দীর্ঘতম সুইসাইড নোট by শেখ রোকন
পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায় রিও হচ্ছে নদীর প্রতিশব্দ। ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী রিও ডি জেনেইরোতে সদ্য সমাপ্ত টেকসই উন্নয়ন সম্মেলন প্রসঙ্গে তবু মেঘের কথাই প্রথম মনে আসে। বাংলা প্রবাদে রয়েছে, মেঘ যত গর্জে তত বর্ষে না। রিও প্লাস টোয়েন্টি সম্মেলনের দশা যেন তেমনই।
যতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয়েছিল, সম্মেলনে ততটা ফল মেলেনি। বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন। না গর্জন, না বর্ষণ। কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে যাওয়ার আগে তা-ও সভা-সম্মেলন ও পত্রপত্রিকায় টের পাওয়া যেত যে সেখানে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য-বিধেয় কী কী। ফিরে আসার পরও এক ধরনের মূল্যায়ন চোখে পড়ত। সংশ্লিষ্টরা সংবাদ সম্মেলন করতেন। রিও সম্মেলনের ক্ষেত্রে নৈবচ নৈবচ।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাক, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রিও ডি জেনেইরোতে কী অর্জিত হলো? ২৫৩ অনুচ্ছেদের রিও ঘোষণা সে ক্ষেত্রে প্রথম ও খুব সম্ভবত একমাত্র প্রাপ্তি। প্রথম ধরিত্রী সম্মেলনের ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত এই আয়োজনকে সামনে রেখে বলা হচ্ছিল যে এখান থেকে 'সবুজ অর্থনীতি' গড়ে তোলার যাত্রা শুরু হবে। বাস্তবে সেই ব্যবস্থাকে টেকসই উন্নয়নের আর দশটা সম্ভাব্য পথের একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছিল, এ ধরনের সম্মেলন প্রতি প্রজন্মে একবার করে আসে। এখনকার নেতারা বিপন্ন ধরিত্রীর জন্য তাদের দূরদৃষ্টি, অঙ্গীকার ও নেতৃত্বের ছাপ রেখে যাবেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মঙ্গলবার্তা ও মাইলফলক রেখে যাবে। বাস্তবে রিওতে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে, তা হলো শুকনো কথাবার্তা সংবলিত ঘোষণাটি। 'দ্য ফিউচার উই ওয়ান্ট' শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার ওই দলিলের দাম ৫০ পৃষ্ঠা এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজের চেয়ে বেশি না কম, তা বিতর্কের বিষয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্তির ব্যাপারে ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে যেসব প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে এবার সময় ও পদ্ধতি চূড়ান্ত করে, আটঘাট বেঁধে কাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হবে_ এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল সবাই। কিন্তু পরিবেশ ও প্রবৃদ্ধির সমন্বয়ে টেকসই উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তার বিভিন্ন প্রাধিকার 'উলি্লখিত' হয়েছে মাত্র। সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি কেউ; আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয় দূরঅস্ত!
স্বভাবত সম্মেলনস্থলেই দলিলটি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। কড়া সমালোচনা হয়েছে। যেমন ব্রিটিশ উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ সেটাকে বলেছেন 'রসকষহীন' পাতা। বিবিসির এনভায়রনমেন্ট করেসপনডেন্ট প্রশ্ন তুলেছেন, শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত, দামি হোটেলে থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা প্রভৃতি মিলিয়ে যে খরচ হয়েছে, এই সম্মেলন তার যোগ্য কি-না? অক্সফাম জিবির চিফ এক্সিকিউটিভ বারবারা স্টকিং বিবিসির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, রিও সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যেন গোঁ-ই ধরেছিলেন যে, আমাদের এগিয়ে নিতে তারা কিছু করবেন না।
এ ধরনের কথাবার্তায় গায়ের ঝাল মিটে যাওয়ার পর এখন চলছে ঠাট্টা-তামাশা। যেমন পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক বৈশ্বিক সংগঠন ডবি্লউডবি্লউএফ হিসাব কষে দেখাচ্ছে যে, রিও ঘোষণায় ৫০ বার 'উৎসাহ প্রদান' শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। 'সমর্থন' কথাটি বলা হয়েছে ৯৯ বার। আর মাত্র পাঁচবার বলা হয়েছে 'উই উইল'। আমরা করব। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, নেতৃবৃন্দ কতটা গা বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছেন।
সব মিলিয়ে, রিও প্লাস টোয়েন্টির সম্মেলন ও এর ঘোষণাপত্রকে এক কথায় কী বলা যায়? মোক্ষম উত্তরটি টাইম ম্যাগাজিনের কাছে দিয়েছেন গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক কুমি নাইডু_ সম্মেলনটি হচ্ছে মহাকাব্যিক ব্যর্থতা আর ঘোষণাপত্রটি হচ্ছে 'ইতিহাসের দীর্ঘতম সুইসাইড নোট'।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
skrokon@gmail.com
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাক, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রিও ডি জেনেইরোতে কী অর্জিত হলো? ২৫৩ অনুচ্ছেদের রিও ঘোষণা সে ক্ষেত্রে প্রথম ও খুব সম্ভবত একমাত্র প্রাপ্তি। প্রথম ধরিত্রী সম্মেলনের ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত এই আয়োজনকে সামনে রেখে বলা হচ্ছিল যে এখান থেকে 'সবুজ অর্থনীতি' গড়ে তোলার যাত্রা শুরু হবে। বাস্তবে সেই ব্যবস্থাকে টেকসই উন্নয়নের আর দশটা সম্ভাব্য পথের একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছিল, এ ধরনের সম্মেলন প্রতি প্রজন্মে একবার করে আসে। এখনকার নেতারা বিপন্ন ধরিত্রীর জন্য তাদের দূরদৃষ্টি, অঙ্গীকার ও নেতৃত্বের ছাপ রেখে যাবেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মঙ্গলবার্তা ও মাইলফলক রেখে যাবে। বাস্তবে রিওতে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে, তা হলো শুকনো কথাবার্তা সংবলিত ঘোষণাটি। 'দ্য ফিউচার উই ওয়ান্ট' শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার ওই দলিলের দাম ৫০ পৃষ্ঠা এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজের চেয়ে বেশি না কম, তা বিতর্কের বিষয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্তির ব্যাপারে ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে যেসব প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে এবার সময় ও পদ্ধতি চূড়ান্ত করে, আটঘাট বেঁধে কাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হবে_ এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল সবাই। কিন্তু পরিবেশ ও প্রবৃদ্ধির সমন্বয়ে টেকসই উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তার বিভিন্ন প্রাধিকার 'উলি্লখিত' হয়েছে মাত্র। সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি কেউ; আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয় দূরঅস্ত!
স্বভাবত সম্মেলনস্থলেই দলিলটি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। কড়া সমালোচনা হয়েছে। যেমন ব্রিটিশ উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ সেটাকে বলেছেন 'রসকষহীন' পাতা। বিবিসির এনভায়রনমেন্ট করেসপনডেন্ট প্রশ্ন তুলেছেন, শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত, দামি হোটেলে থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা প্রভৃতি মিলিয়ে যে খরচ হয়েছে, এই সম্মেলন তার যোগ্য কি-না? অক্সফাম জিবির চিফ এক্সিকিউটিভ বারবারা স্টকিং বিবিসির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, রিও সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যেন গোঁ-ই ধরেছিলেন যে, আমাদের এগিয়ে নিতে তারা কিছু করবেন না।
এ ধরনের কথাবার্তায় গায়ের ঝাল মিটে যাওয়ার পর এখন চলছে ঠাট্টা-তামাশা। যেমন পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক বৈশ্বিক সংগঠন ডবি্লউডবি্লউএফ হিসাব কষে দেখাচ্ছে যে, রিও ঘোষণায় ৫০ বার 'উৎসাহ প্রদান' শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। 'সমর্থন' কথাটি বলা হয়েছে ৯৯ বার। আর মাত্র পাঁচবার বলা হয়েছে 'উই উইল'। আমরা করব। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, নেতৃবৃন্দ কতটা গা বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছেন।
সব মিলিয়ে, রিও প্লাস টোয়েন্টির সম্মেলন ও এর ঘোষণাপত্রকে এক কথায় কী বলা যায়? মোক্ষম উত্তরটি টাইম ম্যাগাজিনের কাছে দিয়েছেন গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক কুমি নাইডু_ সম্মেলনটি হচ্ছে মহাকাব্যিক ব্যর্থতা আর ঘোষণাপত্রটি হচ্ছে 'ইতিহাসের দীর্ঘতম সুইসাইড নোট'।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
skrokon@gmail.com
No comments