কথা সামান্যই-হেথায় আর্য হেথা অনার্য by ফজলুল আলম
জাতি বা জাতভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বের যুদ্ধংদেহী মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে, অনেকটাই ভালোর দিকে। ধারণা করা হয়েছিল যে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে একই ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্তি্ব্বক বৈশিষ্ট্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করা জনগোষ্ঠী সুখে জীবনযাপন করবে। বাংলাদেশেও একই ধারণা করা হয়েছিল।
তবে রাজনৈতিক বিশ্বে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই, যেখানে শুধু একটি জাতি বসবাস করে। একটা মন্দ অবশ্য শুরুতেই মাথা তুলেছিল- সেটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। নেপোলিয়নের সময়ের যুদ্ধবিগ্রহ ও তাঁর তিরোধানের পর জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদের ধারণা জন্মে। জাতীয়তাবাদ যে একটা হিংস্র রূপ ধারণ করতে পারে, তা হিটলারের নাৎসিবাদ প্রমাণ করে দিল। হিটলারের পরাজয়ের পরেও স্বীয় জাতিসত্তা ছাড়া অন্য জাতির প্রতি রাজনৈতিক ও সামাজিক অপছন্দ (এমনকি ঘৃণা) বৃদ্ধি পায়। অনেক দেশে শত শত বছর ধরে বসবাস করা মূল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতের বাইরের লোকজনও সেই অপছন্দ ও ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে। এই মন্দের দিকটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কমে না গিয়ে আরো প্রকট হয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হয়েও নিজ দেশে নিচু অবস্থানে বাস করার উদাহরণ দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে তাকালেই দৃশ্যমান হয়। সেখানে ককেশান ইউরোপিয়ানরা এখনো (ম্যান্ডেলা আসার পরেও) সব উচ্চ ক্ষমতার কর্তৃপক্ষ। উপনিবেশকালে কৃষ্ণকায় আফ্রিকানরা সেখানে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার ছিল। স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ও ইউরোপিয়ানদের অ্যাপার্থেউড নীতিমালা বর্জনের পরও কৃষ্ণকায় আফ্রিকানরা এখনো একই দুর্দশাপূর্ণ অবস্থানে আছে।
আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানে 'মেল্টিং পট' থিওরি নামের তত্ত্বে বলা হয়েছে যে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করতে করতে নিজেদের ভিন্নতা ভুলে যায়। এই তত্ত্বটা যে ভুল, তা এখন বাস্তবে প্রমাণিত। একসময় রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভারতে এসে 'এক দেহে হলো লীন।' কিন্তু 'শক হুনদল পাঠান মোগল'- সবাই বৃহত্তর ভারতের সদস্য হয়ে ভারতীয় হলেও তাদের পৃথক জাতিসত্তা কেউই বিসর্জন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শ্রেণী-বিভাজিত ও ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভাজিত সমাজের উদাহরণ খুব একটা নেই। সেখানে বৈষম্য এবং বঞ্চনা নিয়ে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী আদিকাল থেকেই পড়ে আছে। তাদের সমান অধিকারের কথা সংবিধানে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ দুটি, একটা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য ও দ্বিতীয়টা ব্যক্তিপর্যায়ের বৈষম্য। যেসব দেশে এমন জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যারা মূল জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না, সেখানেই ওই দুই পর্যায়ের বৈষম্য বিদ্যমান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিজাতীয় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক ইউরোপে আগমন করে এবং অনুরূপ বৈষম্যের মধ্যেই এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ষাট বছরের অধিক সময় জীবন যাপন করছে। দাঙ্গা সেখানেও হয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে।
ভিন্ন ও বিজাতীয় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে থেকেছে- এমন উদাহরণ খুব কমই চোখে পড়ে। কানাডার ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ- এই দুই সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী এখনো এক দেহে লীন হয়নি এবং একে অপরকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে হিসপানিক, কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের ও ভারতীয়রা বেশির ভাগই নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কায় একেকটা গোষ্ঠীভুক্ত গণ্ডির মধ্যে (অনেকটা খুপরির মধ্যে থেকে) চলাফেরা করে।
শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন বই থেকে প্রথম জেনেছিলাম যে বাংলার পাশেই আরাকান নামে এক দেশ আছে এবং সেখানে কলকাতা ডক থেকে জাহাজে প্রচুর বাঙালি কাজের সূত্রে যায় এবং অনেকে সেখানে বিয়ে করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। এই বাঙালি চলাচল সম্ভবত যুদ্ধের আগের কথা। জাপানিরা আরাকান থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার পর এই শ্রমজীবী শ্রেণীর কী হাল হয়েছিল, তা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। অভিনেত্রী সুপ্রিয়ার আত্মজীবনী পড়ে রেঙ্গুন থেকে উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর বাঙালিদের পলায়নের কথা জানতে পারি। মিয়ানমার-আরাকানে বাঙালির বসবাসের এই বৃত্তান্ত থেকে এবং তত্ত্বগতভাবে ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যে মিশ খায় না, তা ঘোষিত হওয়ার পর বর্তমান উত্তর আরাকানবাসী 'রোহিঙ্গা' জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কারণ সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, এই দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী কে? যেই-ই দায়ী হোক, তাদের দুর্দশা মোচনের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সময় উগান্ডায় প্রচুরসংখ্যক ভারতীয়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ইদি আমিন ওই ভারতীয়দের (রেজিস্টার না করা) বিতাড়িত করেন। বেশির ভাগ ভারতীয় ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং তারা বিতাড়িত হয়ে ব্রিটেনে আসবে বলে ঘোষণা দেয়। ব্রিটিশরা প্রথমত তাদের আটকালেও পরে তাদের প্রায় সবাইকে ব্রিটেনে নিতে বাধ্য হয়।
আরাকানের ঘটনাও প্রায় একই। বাঙালিদের আরাকানবাসী করে অথবা আরাকান ও চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলের কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করে তারা আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করেছিল। অবশ্য সে সময় কোনো আইনের বিধিনিষেধ ছিল বলে মনে হয় না। তবুও দায়িত্ব ব্রিটিশ কলোনিয়ালিস্টদের কাঁধে পড়ে। ব্রিটিশরা এ বিষয়ে নীরব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, এমনকি ইউএনএইচসিআর (ইউএন শরণার্থীদের জন্য হাইকমিশন) মিয়ানমারকে ভৎর্সনা না করে বাংলাদেশকে দোর খুলে দিতে বলছে। বর্তমান রাজনৈতিক মিয়ানমারের মধ্যে এই উত্তর আরাকানবাসীরা 'পারাইয়া', অর্থাৎ সর্বনিম্ন সামাজিক অবস্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে বহু বছর ধরে। সামরিক শাসনের সময় এদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে দেওয়া হতো (ব্রিটিশ আমলেও তা-ই করা হতো); অসম্মতি জানালে নির্মম অত্যাচার করা হতো। নারীদের ধর্ষণ, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সে সময় থেকে এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সবাই আশায় ছিল, সামরিক জান্তা চলে যাওয়ার পর এখন যখন গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে, তখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব সু চির ওপর ভরসা করতে পারবে। সে রকম কিছুই হলো না, বরং রোহিঙ্গা নামকরণ করা জনগোষ্ঠীর ওপর, বিশেষত মুসলমানদের ওপর সহসাই অত্যাচার বেড়ে গেল। হ্যাঁ, মিয়ানমার বলেছে যে তারা রেজিস্টার করা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতে অখুশি নয়; কিন্তু সবাই জানে যে রোহিঙ্গাদের অতি স্বল্পসংখ্যায় 'কার্ড' দেওয়া হয়েছিল এবং সেসব কার্ড তাদের ভোটাধিকার পর্যন্ত দেয় না। 'কার্ডধারীরা' ফিরে গেলেও তাদের বাড়িঘর সহজে ফেরত পাবে না, উপযুক্ত পারিশ্রমিকে কাজ তো দূরের কথা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে সব শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। আমি আশাবাদী, সু চির সরকার এ বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না।
মেল্টিং পট তত্ত্ব প্রযোজ্য না হোক, রবীন্দ্রনাথের এক দেহে লীন না হোক, আর্য-অনার্য না মিলুক, মানুষকে মানুষের মতো করে বাঁচতে দেওয়ার দায়িত্ব অতীতের দায়বদ্ধতা থেকে এখন পর্যন্ত একই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা উচ্চারণ করেছিলেন, 'যারা সাউথ আফ্রিকায় বসবাস করতে চায়, তারা পৃথিবীর যেখান থেকেই আসুক না কেন, তারা এ দেশের নাগরিক।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানে 'মেল্টিং পট' থিওরি নামের তত্ত্বে বলা হয়েছে যে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করতে করতে নিজেদের ভিন্নতা ভুলে যায়। এই তত্ত্বটা যে ভুল, তা এখন বাস্তবে প্রমাণিত। একসময় রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভারতে এসে 'এক দেহে হলো লীন।' কিন্তু 'শক হুনদল পাঠান মোগল'- সবাই বৃহত্তর ভারতের সদস্য হয়ে ভারতীয় হলেও তাদের পৃথক জাতিসত্তা কেউই বিসর্জন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শ্রেণী-বিভাজিত ও ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভাজিত সমাজের উদাহরণ খুব একটা নেই। সেখানে বৈষম্য এবং বঞ্চনা নিয়ে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী আদিকাল থেকেই পড়ে আছে। তাদের সমান অধিকারের কথা সংবিধানে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ দুটি, একটা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য ও দ্বিতীয়টা ব্যক্তিপর্যায়ের বৈষম্য। যেসব দেশে এমন জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যারা মূল জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না, সেখানেই ওই দুই পর্যায়ের বৈষম্য বিদ্যমান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিজাতীয় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক ইউরোপে আগমন করে এবং অনুরূপ বৈষম্যের মধ্যেই এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ষাট বছরের অধিক সময় জীবন যাপন করছে। দাঙ্গা সেখানেও হয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে।
ভিন্ন ও বিজাতীয় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে থেকেছে- এমন উদাহরণ খুব কমই চোখে পড়ে। কানাডার ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ- এই দুই সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী এখনো এক দেহে লীন হয়নি এবং একে অপরকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে হিসপানিক, কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের ও ভারতীয়রা বেশির ভাগই নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কায় একেকটা গোষ্ঠীভুক্ত গণ্ডির মধ্যে (অনেকটা খুপরির মধ্যে থেকে) চলাফেরা করে।
শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন বই থেকে প্রথম জেনেছিলাম যে বাংলার পাশেই আরাকান নামে এক দেশ আছে এবং সেখানে কলকাতা ডক থেকে জাহাজে প্রচুর বাঙালি কাজের সূত্রে যায় এবং অনেকে সেখানে বিয়ে করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। এই বাঙালি চলাচল সম্ভবত যুদ্ধের আগের কথা। জাপানিরা আরাকান থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার পর এই শ্রমজীবী শ্রেণীর কী হাল হয়েছিল, তা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। অভিনেত্রী সুপ্রিয়ার আত্মজীবনী পড়ে রেঙ্গুন থেকে উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর বাঙালিদের পলায়নের কথা জানতে পারি। মিয়ানমার-আরাকানে বাঙালির বসবাসের এই বৃত্তান্ত থেকে এবং তত্ত্বগতভাবে ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যে মিশ খায় না, তা ঘোষিত হওয়ার পর বর্তমান উত্তর আরাকানবাসী 'রোহিঙ্গা' জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কারণ সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, এই দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী কে? যেই-ই দায়ী হোক, তাদের দুর্দশা মোচনের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সময় উগান্ডায় প্রচুরসংখ্যক ভারতীয়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ইদি আমিন ওই ভারতীয়দের (রেজিস্টার না করা) বিতাড়িত করেন। বেশির ভাগ ভারতীয় ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং তারা বিতাড়িত হয়ে ব্রিটেনে আসবে বলে ঘোষণা দেয়। ব্রিটিশরা প্রথমত তাদের আটকালেও পরে তাদের প্রায় সবাইকে ব্রিটেনে নিতে বাধ্য হয়।
আরাকানের ঘটনাও প্রায় একই। বাঙালিদের আরাকানবাসী করে অথবা আরাকান ও চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলের কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করে তারা আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করেছিল। অবশ্য সে সময় কোনো আইনের বিধিনিষেধ ছিল বলে মনে হয় না। তবুও দায়িত্ব ব্রিটিশ কলোনিয়ালিস্টদের কাঁধে পড়ে। ব্রিটিশরা এ বিষয়ে নীরব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, এমনকি ইউএনএইচসিআর (ইউএন শরণার্থীদের জন্য হাইকমিশন) মিয়ানমারকে ভৎর্সনা না করে বাংলাদেশকে দোর খুলে দিতে বলছে। বর্তমান রাজনৈতিক মিয়ানমারের মধ্যে এই উত্তর আরাকানবাসীরা 'পারাইয়া', অর্থাৎ সর্বনিম্ন সামাজিক অবস্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে বহু বছর ধরে। সামরিক শাসনের সময় এদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে দেওয়া হতো (ব্রিটিশ আমলেও তা-ই করা হতো); অসম্মতি জানালে নির্মম অত্যাচার করা হতো। নারীদের ধর্ষণ, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সে সময় থেকে এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সবাই আশায় ছিল, সামরিক জান্তা চলে যাওয়ার পর এখন যখন গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে, তখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব সু চির ওপর ভরসা করতে পারবে। সে রকম কিছুই হলো না, বরং রোহিঙ্গা নামকরণ করা জনগোষ্ঠীর ওপর, বিশেষত মুসলমানদের ওপর সহসাই অত্যাচার বেড়ে গেল। হ্যাঁ, মিয়ানমার বলেছে যে তারা রেজিস্টার করা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতে অখুশি নয়; কিন্তু সবাই জানে যে রোহিঙ্গাদের অতি স্বল্পসংখ্যায় 'কার্ড' দেওয়া হয়েছিল এবং সেসব কার্ড তাদের ভোটাধিকার পর্যন্ত দেয় না। 'কার্ডধারীরা' ফিরে গেলেও তাদের বাড়িঘর সহজে ফেরত পাবে না, উপযুক্ত পারিশ্রমিকে কাজ তো দূরের কথা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে সব শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। আমি আশাবাদী, সু চির সরকার এ বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না।
মেল্টিং পট তত্ত্ব প্রযোজ্য না হোক, রবীন্দ্রনাথের এক দেহে লীন না হোক, আর্য-অনার্য না মিলুক, মানুষকে মানুষের মতো করে বাঁচতে দেওয়ার দায়িত্ব অতীতের দায়বদ্ধতা থেকে এখন পর্যন্ত একই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা উচ্চারণ করেছিলেন, 'যারা সাউথ আফ্রিকায় বসবাস করতে চায়, তারা পৃথিবীর যেখান থেকেই আসুক না কেন, তারা এ দেশের নাগরিক।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments