সমকালীন প্রসঙ্গ-পেশাজীবীদের আন্দোলন এবং সরকারের আশ্বাস ও আশ্বস্তকরণের কৌশল by বদরুদ্দীন উমর

সাংবাদিকরাও এখন আন্দোলন করছেন। তাদের মূল বিক্ষোভ হলো, একের পর এক সাংবাদিক হত্যা হতে থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর কোনো প্রকৃত তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিরুদ্ধে। তাদের দাবি হলো, এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া।


দুই টেলিভিশন সাংবাদিক সাগর ও রুনি হত্যার ব্যাপারে সরকারের অবহেলা এবং ধোঁয়াটে কথাবার্তার কারণে তারা সরকারকেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করছেন। এ নিয়ে তারা আন্দোলন করছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলনকে খুব শক্তিশালী মনে হলেও এর প্রকৃত শক্তির পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি

আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ার একটা সংস্কৃতি বাংলাদেশে এখন প্রচলিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা বিশেষ দেখা না গেলেও বিভিন্ন পেশাজীবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, শ্রমিক আন্দোলনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, আন্দোলন যত ছোট বা বড় আকারেই হোক না কেন, এক পর্যায়ে সরকার তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনার আশ্বাস দেওয়ার পর সেই আন্দোলন বন্ধ হয়। আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরে যান তাদের দাবি-দাওয়া সরকার পূরণ করবে এই আশা নিয়ে অথবা আন্দোলনে ক্লান্ত হয়ে। এর ফলে কোনো ক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া পূরণ হয় না অথবা হলেও তার সামান্য মাত্র হয় এবং আন্দোলনের প্রয়োজন রয়ে যায় আগের মতোই।
সরকারের চরিত্র তারা নিজেরা নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে এত স্পষ্টভাবে উন্মোচন করে যাওয়া সত্ত্বেও এবং প্রতিশ্রুতি প্রদানে অতিশয় পারঙ্গম হওয়া এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে যাওয়া সত্ত্বেও সরকারের আশ্বাসে বিশ্বাস করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা নিজেদের আন্দোলনকে একটা পরিণতির দিকে না নিয়ে গিয়ে সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে নিজেদের আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিশ্রুতি রাখার ব্যাপারেই যখন সরকারের অপারগতা বা ব্যর্থতা দেখা দেয়, তখন আশ্বাসের দ্বারা যে বিশেষ কাজ হবে এটা মনে করার থেকে মূঢ়তা বা শিশুসুলভ কাজ আর কী হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে এখন পেশাজীবী থেকে শ্রমিক আন্দোলন পর্যন্ত সর্বত্রই এটা দেখা যাচ্ছে।
শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটা ঘটার কারণ, তাদের কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই অথবা যেখানে আছে সেখানে নেতৃত্ব মালিক ও সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে গাঁটছাড়া বাঁধা। এই নেতৃত্ব আন্দোলনের মহড়া দিলেও আসলে এরা মালিক ও সরকারের স্বার্থেই কাজ করে শ্রমিকদের সঙ্গে বেইমানি করে। এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু বাংলাদেশের এটাই এখন নিয়মে পরিণত হওয়ার কারণ, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলের মতো শক্তিশালীভাবে সংগঠিত কোনো ট্রেড ইউনিয়নও এখন বাংলাদেশে নেই।
গার্মেন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে এবং সে সঙ্গে আরও কিছু শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের কোনো অধিকার না থাকা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অস্তিত্ব না থাকার কারণে যথাযথভাবে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন এ ক্ষেত্রে দেখা যায় না। গার্মেন্ট কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে আজকাল প্রায়ই প্রচণ্ড আন্দোলন হয় মজুরি ও অন্য দাবি নিয়ে। কিন্তু যেভাবে এই আন্দোলন হয় তাকে আন্দোলন না বলে বিশেষ এক ধরনের হাঙ্গামা বলাই যুক্তিযুক্ত। সরকার ও মালিক পক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনের এই দিকটি লক্ষ্য করে তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে। কিন্তু আসলে আন্দোলনের চরিত্র হাঙ্গামার মতো দাঁড়ানোর মূল কারণ সরকার ও মালিক পক্ষেরই সৃষ্টি। এর মূল নিহিত আছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে আন্দোলন পাকিস্তানের সময় থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে চলে আসছে। আজ পর্যন্ত এই শিক্ষকরা কত আন্দোলন করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু আন্দোলনের সংখ্যা এবং ব্যাপকতার তুলনায় তার প্রাপ্তি সামান্যই। সাম্প্রতিক সময়ে যে শিক্ষক আন্দোলনগুলো হচ্ছে সেগুলোর মধ্যেও এই অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকায় এবং অন্যত্র জমা হয়ে তারা মানববন্ধন, অনশন, সমাবেশ, মিছিল করে আসছেন। কিন্তু কয়েকদিন এসব চলার পর যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন আসে সরকারি আশ্বাস। সকলেই সরকারি আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস না রাখলেও ক্লান্ত অবস্থায় তারা সরকারের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করছেন বা আশ্বাস পূরণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না হলে আবার আন্দোলন করার কথা বলছেন! মাধ্যমিক শিক্ষকদের সর্বশেষ সমাবেশ হয়েছে কয়েকদিন আগে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সরকারের দেওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে দাবি পূরণ না হলে নতুন আন্দোলনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকার তাদের প্রদত্ত আশ্বাস অনুযায়ী কিছুই করেনি! কাজেই তারা নিশ্চয়ই আবার তাদের আন্দোলন শুরু করবেন!
