সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানায়। ধর্মঘটে পিকেটিং ও বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে কর্মসূচি আশাতীতভাবে সফল হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, বাহাউদ্দিন চৌধুরীসহ ৬৯ বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হন এবং পুলিশের দমন-পীড়নে ২০০ জন আহত হন। বন্দিমুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পর্যায়ে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ছাত্রদের পক্ষে কমরুদ্দিন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বন্দিরা ১৪ মার্চ মুক্তি পান। ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্যান্য সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ-সংগ্রাম যাতে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ না করে সেদিকে লক্ষ রেখে সরকার গোপনে আপসের উদ্যোগ নেয়। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বাংলাকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করতে থাকেন। সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চুক্তিতে ছাত্রদের দুর্বলতার আভাস থাকায় মুক্ত রাজবন্দিরা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। চুক্তি সংশোধনের দাবি ওঠে। সে লক্ষ্যে ১৫ মার্চ ফজলুল হক হলে সাধারণ ছাত্রসভা আহূত হয়। গ্রন্থকার বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ছাত্রসভা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগেই শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে সদলবলে উপস্থিত হয়ে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন এবং আপসকামীদের নিন্দায় সোচ্চার হন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করে 'আপস না সংগ্রাম_সংগ্রাম-সংগ্রাম, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, চলো চলো সংসদ চলো' স্লোগান তুলে মিছিলসহকারে পূর্ব বাংলা আইনসভা অভিমুখে যাত্রা করেন। বর্তমান জগন্নাথ হল যেখানে, সেখানেই ছিল সংসদ ভবন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্লোগানমুখর ছাত্রমিছিল আহছানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পেঁৗছলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছাত্ররা দমন-পীড়নের শিকার হয়েও আন্দোলন-সংগ্রামকে বলীয়ান করে তোলে। আপস চেষ্টা মাঠে মারা যাওয়ায় সরকার সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে আন্দোলন বানচাল করার নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান তা যেমন সত্য, তার চেয়ে সত্য আমরা বাঙালি। এটা কোনো আদর্শের কথা নয়, এটা বাস্তব সত্য।'
২৪ মার্চ, ১৯৪৯ সন্ধ্যায় ঢাকায় সফররত গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, লিলি খান, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাক্ষাৎ করেন। জিন্নাহর সঙ্গে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তুমুল বিতর্ক হয়। জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের একসময়ের ব্যক্তিগত সচিব গ্রন্থকার আজিজুল হক শাজাহান 'ইতিহাসের শিলালিপি' নামক বইতে লিখেছেন, এক পর্যায়ে মি. জিন্নাহ গোপনে শেরে বাংলার সাথে দেখা করে বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হিসাবে মেনে নিয়ে আপসরফায় আসার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান।' শেরে বাংলা এ ব্যাপারে কী ভূমিকা রাখেন, তা জানা যায় না। তবে তৎকালীন ডাকসু ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক আপসের চেষ্টা করে ধিক্কৃত হন। পরবর্তী সময়ে তাদের দুজনকেই গণবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় হতে দেখা যায়। আর এই ঘৃণ্য আপসের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাদপ্রদীপের নিচে এসে দাঁড়ান। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হন। সংগ্রামী ছাত্র সমাজের দুর্মর আন্দোলন ও আপসহীন সংগ্রাম জনগণের মধ্যে আত্মপরিচয় উদ্ঘাটনের চেতনাকে উজ্জীবিত করে তোলে। শ্রেণী-পেশার আন্দোলন ও অবদমিত জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামকে চাঙ্গা করে দেয়। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাষ্ট্রের ভাবি সংবিধানের ব্যাপারে মূলনীতি কমিটির সুপারিশমালা প্রকাশ করলে পূর্ব বাংলার সচেতন জনতা ক্ষুব্ধ হয়। ধীরে ধীরে সে ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে আন্দোলন পরে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে মিশে যায়। এর আগে ২৪ এপ্রিল, ১৯৫০ রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে লকআপে থাকা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১. কৃষকনেতা বিজয় সেন (রাজশাহী), ২. হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), ৩. আনোয়ার হোসেন (খুলনা), ৪. সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), ৫. সুধীন ধর (রংপুর), ৬. কম্পরাম সিংহ (দিনাজপুর)। আহত হন যশোরের আব্দুল হকসহ আরো অনেকে। রাজশাহীর নাচোলে সাঁওতাল বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্র কারাগারে অমানবিক, নির্মম এবং আদিম হিংস্র পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
এদিকে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন পরিষদে অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী জমির সর্বোচ্চ সিলিং ২০০ বিঘা নির্ধারণ করে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনেসিস বিল উত্থাপন করলে শ্রেণীস্বার্থে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলীয় ভূস্বামীরা এক হয়ে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর হন। বিলটি বিবেচনার জন্য ৪৫ সদস্যের যে সিলেক্ট কমিটি গঠিত হয়, তাতে ২০ জন জমিদার ছিলেন। আড়াই বছর ধরে বিলের ওপর আলোচনা চলে। ১৯৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন সংশোধনীসহ বিলটি গৃহীত হয়। এই বিলের ওপর আলোচনা চলাকালে ২০০ বিঘার বেশি জমির মালিক তিন হাজার হিন্দু-মুসলিম জমিদার-জোতদার পরিবারের প্রতিভূ আইন পরিষদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়ে গলাগলি করায় দেশবাসী দ্বি-জাতিতত্ত্বের ফাঁকিটা ধরে ফেলে। এভাবে মুসলিম লীগের শাসন-শোষণ ও নির্যানের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ সচেতন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গণচেতনার এই প্রেক্ষাপট ও ভিত্তিভূমির ওপর ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষার প্রশ্নে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে। মহান ভাষা সংগ্রামকে একুশের শীর্ষবিন্দুতে পেঁৗছে দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের রূপ দিতে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন, কারা-নির্যাতিত হয়েছেন তাঁদের জাতি কখনো ভুলবে না। বাঙালির জাগরণ ও মুক্তির ইতিহাসে তাঁদের সবার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

লেখক : ভার্জিনিয়া প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.