কল্পকথার গল্প-ঢাকায় চিত্রগুপ্তের চতুর্থ সফর by আলী হাবিব
স্বর্গের পেশকার চিত্রগুপ্ত নিজের দপ্তরে বসে ঢুলছিলেন। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাঁর। এ বয়সে একটু ক্লান্তিতে পেয়ে বসে। এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া এই দুপুরের দিকে কাজের চাপ খুব একটা থাকে না। এ সময় একটু ঝিমিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু পরমেশ্বর যে সব কিছুই দেখছেন, সেটা বোধ হয় চিত্রগুপ্ত ভুলে গিয়েছিলেন।
তিনি চিত্রগুপ্তকে ডেকে পাঠালেন। জরুরি তলব। তটস্থ চিত্রগুপ্ত ঢুকলেন পরমেশ্বরের খাস কামরায়। খুব ঠাণ্ডা গলায় পরমেশ্বর চিত্রগুপ্তকে বললেন, তোমার অবস্থা তো খুব খারাপ হে।
কিছুই বুঝতে না পেরে চিত্রগুপ্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। পরমেশ্বর বললেন, তোমার হাতে-পায়ে যে জং ধরে গেছে, এটা কি তুমি বুঝতে পারছ।
চিত্রগুপ্ত বললেন, 'পরমেশ্বর শরীরের আর দোষ কী। বয়স হয়েছে। একটু তো এদিক-সেদিক হতেই পারে। ওদিকে আমার দপ্তরেও তো কাজ কম। আজকাল মর্ত্যে কীসব অ্যান্টি-অ্যাজিং ওষুধপত্র নাকি বেরিয়েছে। ফলে এখানে আমদানি কম। আমদানি না হলে আমার তো খুব বেশি একটা কাজ নেই।
কাজ খুঁজে বের করে নাও- পরমেশ্বরের কথায় চিত্রগুপ্ত একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন। স্বর্গধামের পেশকার তিনি। পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখেন। সময়মতো সেগুলো পেশ করেন। তাঁর হিসাবে কোনো দিন ভুল হয়নি। কাজ কম থাকলে এ বয়সে একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু এখন পরমেশ্বর বলছেন কাজ খুঁজে বের করতে। কী কাজ করবেন তিনি। এটা তো আর সওদাগরি অফিস নয় যে গোডাউনে কী মাল ঢুকছে, বের হচ্ছে- তার হিসাব লিখবেন। স্বাভাবিকভাবেই পরমেশ্বর কাজ খুঁজে বের করার কথা বলাতে একটু বিপাকেই পড়লেন চিত্রগুপ্ত। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
তাঁর এই অবস্থা দেখে পরমেশ্বর বললেন, কাজ খুঁজে পাচ্ছ না তো কাজ আমি বের করে দিচ্ছি। তোমাকে একটু ট্যুরে যেতে হবে।
ট্যুর! এই বয়সে! ভাবতে গিয়ে একটু বোধ হয় ভয়ই পেয়ে গেলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু পরমেশ্বরের সামনে কোনো কিছু প্রকাশ করা চলবে না। কিন্তু পরমেশ্বর অন্তর্যামী। কোনো কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না তাঁর। তিনি বললেন, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যেখানে তোমাকে যেতে বলব, এ জায়গাটি তোমার চেনা। আগেও কয়েকবার গিয়েছ সেখানে। যাও, আরেকবার যাও। হাওয়া বদল হবে। পাশাপাশি তোমার একটা অনেস্ট রিপোর্ট আমার দরকার।
পরমেশ্বরের ইচ্ছাই আদেশ। তবু চিত্রগুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে মহাপ্রভু?
মর্ত্যে। এক শব্দে উত্তর দিলেন পরমেশ্বর। কিন্তু মর্ত্য কথাটা শুনেই মনে হচ্ছে, আজকাল সেখানকার খবরের কাগজে নানা রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। এসব ঠিক কি না, সেটা আমার জানা দরকার। তুমি অন্তত নির্মোহ একটা রিপোর্ট দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই তোমাকেই পাঠাতে চাই।
মর্ত্যের কথা শুনেই চমকে উঠলেন চিত্রগুপ্ত। এর আগেও তিনবার মর্ত্যে এসেছেন তিনি। কোনোবারের অভিজ্ঞতাই মধুর নয় তাঁর। একবার স্বর্গে আত্মা সাপ্লাই কমে গেলে এসেছিলেন। সেবার রীতিমতো নিগৃহীত হতে হয়েছিল তাঁকে। আরেকবার এসেছিলেন পরমেশ্বরের নির্দেশে একটা রিপোর্ট তৈরির কাজে। সেবারও বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলেন। পরমেশ্বরের কাছে খবর গিয়েছিল, মর্ত্যে নাকি মানুষ নেই। তিনি এসেও মানুষের সন্ধান পাননি। আরেকবার এসেছিলেন আরেকটা রিপোর্ট করতে। সেবার পরমেশ্বরের কাছে খবর গিয়েছিল, মর্ত্যে কিছু এলাকার মানুষের মাথায় নাকি মস্তিষ্ক নেই। খবর শুনে পরমেশ্বর উতলা হয়ে পড়েছিলেন। বিস্তর বকাঝকা করেছিলেন স্বর্গের সব দেবতাকে। তারপর চিত্রগুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন বিস্তারিত দেখেশুনে রিপোর্ট করতে। চিত্রগুপ্ত এসে দেখেশুনে তাঁর রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। এবারও সেই মর্ত্যে আবার যেতে হবে শুনে বিচলিত হলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু পরমেশ্বরের হুকুম অমান্য করার উপায় নেই।
অতঃপর মর্ত্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। যাত্রার আগের দিন আবার পরমেশ্বর ডেকে পাঠালেন তাঁকে। বললেন, এবার চিত্রগুপ্তকে যেতে হবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশের কথা শুনে চিত্রগুপ্তের মুখ শুকিয়ে গেল। পরমেশ্বর তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা কিসের। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। সেখানে সবাই মিলে স্থির করেছে, রাজধানীকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা করবে। চারদিকে সাজসাজরব। একবার গিয়েই দেখো, তোমার হয়তো আর আসতে ইচ্ছে করবে না। এর আগেও তো এক রিপোর্টে লিখেছিলে, মর্ত্য তোমাকে টেনেছে। কাজেই হৃষ্টচিত্তে চলে যাও।
শুভ দিন দেখে চিত্রগুপ্ত রওনা হলেন। স্বর্গের দেবতা। রওনা হওয়া মানে ইচ্ছে প্রকাশ করা। ইচ্ছে প্রকাশ করলেই স্বর্গ থেকে সোজা মর্ত্যে আবির্ভাব। নো ভিসা, নো পাসপোর্ট। সাতসকালে ঢাকায় নেমে তো তাঁর ছোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো অবস্থা। এ কোন ঢাকাকে দেখছেন তিনি। অনেক আগে যখন এসেছিলেন, তখনকার ঢাকার সঙ্গে আজকের ঢাকার অনেক তফাত। আজকের ঢাকার সঙ্গে সেদিনের ঢাকাকে মেলানোই যায় না। একটা আবাসিক হোটেলে গিয়ে নিজের থাকার জন্য একটা ঘর ঠিক করে চিত্রগুপ্ত ঢাকা শহর দেখতে বের হলেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা বাস পেয়ে গেলেন। সেটায়ই চেপে বসলেন তিনি। অনেক দিনের অভ্যাসমতো একটু ঝিমুনিতে পেয়েছিল বোধ হয়। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন যেখান থেকে বাসে উঠেছিলেন, বাসটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বাসের মধ্যে সবাই ঘামছে। চিত্রগুপ্তের তো ঠাণ্ডা-গরম নেই। স্বর্গের দেবতাদের ওসব থাকে না। তিনি বাসের মধ্যে বসে আছেন। বাসটা চলতে শুরু করল। একটু একটু করে এগোচ্ছে। বাসের ভেতরের লোকজন বলাবলি করছে, জ্যাম। চিত্রগুপ্ত পাশের লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই জ্যাম কী? ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, 'জ্যাম বোঝেন না? ট্র্যাফিক জ্যাম। দেখছেন না রাস্তার কী অবস্থা। নতুন এসেছেন নাকি?' চিত্রগুপ্তের ইচ্ছে ছিল আগে শহরটা ঘুরে দেখবেন। এদিক থেকে ওদিকে যাবেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না তাঁর। মতিঝিল থেকে এয়ারপোর্ট পেরিয়ে উত্তরার দিকে যেতেই দিনের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন গাড়িতে আর চড়বেন না। হেঁটেই চলাচল করবেন। বুড়ো শরীরের জন্য সেটা একটা ঝক্কি। তা হয় হোক। তিনি হেঁটেই ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে দেখবেন। হাঁটতে শুরু করলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু একি! ঢাকার রাস্তাঘাট সব কাটা কেন? চিত্রগুপ্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। এ রাস্তা ছেড়ে ও রাস্তায় ঢুকলেন। সেখানেও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে মাটির নিচে বোধ হয় গুপ্তধন আছে। তাই রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু শহরের অধিকাংশ রাস্তার নিচে কি গুপ্তধন থাকতে পারে? তিনি একজনকে ধরে বসলেন। জানতে চাইলেন, ভাই এভাবে রাস্তা কাটা হচ্ছে কেন? ভদ্রলোক অবাক চোখে চিত্রগুপ্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ যেন খেপে গেলেন। উন্নয়ন বোঝেন, উন্নয়ন- জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। চিত্রগুপ্ত মাথা নেড়ে জানালেন, এ বিষয়ে তিনি অজ্ঞ। ভদ্রলোক বললেন, উন্নয়ন হচ্ছে। যত খোঁড়া হবে তত উন্নয়ন। বুঝলেন? ওই যে বোর্ডে লেখা আছে দেখুন গিয়ে। যত্তসব! ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। চিত্রগুপ্ত বোর্ডের সামনে গিয়ে দেখলেন, সেটাতে লেখা আছে, 'উন্নয়ন কাজ চলিতেছে'। চিত্রগুপ্ত ফিরে এলেন তাঁর হোটেলে। ঘরে ঢুকে ফ্যান ও বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখেন বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকলেন তিনি। সন্ধ্যাবেলা দেখেন, আকাশের মুখ ভার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামল। ক্লান্ত চিত্রগুপ্ত ঘুমোতে গেলেন। কিন্তু কোত্থেকে অজস্র মশার আক্রমণ। চিত্রগুপ্ত হোটেলের লোক ডাক দিলেন। তারা মশারি দিয়ে গেল। তিনি মশারি টানাতে জানেন না। স্বর্গে তো ওসবের বালাই নেই। মশারি হাতে করে সারা রাত বসে থাকলেন তিনি। সকালবেলা হোটেলের বাইরে বের হতে গিয়ে তাঁর চোখ আবার কপালে ওঠার দশা। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে চিত্রগুপ্ত স্বর্গের দিকে রওনা হলেন।
স্বর্গে যেতেই পরমেশ্বরের ডাক পড়ল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন তিনি। চিত্রগুপ্ত বললেন, এক দিনেই অনেক কিছু জানা হয়ে গেল?
চিত্রগুপ্ত বললেন, এক দিনেই আমি ঢাকা সম্পর্কে দিব্যজ্ঞান লাভ করেছি পরমেশ্বর। যথাসময়ে বিস্তারিত রিপোর্ট আপনাকে দেব।
আপাতত সামারিটা শুনিয়ে যাও, বললেন পরমেশ্বর।
চিত্রগুপ্ত বললেন, ঢাকা এক অদ্ভুত শহর। প্রথম সেখানে কেউ গেলে মনে করবে, এ শহরের রাস্তার নিচে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো সভ্যতা মাটির নিচে লুকিয়ে আছে। কারণ শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছ। আসলে পরমেশ্বর, সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির আরেক নাম উন্নয়ন। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় রাস্তায় পানি জমে যায়। সেও এক অদ্ভুত দৃশ্য। বিনা পয়সায় ভেনিস দর্শন হয়ে যায়। আর রাতের ঢাকা? কী বলব পরমেশ্বর, মশা নামের এক ক্ষুদ্র কীটের আক্রমণে এক রাতেই আমি ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
কিছুই বুঝতে না পেরে চিত্রগুপ্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। পরমেশ্বর বললেন, তোমার হাতে-পায়ে যে জং ধরে গেছে, এটা কি তুমি বুঝতে পারছ।
চিত্রগুপ্ত বললেন, 'পরমেশ্বর শরীরের আর দোষ কী। বয়স হয়েছে। একটু তো এদিক-সেদিক হতেই পারে। ওদিকে আমার দপ্তরেও তো কাজ কম। আজকাল মর্ত্যে কীসব অ্যান্টি-অ্যাজিং ওষুধপত্র নাকি বেরিয়েছে। ফলে এখানে আমদানি কম। আমদানি না হলে আমার তো খুব বেশি একটা কাজ নেই।
কাজ খুঁজে বের করে নাও- পরমেশ্বরের কথায় চিত্রগুপ্ত একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন। স্বর্গধামের পেশকার তিনি। পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখেন। সময়মতো সেগুলো পেশ করেন। তাঁর হিসাবে কোনো দিন ভুল হয়নি। কাজ কম থাকলে এ বয়সে একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু এখন পরমেশ্বর বলছেন কাজ খুঁজে বের করতে। কী কাজ করবেন তিনি। এটা তো আর সওদাগরি অফিস নয় যে গোডাউনে কী মাল ঢুকছে, বের হচ্ছে- তার হিসাব লিখবেন। স্বাভাবিকভাবেই পরমেশ্বর কাজ খুঁজে বের করার কথা বলাতে একটু বিপাকেই পড়লেন চিত্রগুপ্ত। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
তাঁর এই অবস্থা দেখে পরমেশ্বর বললেন, কাজ খুঁজে পাচ্ছ না তো কাজ আমি বের করে দিচ্ছি। তোমাকে একটু ট্যুরে যেতে হবে।
ট্যুর! এই বয়সে! ভাবতে গিয়ে একটু বোধ হয় ভয়ই পেয়ে গেলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু পরমেশ্বরের সামনে কোনো কিছু প্রকাশ করা চলবে না। কিন্তু পরমেশ্বর অন্তর্যামী। কোনো কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না তাঁর। তিনি বললেন, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যেখানে তোমাকে যেতে বলব, এ জায়গাটি তোমার চেনা। আগেও কয়েকবার গিয়েছ সেখানে। যাও, আরেকবার যাও। হাওয়া বদল হবে। পাশাপাশি তোমার একটা অনেস্ট রিপোর্ট আমার দরকার।
পরমেশ্বরের ইচ্ছাই আদেশ। তবু চিত্রগুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে মহাপ্রভু?
মর্ত্যে। এক শব্দে উত্তর দিলেন পরমেশ্বর। কিন্তু মর্ত্য কথাটা শুনেই মনে হচ্ছে, আজকাল সেখানকার খবরের কাগজে নানা রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। এসব ঠিক কি না, সেটা আমার জানা দরকার। তুমি অন্তত নির্মোহ একটা রিপোর্ট দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই তোমাকেই পাঠাতে চাই।
মর্ত্যের কথা শুনেই চমকে উঠলেন চিত্রগুপ্ত। এর আগেও তিনবার মর্ত্যে এসেছেন তিনি। কোনোবারের অভিজ্ঞতাই মধুর নয় তাঁর। একবার স্বর্গে আত্মা সাপ্লাই কমে গেলে এসেছিলেন। সেবার রীতিমতো নিগৃহীত হতে হয়েছিল তাঁকে। আরেকবার এসেছিলেন পরমেশ্বরের নির্দেশে একটা রিপোর্ট তৈরির কাজে। সেবারও বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলেন। পরমেশ্বরের কাছে খবর গিয়েছিল, মর্ত্যে নাকি মানুষ নেই। তিনি এসেও মানুষের সন্ধান পাননি। আরেকবার এসেছিলেন আরেকটা রিপোর্ট করতে। সেবার পরমেশ্বরের কাছে খবর গিয়েছিল, মর্ত্যে কিছু এলাকার মানুষের মাথায় নাকি মস্তিষ্ক নেই। খবর শুনে পরমেশ্বর উতলা হয়ে পড়েছিলেন। বিস্তর বকাঝকা করেছিলেন স্বর্গের সব দেবতাকে। তারপর চিত্রগুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন বিস্তারিত দেখেশুনে রিপোর্ট করতে। চিত্রগুপ্ত এসে দেখেশুনে তাঁর রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। এবারও সেই মর্ত্যে আবার যেতে হবে শুনে বিচলিত হলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু পরমেশ্বরের হুকুম অমান্য করার উপায় নেই।
অতঃপর মর্ত্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। যাত্রার আগের দিন আবার পরমেশ্বর ডেকে পাঠালেন তাঁকে। বললেন, এবার চিত্রগুপ্তকে যেতে হবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশের কথা শুনে চিত্রগুপ্তের মুখ শুকিয়ে গেল। পরমেশ্বর তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা কিসের। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। সেখানে সবাই মিলে স্থির করেছে, রাজধানীকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা করবে। চারদিকে সাজসাজরব। একবার গিয়েই দেখো, তোমার হয়তো আর আসতে ইচ্ছে করবে না। এর আগেও তো এক রিপোর্টে লিখেছিলে, মর্ত্য তোমাকে টেনেছে। কাজেই হৃষ্টচিত্তে চলে যাও।
শুভ দিন দেখে চিত্রগুপ্ত রওনা হলেন। স্বর্গের দেবতা। রওনা হওয়া মানে ইচ্ছে প্রকাশ করা। ইচ্ছে প্রকাশ করলেই স্বর্গ থেকে সোজা মর্ত্যে আবির্ভাব। নো ভিসা, নো পাসপোর্ট। সাতসকালে ঢাকায় নেমে তো তাঁর ছোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো অবস্থা। এ কোন ঢাকাকে দেখছেন তিনি। অনেক আগে যখন এসেছিলেন, তখনকার ঢাকার সঙ্গে আজকের ঢাকার অনেক তফাত। আজকের ঢাকার সঙ্গে সেদিনের ঢাকাকে মেলানোই যায় না। একটা আবাসিক হোটেলে গিয়ে নিজের থাকার জন্য একটা ঘর ঠিক করে চিত্রগুপ্ত ঢাকা শহর দেখতে বের হলেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা বাস পেয়ে গেলেন। সেটায়ই চেপে বসলেন তিনি। অনেক দিনের অভ্যাসমতো একটু ঝিমুনিতে পেয়েছিল বোধ হয়। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন যেখান থেকে বাসে উঠেছিলেন, বাসটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বাসের মধ্যে সবাই ঘামছে। চিত্রগুপ্তের তো ঠাণ্ডা-গরম নেই। স্বর্গের দেবতাদের ওসব থাকে না। তিনি বাসের মধ্যে বসে আছেন। বাসটা চলতে শুরু করল। একটু একটু করে এগোচ্ছে। বাসের ভেতরের লোকজন বলাবলি করছে, জ্যাম। চিত্রগুপ্ত পাশের লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই জ্যাম কী? ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, 'জ্যাম বোঝেন না? ট্র্যাফিক জ্যাম। দেখছেন না রাস্তার কী অবস্থা। নতুন এসেছেন নাকি?' চিত্রগুপ্তের ইচ্ছে ছিল আগে শহরটা ঘুরে দেখবেন। এদিক থেকে ওদিকে যাবেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না তাঁর। মতিঝিল থেকে এয়ারপোর্ট পেরিয়ে উত্তরার দিকে যেতেই দিনের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন গাড়িতে আর চড়বেন না। হেঁটেই চলাচল করবেন। বুড়ো শরীরের জন্য সেটা একটা ঝক্কি। তা হয় হোক। তিনি হেঁটেই ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে দেখবেন। হাঁটতে শুরু করলেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু একি! ঢাকার রাস্তাঘাট সব কাটা কেন? চিত্রগুপ্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। এ রাস্তা ছেড়ে ও রাস্তায় ঢুকলেন। সেখানেও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে মাটির নিচে বোধ হয় গুপ্তধন আছে। তাই রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু শহরের অধিকাংশ রাস্তার নিচে কি গুপ্তধন থাকতে পারে? তিনি একজনকে ধরে বসলেন। জানতে চাইলেন, ভাই এভাবে রাস্তা কাটা হচ্ছে কেন? ভদ্রলোক অবাক চোখে চিত্রগুপ্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ যেন খেপে গেলেন। উন্নয়ন বোঝেন, উন্নয়ন- জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। চিত্রগুপ্ত মাথা নেড়ে জানালেন, এ বিষয়ে তিনি অজ্ঞ। ভদ্রলোক বললেন, উন্নয়ন হচ্ছে। যত খোঁড়া হবে তত উন্নয়ন। বুঝলেন? ওই যে বোর্ডে লেখা আছে দেখুন গিয়ে। যত্তসব! ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। চিত্রগুপ্ত বোর্ডের সামনে গিয়ে দেখলেন, সেটাতে লেখা আছে, 'উন্নয়ন কাজ চলিতেছে'। চিত্রগুপ্ত ফিরে এলেন তাঁর হোটেলে। ঘরে ঢুকে ফ্যান ও বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখেন বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকলেন তিনি। সন্ধ্যাবেলা দেখেন, আকাশের মুখ ভার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামল। ক্লান্ত চিত্রগুপ্ত ঘুমোতে গেলেন। কিন্তু কোত্থেকে অজস্র মশার আক্রমণ। চিত্রগুপ্ত হোটেলের লোক ডাক দিলেন। তারা মশারি দিয়ে গেল। তিনি মশারি টানাতে জানেন না। স্বর্গে তো ওসবের বালাই নেই। মশারি হাতে করে সারা রাত বসে থাকলেন তিনি। সকালবেলা হোটেলের বাইরে বের হতে গিয়ে তাঁর চোখ আবার কপালে ওঠার দশা। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে চিত্রগুপ্ত স্বর্গের দিকে রওনা হলেন।
স্বর্গে যেতেই পরমেশ্বরের ডাক পড়ল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন তিনি। চিত্রগুপ্ত বললেন, এক দিনেই অনেক কিছু জানা হয়ে গেল?
চিত্রগুপ্ত বললেন, এক দিনেই আমি ঢাকা সম্পর্কে দিব্যজ্ঞান লাভ করেছি পরমেশ্বর। যথাসময়ে বিস্তারিত রিপোর্ট আপনাকে দেব।
আপাতত সামারিটা শুনিয়ে যাও, বললেন পরমেশ্বর।
চিত্রগুপ্ত বললেন, ঢাকা এক অদ্ভুত শহর। প্রথম সেখানে কেউ গেলে মনে করবে, এ শহরের রাস্তার নিচে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো সভ্যতা মাটির নিচে লুকিয়ে আছে। কারণ শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছ। আসলে পরমেশ্বর, সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির আরেক নাম উন্নয়ন। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় রাস্তায় পানি জমে যায়। সেও এক অদ্ভুত দৃশ্য। বিনা পয়সায় ভেনিস দর্শন হয়ে যায়। আর রাতের ঢাকা? কী বলব পরমেশ্বর, মশা নামের এক ক্ষুদ্র কীটের আক্রমণে এক রাতেই আমি ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments