বিপন্ন তালিকায় শঙ্খচূড়


একসময় বাংলাদেশ ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তথা পৃথিবীতে বিষধর সাপের তালিকায় কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়ে নাম ছিল সবচেয়ে উপরে। এর ভয়ঙ্কর ফণা দেখে কলজে শুকিয়ে যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা কমই আছে। দক্ষিণ এশিয়ার বন বাদারে, ভাঙা পরিত্যাক্ত বাড়ি কিংবা নির্জন জায়গা যেখানে খুব একটা মানুষের পা পড়ে না সেখানে দেখা পাওয়া যেত এই অনিন্দ্য সুন্দর সাপটির।

কিন্তু হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলের লোক-কাহিনীতে শঙ্খচূড় সাপকে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার বা সাপ সম্পর্কে মানুষের অহেতুক ভয় এই প্রাণিটিকে নিয়ে গেছে হুমকির মুখে। কিছুদিন আগেও এই সাপ দেখলে তার ছোবলের ভয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতো মানুষ। আর এভাবেই বর্তমানে পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণির তালিকায় নাম লিখিয়েছে ছোবলের জন্য বিখ্যাত শঙ্খচূড়।

ইতিমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেসন অব নেচারও (আইইউসিএন) শঙ্খচূড়কে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এছাড়া তারা এর নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে বিপন্ন প্রাণির রেড লিস্টেও।

ইংরেজিতে এই সাপের নামের সঙ্গে ‘কোবরা’ শব্দটি থাকলেও এটি কোবরা বা গোখরা নয়, এটি সম্পূর্ণ আলাদা গোছের একটি সাপ। এর আকার পর্যবেক্ষণ এবং ফণার পেছনের অংশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গোখরার সঙ্গে এটির পার্থক্য খুব সহজেই নির্ণয় করা যায়। গোখরার তুলনায় শঙ্খচূড় আকৃতিতে যথেষ্ট বড়। এর ফণার পেছনে প্রচলিত গোখরা বা খড়মপায়া গোখরার বা গোক্ষুর আকৃতি চিহ্ন থাকে না। এর কামড়ের ফলে মৃত্যুহার প্রায় ৭৫ শতাংশ।

আইইউসিএন প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আঞ্চলিকভাবে ভারতের পশ্চিম ঘাট, চীন তথা দক্ষিণ এশিয়ায় ১০ শতাংশ সাপ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এই অঞ্চলে প্রথাগত টোটকা ওষুধ তৈরি, এন্টি ভেনম সিরাম, চামড়ার জন্য এমনকি খাদ্য হিসেবেও সাপ হত্যা করা হচ্ছে।

রাজ গোখরা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতের হিন্দুদের কাছে অন্যতম ধর্মীয় আইকন এবং জাতীয় সরিসৃপ হিসেবে পরিচিত পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিষধর সাপটি অধিক জনসংখ্যার চাপে বর্তমানে আবাসস্থল হারিয়ে এবং বিভিন্ন জমিতে অধিকমাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে খাদ্য হারিয়ে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে মাদ্রাজ স্নেক পার্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং সরিসৃপবিদ রোমুলাস হোয়াইটেকার জানান, রাজ গোখরার নাম আইউসিএন’র রেড লিস্টে ওঠার অন্যতম কারণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় তথা চীনা টোটকা ওষুধ তৈরিতে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার, মাংস ও চামড়ার বিপুল ব্যবসা। আর ভারতে গত বেশ কয়েক বছরে রাজ গোখরার কামড়ের ঘটনা তেমন না ঘটলেও মানুষ কেবল ভয়ের জন্যই একে পিটিয়ে মারে। এছাড়া গোখরার প্রধান বাসস্থান নিরক্ষীয় বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়াও এর বিপন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একটি রাজ গোখরা বা শঙ্খচূড় সাপ সাধারণত লম্বায় গড়ে সর্বোচ্চ ৫.৬ মিটার (১৮.৫ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ওপফিওপাগাস হান্নাহ’। যার আক্ষরিক অর্থ ‘সাপ খাদক’। এই সাপ সাধারণত অন্যান্য ছোট আকৃতির সাপ খেয়েই তার খাদ্য চাহিদা মেটায়। অবশ্য কখনো কখনো ছোট আকৃতির অজগর খেতেও শঙ্খচূড়কে দেখা গেছে।

আমাদের দেশে সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে ছাড়া এই সাপ এখন আর খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। তাই এখনি সাপের এই প্রজাতিটি রক্ষায় নজর দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইন ২০১০ এ সাপসহ যেকোনো বন্যপ্রাণি নিধন ও পাচারে সর্বোচ্চ সাজার বিধান রয়েছে। তাই অন্যন্য প্রাণির মতো বিপন্ন প্রায় শঙ্খচূড়কে রক্ষায় এই আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা প্রয়োজন। তথ্য সহায়তা: টাইমস অব ইন্ডিয়া

No comments

Powered by Blogger.