সাংবাদিকরাও এখন আন্দোলন করছেন। তাদের মূল বিক্ষোভ হলো, একের পর এক সাংবাদিক হত্যা হতে থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর কোনো প্রকৃত তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিরুদ্ধে। তাদের দাবি হলো, এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া। দুই টেলিভিশন সাংবাদিক সাগর ও রুনি হত্যার ব্যাপারে সরকারের অবহেলা এবং ধোঁয়াটে কথাবার্তার কারণে তারা সরকারকেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করছেন। এ নিয়ে তারা আন্দোলন করছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলনকে খুব শক্তিশালী মনে হলেও এর প্রকৃত শক্তির পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। উপরন্তু এই আন্দোলনে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির জন্য সরকারি তৎপরতাকেই অনেক বেশি কার্যকর মনে হচ্ছে। সম্প্রতি এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান সাগর-রুনি হত্যা বিষয়ে যেসব বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটা বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এসবই যে এক অখণ্ড চক্রান্তেরই অন্তর্গত এতে সন্দেহ নেই।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা অপরাধীকে পাকড়াও করে ফেলবেন। কিন্তু তারপরেই তার মুখে শোনা গেল অন্য কথা। এটা এক জটিল হত্যাকাণ্ড। এতই জটিল যে, এর তদন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে তদারক করা সম্ভব নয়। এর দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে নিয়েছেন! এ কথা বোকার পক্ষেও বোঝার অসুবিধা নেই যে, তদন্তের প্রথম দিকেই এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যাতে সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ লোকদের ফেঁসে যাওয়ার কথা। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই এই মামলার মূল সাক্ষ্য-প্রমাণ ধ্বংস করে মামলাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে, যাতে কারও পক্ষে প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই পুলিশ দীর্ঘদিন তদন্ত করে শেষ পর্যন্ত বলেছে, তাদের পক্ষে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া আর সম্ভব নয়! তাদের এই ব্যর্থতার পর র‌্যাবকে এই মামলার তদন্ত ভার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু র‌্যাবের অবস্থাও দাঁড়িয়েছে একই রকম! কাজেই দেখা যাচ্ছে, দেশে যাদের হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তারা এই দায়িত্ব পালনে অপারগ! এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী তিনটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত পরিচালনার এক ঘোষণা দিয়েছেন! তদন্ত ভার হাতে নেওয়ার পর এ বিষয়ে রিপোর্ট তো জনগণের সামনে তার উপস্থিত করা দরকার। সেটা না করে তিনি এমন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তিন হত্যার তদন্ত পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন! কিন্তু তদন্ত করবে কে? পুলিশ-র‌্যাব তো এই তদন্ত কাজ গত কয়েক মাস ধরে করেও এই মামলার কোনো কূলকিনারা পেল না। তাহলে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ তিন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিচালনার যে ঘোষণা তিনি দিলেন তার সঙ্গে আন্দোলনের মুখে সরকারের আশ্বস্তকরণের সাধারণ কৌশলের পার্থক্য কী? এ বিষয় সরকারকে তো তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন তোলা হয়েছে অথবা দাবি উঠানো হয়েছে এমন কোনো কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। কাজেই এ ক্ষেত্রে আশ্বাসের শরবত খেয়ে তাদের মাথা ঠাণ্ডা হবে কিনা বলা মুশকিল।
আশ্বাসের বাণী শুনে যারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে থাকেন তাদের মধ্যে এক হিসেবে সাংবাদিকরা অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ প্রচারমাধ্যম তাদের হাতে। এখন মুদ্রিত মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলনের মধ্যে তাদের আয়ত্তগত পেশাগত শক্তির কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কাজেই সকল সাংবাদিক হত্যার তদন্ত ও অপরাধীর শাস্তি তো দূরের কথা, সব থেকে আলোচিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাগর-রুনি হত্যার প্রকৃত অপরাধীরা যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও চিহ্নিত হবে এবং তাদের শাস্তি হবে এটা মনে করা এক অপরিসীম মূঢ়তা ছাড়া আর কী?
২.৭.২০১২

No comments

Powered by Blogger.