আন্তর্জাতিক-আরব বিশ্ব ও ইসলামী গণতন্ত্র by তারেক শামসুর রেহমান

বদলে যাচ্ছে আরব বিশ্ব। সনাতন ইসলামিক দলগুলো তাদের কঠোর অবস্থানেও পরিবর্তন এনেছে। আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরোধিতা করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে যে সহাবস্থান সম্ভব, তা প্রমাণ করেছে তিউনিসিয়া ও মরক্কোর ইসলামিক দলগুলো।


দীর্ঘদিন একনায়কতান্ত্রিক যে সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল আরব বিশ্বে, তাতে এখন পরিবর্তন আসছে

মিসরে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এক ঘোষণায় তিনি বলেছেন, তিনি মিসরে 'ইসলামী গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করতে চান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে এই 'ইসলামিক গণতন্ত্রে'র ব্যাখ্যাটা একেবারেই নতুন। তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, 'আরব বসন্ত' আরব বিশ্বে যে পরিবর্তন ডেকে আনছে, তাতে তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও ইসলামিক আদর্শ তারা পুরোপুরিভাবে পরিত্যাগ করেননি। তারা ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে যাচ্ছেন। তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, মরক্কোতে এই ইসলামী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। যে দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা যে দেশগুলো ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, ওই দেশগুলোতেই এই গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে। সেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধকে তারা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেননি। আরব বিশ্বে তিউনিসিয়ায় ২৩ বছরের শাসক জয়নুল আবেদিন বিন আলির পতনের পর প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল, তাতে বিজয়ী হয়েছিল ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা পার্টি। এই দলটি (২১৭টি আসনের সংসদে ৮৯ আসনে বিজয়ী) একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের সঙ্গে মিলে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনে বিজয়ী তিনটি দলের যে সমঝোতা হয়েছে তাতে এন্নাহদার নেতা হামদি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক পার্টির মুনসেফ মারজুকি প্রেসিডেন্ট আর এত্তাকাতুল দলের মুস্তাফা বিন জাফর হয়েছেন সংসদের স্পিকার। ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মরক্কোয়। সেখানে সম্প্রতি যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তাতে ইসলামপন্থি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (৩৯৫ আসনের ১২০টিতে বিজয়ী) একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে ইন্ডিপেনডেন্স পার্টি ও সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন তার পপুলার ফোর্সকে সঙ্গে নিয়ে। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতা আবদেলইয়া বারকিরানে হয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর মিসরের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও অত্যধিক ক্ষমতাসম্পন্ন সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ সেই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেছে। ওই নির্বাচনে ইসলামপন্থি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল (আসন ২১৬, মোট আসন ৪৯৮) আর কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত আল নূর পেয়েছিল ২১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট (আসন ১০৯)। এখন নতুন করে সেখানে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ফলে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ড. মোহাম্মদ মুরসির বিজয়ের পর দলটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। মুরসি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মনোনীত প্রার্থী। ড. মুরসি যে তিউনিসিয়া ও মরক্কোর অনুসৃত নীতি অনুসরণ করবেন, তা তিনি ঘোষণাও করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন, তিনি হবেন নিরপেক্ষ। আরব বিশ্বে এই ইসলামিক গণতন্ত্র বিকশিত হলেও এই ধারা প্রথম লক্ষ্য করা যায় তুরস্কে। তুরস্কে ১৯৯৭ সালের পর থেকেই ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ২০০২, ২০০৭ ও ২০১১ সালে পরপর তিনবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়। তারা ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয়েই নতুন এক রাজনীতি তুরস্কের জনগণকেই উপহার দিয়েছেন। আর মানুষ তা গ্রহণও করে নিয়েছে। তারা মূলত তুরস্কের দার্শনিক ফাতেহউম্মান ওলেনের ভাবধারার অনুসারী। তারা পুরোপুরি ইসলামিক শাসনে বিশ্বাসী, এটা বলা যাবে না।
মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের তথা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির বিজয় পশ্চিমা বিশ্ব ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও ব্রাদারহুডের কট্টরপন্থি মনোভাব সম্পর্কে অনেকেই অবগত আছেন। ড. মুরসি জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন বটে; কিন্তু একটি ইসলামিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে তিনি কতটুকু ছাড় দেন, সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়। হোসনি মোবারককে উৎখাতের প্রাক্কালে ফেব্রুয়ারিতে (২০১১) মুসলিম ব্রাদারহুডের গাইডিং কাউন্সিলের সদস্য এচ্ছাম এল এরসিয়ানের একটি প্রবন্ধ নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছিল (৯ ফেব্রুয়ারি)। সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যে গণতন্ত্র ইসলামিক মূল্যবোধকে স্বীকার করে না, সেই গণতন্ত্র মিসরবাসী গ্রহণ করবে না। তিনি লিখেছিলেন, ইসলামিক দুনিয়ায় ইসলাম ধর্মের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং যে গণতন্ত্রে ধর্মের ভূমিকা স্বীকৃত এবং জনগণের অধিকার ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেয়, সেই গণতন্ত্রই মিসরে বিকশিত হবে। অর্থাৎ তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ইসলামিক ভাবধারায় গড়ে উঠবে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। আর মুসলিম ব্রাদারহুড তেমনি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ চায়। এচ্ছাম এল এরসিয়ান একই সঙ্গে আমাদের এ কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমা গণতন্ত্র মিসরের জন্য উপযুক্ত নয়। এখানে স্পষ্টতই একটি ইঙ্গিত ছিল যে, পরিপূর্ণভাবে পশ্চিমা ধারার গণতন্ত্র মিসর গ্রহণ করবে না। এখানে সংবিধান তথা দৈনন্দিন কাজে ইসলামিক মূল্যবোধের প্রাধান্য থাকবেই। এ ক্ষেত্রে ড. মুরসিকে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মিসরে সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা কোনো অবস্থাতেই মিসরকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আরব বিশ্বের সর্বত্র ইসলামপন্থিরা কিছুটা নমনীয় হয়েছে। মরক্কোয় সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী ইসলামিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি একসময় অত্যন্ত কট্টর ছিল। ২০১০ সালে দলটি মরক্কোর রাজধানীতে বিখ্যাত গায়ক এলটন জনের একটি কনসার্টের বিরোধিতা করেছিল। এলটন জন সমকামী। দলটি সমকামিতা ও প্রকাশ্যে মদ্যপানের বিরোধী বলে তারা কনসার্টের বিরোধিতা করেছিল। অথচ মরক্কোর বৈদেশিক অর্থের একটা বড় উৎস ট্যুরিজম ও বৈদেশিক বিনিয়োগ। এটা বিবেচনা করেই দলটি তখন আর এসব বিষয়ে কথা বলেনি। সর্বশেষ নির্বাচনে তারা গুরুত্ব দিয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও তরুণদের চাকরির নিশ্চয়তা সম্পর্কিত সামাজিক বিষয়াদিতে। দলটি এখন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সুশাসন ও গণতন্ত্রের কথা বলছে।
বদলে যাচ্ছে আরব বিশ্ব। সনাতন ইসলামিক দলগুলো তাদের কঠোর অবস্থানেও পরিবর্তন এনেছে। আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরোধিতা করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে যে সহাবস্থান সম্ভব, তা প্রমাণ করেছে তিউনিসিয়া ও মরক্কোর ইসলামিক দলগুলো। দীর্ঘদিন একনায়কতান্ত্রিক যে সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল আরব বিশ্বে, তাতে এখন পরিবর্তন আসছে। একটি আধুনিকমনস্ক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যেখানে জন্ম হতে যাচ্ছে, সেখানে ধর্ম একটা অংশ, কিন্তু কট্টরপন্থি ইসলামিক চিন্তাধারা আদৌ কোনো প্রভাব বিস্তার করছে না। গত আট বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতিতে এটা চতুর্থ ধারা। ১৯৫২ সালে মিসরে রাজতন্ত্র উৎখাত ও জামাল আবদুন নাসেরের উত্থানের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা ২০১১ সালে এসে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব নতুন দুটি ধারার জন্ম দিলেও তা স্থায়ী হয়নি। এখন মডারেট ইসলামিক শক্তির উত্থান চতুর্থ ধারার জন্ম দিল। এই ধারা কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে ড. মুরসির উত্থানের মধ্য দিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে_ 'তাহরির স্কয়ার'-এর বিপ্লব কি ব্যর্থ হবে? ইতিহাসে এর প্রমাণ যে নেই তা নয়। ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের প্রথমদিকে ভার্সাই দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল। কিন্তু চার বছরের মধ্যে জ্যাকোবিনদের উত্থানে সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রথম পর্বে কেরোনস্কিকে ক্ষমতায় বসালেও তিনি থাকতে পারেননি। নভেম্বরে কট্টরপন্থি বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯৫২ সালে মিসরে রাজতন্ত্র উৎখাত হয়েছিল। কিন্তু রাজতন্ত্রের বদলে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় এলেও ২০০৯ সালে এসে দেখি মানুষের হতাশা ও গণবিক্ষোভ। তাই মিসর নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল।
হোসনি মোবারকের সময় মিসরে গণতন্ত্র ছিল না। এখন মুরসির উত্থান সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবে কি-না, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছি না। যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের শিক্ষক অধ্যাপক তারেক মাসুদ মনে করেন, ্তুউবসড়পৎধপু রহ ঊমুঢ়ঃ ড়ৎ ধহু ড়ঃযবৎ ঢ়ধৎঃ ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ, রং হড়ঃ ংড়সবঃযরহম বি ংযড়ঁষফ ভবধৎ.্থ
এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই। ওবামা প্রশাসনের নীতিনির্ধারকরা অধ্যাপক তারেক মাসুদের কথায় কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারবেন জানি না। তবে তাদের ভয় যে ইসলামপন্থিদের উত্থান নিয়ে, সে কথাটা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। আমাদের এখন দেখার পালা_ মিসরে পরিবর্তনটা কীভাবে আসে। মুরসি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।

ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.